বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ ১০ থেকে ১২ মাসের খাদ্যমূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যনিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। সেখানে বিভিন্ন দেশের খাদ্যনিরাপত্তার হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর খাদ্যমূল্যস্ফীতির একটি হালনাগাদ তথ্যও সামনে এসেছে। তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্যমূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশেই বেশি। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, খাদ্যমূল্যস্ফীতি বাংলাদেশে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। ভারতে খাদ্যমূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের কম। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি এখন ‘মাইনাস’ (নেতিবাচক), অর্থাৎ সেখানে খাদ্যপণ্যের দাম অনেকটাই কমেছে। অন্যদিকে নেপাল ও মালদ্বীপে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কম। সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশে খাদ্যমূল্যস্ফীতি এখন সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, মার্চ শেষে দেশে খাদ্যমূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। প্রায় তিন বছর ধরে বাংলাদেশে এ উচ্চমূল্যস্ফীতি বিরাজমান। খাদ্যমূল্যস্ফীতি এক বছর ধরে অনেকটাই বেশি। গত ১০ মাস খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি। এরপর গত ফেব্রুয়ারি থেকে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে নামে। মার্চ মাসে এসে কিছুটা স্বস্তির খবর আসে। গত জুলাই মাসে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে। যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
মূল্যস্ফীতির ফলে সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের সীমিত আয়ের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এতে করে আয়ের পুরোটাই সংসার চালাতে ব্যয় হয়। এরপরও বাড়তি ধারদেনার প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বা আয় কম হলে বৈষম্য তৈরি হয়। এটি বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই চলমান।
বাংলাদেশে সব শ্রেণির মানুষের খাবারের খরচ বেড়েছে এক-দশমাংশ প্রায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো খাদ্যমূল্যস্ফীতি অনেকটা কমাতে পারলেও বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়নি। করোনা-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, এরপর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন- সবমিলিয়ে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় খাদ্যমূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। সে কারণে, প্রায় দুই বছর ধরে চলা বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের খাদ্যনিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিবেদনের খাদ্যমূল্যস্ফীতির লাল শ্রেণির তালিকায় অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ এবং রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয়ে জোর দিয়েছেন। উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা এবং পণ্য সংগ্রহে বাড়তি ব্যয় কমাতে চাঁদা বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারকে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগী ও চাঁদাবাজদের বিতাড়িত করতে হবে। প্রতিযোগিতা কমিশনকে কার্যকর করতে হবে। বাজার কিছু ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে, এ থেকে মুক্ত করতে হবে। এসব আগামী বাজেটে আনতে হবে। নাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চমূল্যস্ফীতি তথা খাদ্যমূল্যস্ফীতির সঠিক তথ্য দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত থাকায় অর্থনীতি কতটা গভীরে ছিল তা জানা সম্ভব হয়নি। বিগত সরকারের আমলে ডলারের বিনিময় হারের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় তা অনেকটা আঁধারেই রয়ে যায়। এরপর দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিষয়টি আমলে নেয়। তবে বাজার পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমেনি। যে কারণে দাম বাড়ার প্রবণতা ঠিক আগের মতোই রয়েছে।
তাই মূল্যস্ফীতি তথা খাদ্যমূল্যস্ফীতি কমানোই এখন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতি এমনভাবে করতে হবে যাতে মূল্যস্ফীতি সহজেই রোধ করা যায়। বাজার তদারকির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।