আমাদের প্রতিদিনের জীবন কাক্ষিত, স্বাভাবিক এবং নৈমিত্তিক। এই জীবনের মধ্যে আমরা বাস করি এবং এই জীবন হচ্ছে আমাদের ক্রিয়া-কর্মের জীবন। এই জীবনকে আমরা উদযাপন করি না। যেহেতু এই জীবন প্রাত্যহিকতার মধ্যে নিঃশেষ হয়। সুতরাং এই জীবনকে আমরা উদযাপন করি-এটা বলতে পারি না। কিন্তু একটি বৎসরের সব কটি দিনের মধ্যে একটি বা দুটি দিনকে বিশেষ মর্যাদা দেই। সেগুলো যেন চিরপুরাতনের মধ্যে নতুনরূপে দেখা দেয়। এরকম একটি দিন হচ্ছে বর্ষ উদযাপনের মধ্যে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। অনেকের ধারণা এই দিনটি হিন্দুদের ধর্মাশ্রিত একটি উৎসবের দিন। কথাটি ঠিক নয়। কৃষিভিত্তিক জীবনে ফসল তোলার কাজে যারা নিযুক্ত এদিনটি তাদের জন্য বিশেষ উৎসবের দিন। এক সময় এদেশে হিন্দু জমিদার ছিল, মুসলমান জমিদারও ছিল। তবে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দু জমিদার ছিল বেশি। তারা ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালন করতো। তবে মনে রাখতে হবে বাংলা নববর্ষের সঙ্গে হিন্দু ধর্ম অথবা হিন্দু সামাজিক ব্যবস্থার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে অতীতে হিন্দু ব্যবসায়ীরা তাদের খেরো খাতা পরিবর্তন করে। নতুন খাতা খুলতেন। এখনও নববর্ষের দিনে খেরো পাতা রদবদল হচ্ছে।
বাংলা কাব্যের মধ্যযুগে নববর্ষ পালন বলে কিছু নেই। মধ্যযুগের কাব্যে ঋতুর বর্ণনা আছে; আবার বারমাসি আছে। ঋতুর বর্ণনায় বসন্ত ঋতুর ক্ষেত্রে চৈত্র ও বৈশাখ-এ দুটি মাসের কথা আসত। হিন্দী অবধি কাব্যে মালিক মুহম্মদ জায়সী বসন্ত ঋতুর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : প্রথম এল বসন্ত নবীন ঋতু-চৈত্র ও বৈশাখের সুন্দর ও উপভোগ্য ঋতু। চন্দন-সুগন্ধিত চীর পরিধান করলেন সুন্দরী, সহাস্যে সিঁথিতে দিলেন সিঁদুর।। কুসুম-মাল্য পরে এবং সুগন্ধি পরিমল ভরপুর হয়ে মলয়-গিরি-চন্দন রেণু ছড়ালেন কৈলাসে বা সুখশয্যায়। শয্যায় শ্বেত আবরণে বিকীর্ণ হলো ফুল। সুন্দরী এবং কান্ত মিলিত হলেন সুখ ভোগে। প্রিয় সহযোগে সুন্দরী উৎসর্গ করলেন যৌবন। ভ্রমর পুষ্পের সঙ্গে মিলিত । হয়ে ধুমারী বা দোল উৎসব করলো। এখন ফাগের উৎসব, যুক্তকণ্ঠে তারা গাইলো চাচরি বা হোলীর গীত। বিরহকে নিঃস্ব করলো বা শেষ করলো যেমনটা হোলীতে হয় অর্থাৎ হোলীর আনন্দে বিরহ-সন্তাপ দূরীভূত হয়। কান্তা যার ঘরে প্রভু তার জন্য সুখময়, নিত্য সেখানে আসে বসন্ত। আনন্দে তারা আসে দেব মন্দিরে (উৎসবের জন্য), দুঃখ কোথায় তারা তা জানে না।
তবে বসন্ত ঋতুর মাসের হিসেবে বৈশাখের উল্লেখ থাকলেও বৈশাখকে আমরা সুস্পষ্টভাবে পাই বারমাসি’ কাব্যে। বারমাসিহিন্দী অবধিতে আছে, বাংলাতেও আছে।
বাংলা নববর্ষ আমরা কোনোক্রমেই হারাতে পারি না। রবীন্দ্রনাথ এমনভাবে বৈশাখকে বরণ করেছেন, বর্ষশেষে সমাপ্তি সঙ্গীত গেয়েছেন যে, পহেলা বৈশাখ আমাদের চিন্তাচেতনায় আবেগের মধ্যে চিরকালের জন্য ধরা পড়েছে। বর্তমানে পহেলা বৈশাখের উৎসব একটি জাতীয় উৎসব। এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈশাখী মেলা বসে এবং বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। আমাদের এই পহেলা বৈশাখের উৎসবের অঙ্গীকার হচ্ছে আমাদের জীবনবোধের অঙ্গীকার। গ্রামে প্রকৃতির যে উচ্ছলতা আমরা পেতাম, শহরে তা পাই না বটে। কিন্তু পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে গেলে মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গড়তে হবে। এ উৎসবটি বর্তমানে সার্বজনীন। একবার সিলেটে এক হোটেল মালিক নববর্ষের দিনে নানা রকম মাছের রান্না দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করেছিলেন। প্রায় বার ইঞ্চি লম্বা রুই মাছের পেটি সর্ষে বাটা দিয়ে রান্না করা হয়েছিল, কাতল মাছের পেটি ছিল ততধিক বড়। ছোট-বড় আরও অনেক মাছ ছিল। তিনি তার হোটেলের বর্ডারদেরকে আপ্যায়ন করেছিলেন। এভাবেই বর্তমানে নববর্ষ উদযাপনটি আমাদের দেশীয় একটি আনন্দিত প্রথায় পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে উপহার দেয়ার রেওয়াজ এসেছে। আমাদের জীবনে আনন্দরসের আধিক্য খুব বেশি নেই। বাংলা নববর্ষে একটি নতুন আনন্দ আমাদের জীবনে আসছে এটা সত্যি উপভোগের। আমরা এ উৎসবকে কেন্দ্র করে এমন একটি নিরপেক্ষ আনন্দ নির্মাণ করতে পারি যেখানে সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারে।
ঋতুচক্রে শীতের পর বসন্ত এবং তারপর গ্রীষ্ম হাত ধরাধরি করে আসে। বসন্তের সম্ভারে গ্রীষ্মকালটিও ভরে যায়। মধ্যযুগের কাব্যে, বিশেষ করে হিন্দি কাব্যে, চৈত্র এবং বৈশাখকে বসন্তকাল বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কবি জায়সীর ‘পদুমাবৎ' কাব্যে চৈত্র ও বৈশাখ নিয়েই বসন্তের বর্ণনা এসেছে। উদ্দেশ্য হলো একথা প্রমাণ পাওয়া যে, তাপ এবং মধুরতা একই সঙ্গে বসন্তে পাওয়া যায়। বসন্তকালে বাতাসে ফুলের সুগন্ধ যেমন ধরা পড়ে, আবার রৌদ্রের তাপে মানুষ কখনো কখনো অসহায়বোধ করে। আমাদের দেশে বর্ষাকে যেমন সুস্পষ্টভাবে চেনা যায়, তেমনি বসন্তকেও সুস্পষ্টভাবে চেনা যায়। আমি এক সময় পাকিস্তানের করাচীতে ছিলাম, দীর্ঘ সাত বছর ছিলাম। প্রতিদিনই তাপ-দগ্ধতা ছিল, তাই মনে হতোপ্রতিদিনই যেন বৈশাখ মাস। আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে বলতেন ‘এ অঞ্চলে কোনো ঋতু চিনতে পারছি না। শুধু শীতকালটা কিছুটা বুঝা যায়। শীত ছাড়া সারা বৎসরটিই যেন গ্রীষ্মকাল।
মালিক মোহাম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবত' কাব্যে নাগমতী বিয়োগ-খণ্ড’ অধ্যায়ে বৈশাখ মাসে বিরহিনী নাগমতীর তাপিত অবস্থার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। বৈশাখ মাসে তাপদগ্ধতা যখন জাগে তখন তা বিরহিনীদের জন্য অশেষ দাহদায়ী হয়। নাগমতী বৈশাখের তাপ সহ্য করতে না পেরে ব্যাকুল হয়ে নিজের অবস্থা বর্ণনা করছেন :বৈশাখ মাস এসে গিয়েছে। অত্যন্ত তাপ সৃষ্টি হয়েছে। তাপ এত অধিক যে শরীরের রেশমী বস্ত্র এবং চন্দন প্রলেপনের মধ্যেও অগ্নির দাহ অনুভূত হচ্ছে। এ উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে সূর্য ত্রাণ পাবার আশায় হিমালয়ের উত্তর দিকে আপন দৃষ্টি ফিরিয়েছে অর্থাৎ সূর্যের উত্তরায়ন ঘটেছে। কিন্তু তার রথ ভুলক্রমে আমার হৃদয়েপ্রবিষ্ট হয়ে সেখানে বজ্রাগ্নি সৃষ্টি করেছে। ফলস্বরূপ আমি অধিকতর জ্বালা অনুভব করছি। হে স্বামী, আমি উক্ত বজ্রাগ্নিতে দগ্ধীভূত হচ্ছি। তুমি উপস্থিত হয়ে আমার উপর তোমার শীতল ছায়া প্রদান কর। আমি এতটা জ্বালা অনুভব করছি যে আমাকে যেন অঙ্গারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তুমি ত্বরিৎ গতিতে উপস্থিত হয়ে এই অঙ্গার নিভিয়ে দাও। তোমার দর্শন পেলেই আমি শীতল হব আমার যে শরীর বিরহঅগ্নিতে জ্বলছে, তোমার অপার স্নেহ বর্ষণ করে আমাকে রক্ষা কর এবং আমাকে পুষ্পপত্রে ঢেকে দাও। আমার হৃদয়-রূপী সরোবরের জল নিয়তই শুকিয়ে যাচ্ছে। হে স্বামী, আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, তুমি দ্রুত এসে আশ্রয় দাও। স্নেহ-বর্ষার দ্বারা আমাকে শান্ত কর, আমার শরীর-রূপী মানসসরোবরে যে হৃদয়-রূপী কমল বিকশিত ছিল তা তোমার স্নেহ-রূপী জলের অভাবে শুকিয়ে গেছে। হে প্রিয়, যদি তুমি এসে তাতে স্নেহ-জল সিঞ্চন কর, তাহলে সেখানে নতুন পল্লব অঙ্কুরিত হবে।
দেখতে পাচ্ছি যে মধ্যযুগের কাব্যে বৈশাখের তাপদগ্ধতাকে হৃদয়ের নিপীড়ন বলে কবিরা কল্পনা করতেন। পদ্মাবতের কাহিনীতে আমরা জানি যে বিবাহিত পত্নী নাগমতীকে চিতোরে রেখে রাজা রত্নসেন পদ্মাবতী লাভের আশায় সিংহলে যান। সেখানে পদ্মাবতীকে বিবাহ করে সুখে সময় কাটাতে থাকেন। এদিকে কান্ত বিরহে কাতর হয়ে নাগমতি বেদনা-ভারাতুর হৃদয়ে সময় কাটাতে থাকেন। এভাবে মাসের পর মাস পার হয়। অবশেষে বৈশাখ যখন আসে তখন নাগমতীর ব্যাকুলতা বৃদ্ধি পায়। বৈশাখ মাসে সেই ব্যাকুল অবস্থার বর্ণনা আমি উপরে পেশ করেছি।
বর্তমানকালে মানুষের জীবনে ধনী-গৃহে বৈশাখের তাপদগ্ধতা নিবারণের জন্য আমরা আমাদের গৃহে, যানবাহনে যান্ত্রিক শীতলতার একটি বাতাবরণ নির্মাণ করে থাকি। সুতরাংবৈশাখের তাপদগ্ধতা অনুভব করার সুযোগ আমাদের তেমন একটা নেই। মরুভূমির উত্তপ্ত অঞ্চলের মানুষেরা যান্ত্রিক বাতাবরণের মধ্যে থাকবার চেষ্টা করে, কিন্তু কখনও কখনও তারা প্রকৃতির যথার্থ উষ্ণতা অনুভব করবার জন্য মরুভূমিতে তাবু খাটিয়ে কিছুটা সময় অতিবাহিত করে। এ প্রথার বিশিষ্টতা কি, তা আমি জানতে চেয়েছিলাম কুয়েতে অবস্থানকালে একজন রঈসের কাছে। তিনি বলেছিলেন, প্রকৃতি আমাদের জন্য যা উপস্থিত করে তাই তো আমাদের যথার্থ প্রাপ্য। তা থেকে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করা ঠিক নয়। উষ্ণতার যে নিজস্বতা আছে তার মধ্যে বাস করার একটি শোভন গৌরব আছে। আমরা সেই জন্য বছরের কোনো এক সময়ে মরুভূমিতে গিয়ে উষ্ণতার স্বাদ গ্রহণ করি।
শান্তিনিকেতনে যখন ছিলাম তখন একবার সেখানে ওলাবাসি ওজালা নামে এক নাইজেরীয় পর্যটক এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ প্রকৃতির সবকিছুগ্রহণ করেনা, সে অনেক সময়প্রকৃতির কাছে থেকে আড়াল খোজে, কিন্তু প্রাণীকুল তা কখনও করে না। তারা প্রকৃতির সবকিছুগ্রহণ করে তার উষ্ণতা, রুক্ষতা এবং শীতলতা। সেজন্য প্রাণীদের জীবনে কোনো সংশয় নেই, কোনো দুর্ভাবনা নেই, কিন্তু সভ্যতা-আশ্রয়ী হয়ে মানুষ প্রকৃতির বদান্যতাকে ভুলতে বসেছে। অতীতের মানুষ এরকম ছিল না। প্রথম পুরুষ আদম তোপ্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে দীর্ঘকাল একাকী জীবনযাপন করেছেন। আমরা কেন তা পারব না? আমার যতদূর মনে পড়েদ্রলোক সম্ভবত প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কি এ নিয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন। মানুষের জীবনে প্রকৃতির একটি অবধারিত অবস্থান আছে। একে পুরোপুরি অস্বীকার করা চলে না। আমরা প্রকৃতির ঔদার্যের মধ্যে যেমন বাস করি, তেমনি আবার নিজেদের জীবনে কিছু যান্ত্রিক নিজস্বতাও নির্মাণ করে নিই।
ঋতু কখনও মানুষের সঙ্গে বঞ্চনা করে না। ঋতুচক্রের আবর্তনে একেক ঋতু তার নিয়ম এবং স্বভাব অনুসারে যথাসময়ে আগমন করে। শীতের পর বসন্ত আসে এবং তারপরে গ্রীষ্ম। এভাবে বর্ষা আসে, শরৎ আসে এবং হেমন্ত আসে। এভাবে আমরা আমাদের জীবনে সব কটি ঋতুরই স্পর্শ পাই। অবশ্য কোনো কোনো ঋতুকে আমরা প্রবলভাবে অনুভব করি এবং কোনো কোনো ঋতুকে লঘুভাবে। গ্রীষ্ম এবং বর্ষা আমাদের জীবনকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। গ্রীষ্মের দাবদাহে আমরা বিচলিত হই, আবার বর্ষার প্রবল বর্ষণ আমাদেরকে কখনও দুঃখিত করে, কখনও আনন্দিত করে। আমাদের অনুভূতির সকল অবস্থাকে আমরা ঋতুচক্রের মধ্যে প্রকাশ করে থাকি। আমাদের জীবনে গ্রীষ্মটি খুব প্রবল। যখন খরা জাগে তখন আমরা অসহায়বোধ করতে থাকি, কিন্তু গ্রীস্মের বদান্যতাও আছে। ফলবান বৃক্ষগুলো এসময় ফলভারে উজ্জ্বল হয় এবং একটি অদ্ভুত প্রসন্নতায় আমাদের মন ভরে যায়। পৃথিবীর সকল ফলের সম্ভার আছে। শীতপ্রধান দেশে সারা বছরই কোনো না কোনো ফল পাওয়া যায়। আমাদের প্রধান ফলগুলোগ্রীষ্মকালেই রং ধরে। বহুদিন আগে আমি যখন করাচীতে, তখন কি একটা উপলক্ষে যেন বৈশাখের শেষ সপ্তাহে রাজশাহী গিয়েছিলাম। সেখানকার দ্বিপ্রহরটি তীব্র উষ্ণতার জন্য সহ্য করতে পারিনি। সেবার আম ধরেছিল প্রচুর, পরিপক্ক লিচুরও স্বাদ পেয়েছিলাম। আমি গ্রীষ্মের তাপটি সহ্য করেছিলাম, কেননা ফলের আকক্ষাটি আমার ছিল। গ্রীষ্মে তাপিত সময় ফললাভের আকাঙক্ষাটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আমরা আকাঙ্ক্ষাকে মূল্য দেই বেশি এবং আকাক্ষা আছে বলেই আমরা অনেক কিছু সহ্য করতে পারি। আকাক্ষাথাকলে আমরা অসমাপ্ত জীবনযাপন করতাম, হতাশায় জর্জরিত হতাম এবং ভাগ্যকে মেনে নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতাম। আমাদের জীবনটি হচ্ছে আকাক্ষার বশংবদ।
গ্রীষ্মকালে প্রান্তরগুলো অনেক সময় ধূসর হয়, নদীতীরের বালিয়াড়ি এবং গুল্মহীন মাটি দূর থেকে কেমন যেন অসদ্ভাবের আভাস দেয়। সেই রুক্ষ মুহূর্তেও নানাবিধ রংএর আভাস আমরা প্রকৃতিতে পাই। সূর্যরশ্মির বর্ণবিভায় সাতটি রং সমুৎপাদিত-বেগুনী, গাঢ়-নীল, নীল-সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তুর, প্রাণীর এবং আবহের উপর আপতিত কোনও কোনও রং শোষিত হয় এবং কোনও কোনও রং প্রতিবিম্বিত হয়। প্রতিবিম্বিত রং কখনও একক এবং কখনও মিলিত। একক রং হচ্ছে মৌলিক বা প্রাথমিক রং। যেমন লাল, হলুদ এবং নীল। দ্বিতীয় কোটির রং হচ্ছে দুটো মৌলিক রংএর মিশ্রণে সৃষ্ট রং, যেমন কমলা, বেগুনী এবং সবুজ। হলুদ ও লালের মিশ্রণে কমলা তৈরি হচ্ছে, লাল ও নীলের মিশ্রণে হচ্ছে বেগুনী এবং নীল ও হলুদের মিশ্রণে হচেছ সবুজ। এছাড়া কতগুলো রংকে একে অন্যের সম্পূরক বলা হয়, যেমন লালের সম্পূরক হচ্ছে বেগুনী এবং নীলের সম্পূরক হচ্ছে কমলা। রং-এর এই যে বিভাজন এবং উদ্বেলিত বিচিত্র বিভা, তাকে অবলম্বন করেই শিল্পসত্তার জাগরণ এবং তাৎপর্য। রেখার ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টির যেমন প্রতিক্রিয়া আছে, রং-এর ক্ষেত্রে সে প্রতিক্রিয়া আরও প্রবল। আমাদের চোখের স্বভাবই এই যে সকল রং-কে সে মৌলিক বা প্রাথমিক রং -এর সঙ্গেসম্পর্কিত করে দেখে। বৈশাখে সব রং সুস্পষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু সকাল এবং বিকাল বেলা সবুজ রং চোখে পড়ে এবং কখনো কখনো কোনো কোনোফুলের লাল রঙও চোখে। পড়ে। অনুসন্ধান করলে অন্যান্য রঙও চোখে পড়বে। শীতপ্রধান দেশে শীতকালে কোনো রঙ থাকেনা। পত্রপুস্পবিহীন বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা সাদা বরফে আচ্ছন্ন হয়ে এক স্বচ্ছতা ও উজ্জ্বল্য নির্মাণ করে, যার নিজস্ব একটি মহিমা আছে। শীতের পর যখন গ্রীষ্মকাল আসে তখন চতুর্দিকের সবুজ চোখকে স্নিগ্ধ করে দেয়। শুভ্রতার পর যে সবুজ চোখে পড়ে তাকে খুব প্রবল বলে মনে হয়।
আমাদের দেশে শীত খুব প্রবল নয় এবং শীতকালে সব গাছ পাতা হারায় না। সবুজ রঙটি শীতকালেও থাকে। কিন্তু বসন্তছুঁয়েগ্রীষ্ম যখন আসে তখন গাছে গাছে নতুন পাতার সমারোহ নয়নমুগ্ধকর মনে হয়। আমি আমার বাড়ির দক্ষিণ দিকের জানালা খুলে গ্রীষ্মকালে সবুজ পাতার সমারোহ দেখি। পাতাগুলোকে আনন্দিত ও হাস্যোজ্জ্বল মনে হয়। জয়নুল আবেদীন আমাকে একবার বলেছিলেন: “আমাদের দেশে চারদিকে কত রঙ! কেউ একবার খোজ করেও দেখেনা। শিল্পীরা বিদেশী শিল্পীর রঙ নকল করতে চায়। কেন এমনটা হবে? আমাদের তো রঙও আছে, রেখাও আছে। নদীর বাঁক দেখি, গাছের ডালপালা ছড়ানো দেখি, সামনের দিকে ছড়িয়ে থাকা মাঠের পর মাঠ দেখি। এসব কিছুর মধ্যে আঁকাবাঁকা এবং সরল কত রেখাই না দেখি। আবার রঙও দেখি কত রকম। সবুজ আছে-দুটো এক রকম নয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সোনার তরী' কবিতায় কোনো রঙের ছবি আঁকেননি, ঘন বরষায় তিনি শুধু ধানের সোনালি রঙটি লক্ষ্য করতে পেরেছিলেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের কবিতায় রঙ আছে এবং প্রবলভাবেই আছে। তাঁর ‘বৈশাখ’ কবিতায় আমরা ধূসর রঙের খেলা দেখি, পিঙ্গল রঙের আভাস পাই, বৃক্ষের ছায়া দেখি এবং রক্তিম আভাকেও দেখি। অন্য একটি কবিতায় তিনি নীলাঞ্জন ছায়া’র কথা বলেছেন, সবুজ ঘাসের কথা বলেছেন। এভাবে বৈশাখের রঙ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। তবে যে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন সেই বৈশাখ হচ্ছে বীরভূম-বাঁকুড়া অঞ্চলের, তাই সেখানে তিনি ধূলায় ধূসরিত প্রকৃতি দেখেছেন বেশি। আমাদের বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বৈশাখ মাসে লাল ধূলো আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল এসব অঞ্চলে যারা থাকেন তাদের চোখে নতুন জীবনের প্রস্তাবনার মতো অনেক রঙ চোখে পড়ে।
‘মাতিস’ রঙ সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন রঙ-এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চিত্রের প্রকাশময়তাকে যতটা সম্ভব সফল করা।' প্যারিসে ফভবাদ এসেছিল প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের মতো। স্বল্পকালীন বিক্ষুব্ধ শিল্প জগৎকে চিহ্নিত করেছিল, অবিমিশ্র রঙ -এর প্রবলতায় ক্যানভাসকে আপ্লুত করেছিলেন শিল্পীরা। কিন্তু ফভবাদীদের মধ্যে বেঁচে রইলেন একমাত্র মাতিস তার প্রকাশময়তার জন্যে। আলোর অভিব্যঞ্জনা থেকে চিত্রকে মুক্ত করে, তথাকথিত বস্তুগত ব্রণসাক্ষ্য থেকে চিত্রকে অভিব্যক্তির বিভায়প্রকাশমান করে মাতিস’ জীবনকে নতুনভাবে সম্ভাষণ করলেন। মাতিসের রঙের ব্যবহার দেখে পিকাসো বলেছিলেন মাতিসের রঙ-এর ব্যবহার যেন বর্ণবিভার শ্বাস-প্রশ্বাস।'
প্রাচীন সংস্কৃত কবিদের কাছে অনুরাগেরও রঙ আছে। তারা তাদের কাব্যে রাগ এবং রঙ একাকার করেছিলেন প্রেমের বিচিত্র উদ্দীপনায়। আমি মধ্যযুগের হিন্দীকাব্য থেকে উদাহরণ দিয়েছি পূর্বে। আমি দেখিয়েছি যে একজন বিরহিনী সব কটি মাসকেই মনে রাখে, বৈশাখকেও বিশেষভাবে মনে রাখে। বৈশাখে বিরহিনীর চিত্তের দাহটি বৃদ্ধি পায়। আমরা একথা বলতে পারি যে বসন্তকালই যে প্রেম এবং বিরহের জন্যে প্রশস্তকাল তা ঠিক নয়, প্রেমের একটা রূপব্যঞ্জনা বৈশাখেও তৈরি হয়। আমি নিজে বৈশাখের জন্য অপেক্ষা করি। বৈশাখ তার সকল প্রকার কোলাহল নিয়ে যখন নিজেকে প্রকাশ করে তখন আমি তার অন্তর্গত হওয়ার ইচ্ছা করি। এই ইচ্ছাটা আমার আছে, কিন্তু এই ইচ্ছাটাকে আমি কার্যকর করতে পারি না। তবে বৈশাখ যে নববর্ষকে আনল, জীবনের প্রান্তসীমায় এসে তাকে আমি জানতে চাই।
রবীন্দ্রনাথ তার শান্তি নিকেতনে বাংলা নববর্ষকে একটি বৈদিক আবেশে আচ্ছন্ন করে দিতে চেয়েছিলেন। তাই সেখানে বেদমন্ত্র উচ্চারণের গুরুত্ব ছিল। আমাদের বৈশাখ উদযাপন হচ্ছে আমাদের দেশের মাটির কাছাকাছি আনন্দ উদঘাটন। একারণে আমাদের নববর্ষ উদযাপনটি মানুষে মানুষে সহজ মধুর সম্পর্ক স্থাপনার উৎসব। এভাবেই এ উৎসবটি ক্রমশ মূল্য পাচ্ছে এবং এ উৎসবটি একটি নিজস্ব সামাজিকতা নির্মাণ করেছে যা কোনো গোত্রের বা শ্রেণীর নয়-যা হচ্ছে সকল মানুষের।