প্রথাগত রাজনীতির বাইরে থেকে আসা যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ কিংবা সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ নতুন নয়। এ কথা বিগত দিনগুলোতে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী বিশ্ব কিংবা মুসলিম সম্প্রদায়কে পছন্দ করেন না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, ট্রাম্পের বিবেচনায় ইসলামে গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস। ইতিহাসের দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হলেও তারা কারো বশ্যতা স্বীকার করেনি।
সেটার জন্য পশ্চিমা জগতে ইসলামী ধর্মীয় শিক্ষা কিংবা মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কাছে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে দুটি। প্রথমটি হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর আর্থ-সামাজিক অবস্থা যা-ই হোক, তাদের মধ্যে একটি আপসহীন জিহাদি মনোভাব কাজ করে। এর অর্থ হচ্ছে অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও অনাচারের কাছে মাথানত না করা।
আর অন্যটি হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চলে মুসলিমদের প্রচুর খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হওয়া। ট্রাম্পের মতো পশ্চিমা জগতের প্রভাবশালী নেতাদের অনেকে মুসলিমদের জিহাদি মনোভাব পছন্দ না করলেও তাদের অর্থ-সম্পদের প্রতি দ্বিধাহীনভাবে আকৃষ্ট। সে কারণে পশ্চিমা শাসকশ্রেণি ও তাদের বিচক্ষণ জনগোষ্ঠী তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ছুটে যায় নিঃসংকোচে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প-কারখানা স্থাপনে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী আরব শাসকদের বিনিয়োগ, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম কিংবা উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় এবং এমনকি মার্কিন ট্রেজারি বন্ড খরিদ করার মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে।
সাম্প্রতিককালে একটা লম্বা সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিপর্যস্ত অর্থনীতি, বাণিজ্য ঘাটতি ও বৈশ্বিক দক্ষিণের জোট অর্থাৎ ‘ব্রিকস’ গঠনের পর বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলারের কদর কমে যাওয়াকে তারা এখন একটি অশনিসংকেত হিসেবে দেখছে। সেসব কারণেই এখন মার্কিন প্রেসিডেন্টরা যুক্তরাজ্য (ব্রিটেন) কিংবা পশ্চিমা কোনো দেশে তাঁদের বৈদেশিক সফর শুরু করার আগে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোতে ছুটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ বর্তমানে ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যা বিশ্বের সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক বেশি। অথচ নির্মম পরিহাস হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ ঋণের অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খরচ হয় মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে অর্থসম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক সাহায্য ছাড়া ইহুদিবাদী ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজার হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলা বাহিনী কিংবা ইয়েমেনের আনসারাল্লাহ সংগ্রামী শক্তির বিরুদ্ধে তাদের আগ্রাসন চালাতে পারবে না।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত ‘আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি’ (আইপ্যাক) নামক ইহুদিবাদী রাজনৈতিক লবিস্ট গ্রুপ, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রায় সাত মিলিয়ন ইহুদি নাগরিক ও তাদের ধনিক শ্রেণির চাপে কংগ্রেসের রাজনীতিক এবং এমনকি প্রেসিডেন্টও তাঁদের অস্তিত্বের সংকট উপলব্ধি করতে পারেন। মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট কিংবা বিশেষ করে রিপাবলিকান দলীয় সদস্যদের ক্ষমতা এবং অনেক সময় অস্তিত্বও নির্ভর করে উল্লেখিত প্রভাববলয়ের হস্তক্ষেপের ওপর।
এমন পরিস্থিতিতে আগামী ১৩ থেকে ১৬ মে পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। খ্রিস্টীয় ক্যাথলিক চার্চের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের কথা বাদ দিলে মধ্যপ্রাচ্য বা আরব দেশগুলোতে গমনের মধ্য দিয়েই ট্রাম্পের বিদেশ সফর শুরু হবে। এ সফর কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই অনুমেয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) কাছে অস্ত্র ক্রয় বাবদ প্রথম পর্যায়ে চেয়েছিলেন ১০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চুক্তি। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। একই ধারায় কাতার ও আরব আমিরাতের সঙ্গেও অস্ত্র ক্রয় ও বাণিজ্য বা বিনিয়োগ চুক্তি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু সমঝোতাও হতে পারে। কিন্তু লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে সৌদি আরব, কাতার বা আমিরাতের কাছে এমন কোনো উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান কিংবা সমরাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র বিক্রি বা সরবরাহ করবে না, যা ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সে কারণে সংগতভাবেই প্রশ্ন উঠছে মধ্যপ্রাচ্যে আরব রাষ্ট্রগুলোর জন্য শত্রু কে-ইহুদিবাদী ইসরায়েল, না ইরান? তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ কোনো রাষ্ট্রের কাছে উন্নতমানের অস্ত্র ব্রিক্রি করলেও চীন, রাশিয়া কিংবা তুরস্কের মতো বিশেষ কোনো প্রযুক্তি হস্তান্তর করে না। সৌদি আরব, কাতার কিংবা আমিরাত ভালো করেই জানে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের কারণে যুক্তরাষ্ট্র কোনো মুসলিমপ্রধান দেশের প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। তা ছাড়া তাদের (আরব বা মুসলিম) কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি বিশেষ অংশ যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে খরচ করবে। সে অর্থ বা তা দিয়ে কেনা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ইসরায়েল মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি, লেবাননের হিজবুল্লাহসহ অন্যদের হত্যা করবে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ পশ্চিমা বিশ্ব ফিলিস্তিন সমস্যার একটি দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান চাইলেও ইসরায়েল ফিলিস্তিনে কোনো দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতার প্রথম টার্মে এবং দ্বিতীয় টার্মের শুরুতেই মুক্তিকামী ফিলিস্তিনবাসীর যে ক্ষতি বা সর্বনাশ করছেন, তা অন্য কেউ এতটা নগ্নভাবে করেনি। ইহুদিদের বৃহত্তর স্বার্থে তিনি ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ নামে একটি সহযোগিতার চুক্তিতে আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদানের মতো রাষ্ট্রকে চাপের মুখে টেনে আনছেন। সৌদি আরব শেষ পর্যন্ত তাতে রাজি হয়নি। ধর্মীয় দিক থেকে সৌদি আরব মুসলিম (সুন্নি) বিশ্বের নেতা। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বিশ্বাস করেন, দ্বিরাষ্ট্রের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান না হলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। সে কারণে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইহুদিবাদী ইসরায়েলের স্বার্থে কোনো উদ্যোগে সাড়া দেননি। অন্যদিকে ট্রাম্প সরাসরিভাবে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি তাঁর আগের টার্মে তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস অমীমাংসিত জেরুজালেমে সরিয়ে নিয়ে গেছেন। অথচ প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হওয়ার কথা ছিল আল কুদ্স নামে জেরুজালেমে। তদুপরি ’৬৭ সালে সংঘটিত ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল কর্তৃক দখলকৃত সিরিয়ার পূর্ব গোলান হাইটসের ওপর ইহুদিবাদীদের আধিপত্যকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ট্রাম্প সেখানেই থেমে নেই। এবার ফিলিস্তিনের গাজাবাসীদের ওপর ইসরায়েলের গণহত্যার পরও তিনি গাজার অধিবাসীদের অন্যান্য প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রে সরে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি গাজা তাঁর কাছে হস্তান্তর করার কথা জানিয়ে বলেছেন, তিনি সেখানে অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরের পারে একটি প্রমোদ অঞ্চল গড়ে তুলবেন। তিনি গাজা ভূখণ্ড কিনে নিতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন নতুবা সমগ্র গাজা দখলের হুংকার দিয়েছিলেন। এর পরও প্রতিবেশী সৌদি আরব, কাতার, আমিরাত, মিসর কিংবা জর্দান কিভাবে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলে, সম্পর্ক রাখে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো ফিলিস্তিনের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে বিশ্বাস করেন না। তিনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক দিক থেকে ইসরায়েল ও ইহুদিবাদীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ অবস্থায় তাঁর সৌদি আরব, কাতার ও আমিরাত সফরকালে আরব শাসক ও নেতৃবৃন্দ যদি ট্রাম্পকে সব কিছু উজাড় করে দিয়ে দিতে চান, তাতে ইসলামী রাষ্ট্রগুলো, বিশ্ব মুসলিম কিংবা এমনকি শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের কী স্বার্থসিদ্ধি বা লাভ হবে? বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিংবা ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলকে আরো চেপে ধরতে না পারলে কিংবা চাপের মুখে রাখতে না পারলে শুধু ফিলিস্তিন নয়, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এক চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসী হামলায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ নিহত হওয়ার পরও ফিলিস্তিনি অধিকারসচেতন সংগ্রামী মানুষ ইসরায়েলের কাছে আত্মসমর্পণ না করার ঘোষণা দিয়েছে। ১৮ মাস ধরে চলা যুদ্ধ এবং দুই মাস অনাহারে থাকার পরও হামাস অর্থের বিনিময়ে আপস না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা নিরস্ত্র হবে না এবং ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চায়। পরিসমাপ্তি চায় বর্তমান যুদ্ধের। এমনকি গত মার্চ মাসে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় হামলা চালানোর পর থেকে এখনো পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সমস্যার একটি অর্থবহ ও টেকসই সমাধানে পৌঁছতে কোনো বলিষ্ঠ উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। তিনি নিজের স্বার্থ ও আগ্রাসনবাদী ইসরায়েলি নীলনকশা বাস্তবায়নেই বেশি ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে। ট্রাম্পের বর্তমান নিজস্ব স্বার্থসংশ্লিষ্ট সফর নিয়ে কিছুই বলছে না আরব রাষ্ট্রগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের শাসকদের ইসরায়েলি স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি কিংবা স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। এ অবস্থায় তারা কার স্বার্থে বাণিজ্য বৃদ্ধি করবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে? আগ্রাসনবাদী ইসরায়েলকে প্রতিরোধ এবং অবিলম্বে ফিলিস্তিনে একটি দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে যে পথ নির্ধারিত হয়েছে, সেদিকেই অতি দ্রুত এখন অগ্রসর হতে হবে। তা না করে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের সমর্থক ও মদদদাতা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাও সমীচীন হবে না। কোনো চেনা শত্রুকে বরণ করার অবকাশ নেই এখন মধ্যপ্রাচ্যে। তারা অর্থবিত্ত ও সম্পদে সমৃদ্ধ আরববিশ্বে আসে তাদের স্বার্থে; এখানকার নির্যাতিত ও মুক্তিকামী মানুষের স্বার্থে নয়।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক