যৌথ পরিবার একসময় বাঙালি সমাজের ঐতিহ্য ছিল। দিনে দিনে সেই ঐতিহ্য ভেঙে গেছে। ছোট পরিবারের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক সভ্যতাকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের প্রভাবে সমাজকাঠামো ভেঙে গেছে। অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়েছে মানুষ। প্রযুক্তির আগ্রাসন, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, আত্মকেন্দ্রিকতা- সবই দিয়েছে বিশ্বায়ন। তবে সব দোষ বিশ্বায়নকে দিলেই হবে না। এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতার ব্যাপারও রয়েছে।
সমাজের মৌলিক কাঠামো গড়ে ওঠে পরিবারকে কেন্দ্র করে। একটি পরিবার শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, এটি একটি আত্মিক বন্ধন, যেখানে ভালোবাসা, ত্যাগ, সহানুভূতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হয়। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, সমাজের সেই সম্পর্কগুলোর মধ্যে আবেগ লোপ পাচ্ছে। সম্পর্কের মধ্যে ফাটল তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা নাড়া দিয়েছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। পরিবারের এক সদস্য আরেক সদস্যকে খুন করতেও পিছপা হচ্ছে না। সম্পত্তির লোভে প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে সন্তানকে হত্যা করছেন বাবা-মা। আবার জন্মদাতা বাবা-মাকেও হত্যা করতে সন্তানদের বাধছে না।
অনেকে মনে করেন, পাশ্চাত্য সমাজের প্রভাব পড়েছে বাঙালি সমাজে। অথচ একটা সময় বাঙালি সমাজের ‘যৌথ পরিবার’ প্রথা তুলে ধরা হতো নাটক-সিনেমায়। এর একটা অসম্ভব সৌন্দর্যগুণও ছিল। পারিবারিক বন্ধন মজবুত থাকার ফলে পারিবারিক খুন, কলহ-বিবাদ, কোন্দল বেশি হতো না। এখনো অনেকে যৌথ পরিবার ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় রয়েছে।
ইউরোপসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোয় পারিবারিক বন্ধন ভেঙে পড়ায় তারা নতুন করে যৌথ পরিবার ফিরিয়ে আনার প্রত্যয়ে কাজ করছে। সেখানে সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে আলাদা হওয়ার প্রবণতা বেশি। এ ক্ষেত্রে বাবা-মাকে একা একাই থাকতে হচ্ছে। যা পারিবারিক বন্ধনকে গভীর সংকটে ফেলে দিচ্ছে। সেই পাশ্চাত্যের ভাবধারা আমাদের সমাজেও প্রভাব ফেলেছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী পালিত হলো আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক বন্ধন ভাঙার পেছনের মূল কারণ পরিবারের সদস্যদের জীবনধারা, প্রযুক্তির প্রভাব, ভোগবাদের বিস্তার, যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারে রূপান্তর এবং প্রজন্মগত মানসিক ফারাক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, নতুন প্রজন্মের চিন্তাচেতনা, জীবনধারা এবং মূল্যবোধ অনেকটাই আলাদা। মা-বাবা ও সন্তানের মাঝে প্রায়ই দেখা দেয় মতবিরোধ, যা একসময় দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। পারিবারিক বন্ধনের অভাব এই দূরত্বকে আরও গভীর করে তোলে। তাই সন্তানের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো প্রয়োজন।
পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ার ফলে দেশে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে প্রতিটি সমাজব্যবস্থায়। শিশুদের মানসিক বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কিশোর গ্যাংয়ের তীব্র লড়াই জমে উঠেছে। একাকিত্ব, বিষণ্নতা, অবসাদ ও আত্মহত্যা, দাম্পত্য কলহ ও বিচ্ছেদ বাড়ছে। শিশুদের মধ্যে পারস্পরিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য পরিবার ও বিদ্যালয়ের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বন্ধন অটুট থাকার সুফল সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের জানাতে হবে। এতে পরস্পরের প্রতি পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। শক্তিশালী পারিবারিক বন্ধনই সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। তাই আসুন সবাই সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ হই।