বিদ্যুৎ
খাত বাংলাদেশ সরকারের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ
খাতে প্রতিবছর অনেক টাকা ভর্তুকি দেয়, তারপর ও যত দিন যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিল
বাড়ছে, সাথে যোগ হয়েছে লোডশেডিং। এসব বিষয়ে অভিযোগ করে লাভ নেই। সংশ্লিষ্ট
সংস্থার কর্মচারীরা বলছেন আমাদের করার কিছু নেই। সরকার বিদ্যুৎ বিল
বাড়িয়েছে। বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারের কোনো ত্রুটি কিংবা বিল অ্যাকাউন্টে
গরমিল আছে কিনা-এ প্রশ্নের উত্তর অস্পষ্ট। প্রিপেইড মিটার চালুর আগে আমরা
বিপদে পড়লে জরিমানাসহ কয়েক মাসের বিল এক সাথে দিতে পারতাম।
নতুন
প্রিপেইড মিটার চালুর সাথে এ সুযোগও শেষ। বর্তমানে অনেক জায়গায় বিদ্যুতের
নতুন প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে। এতে আবার নতুন ঝামেলায় পড়তে হয়েছে
গ্রাহকদের, নতুন মিটারে অগ্রিম রিচার্জ করতে হয়। হঠাৎ করে মিটারে টাকা নেই-
সাথে সাথে বিদ্যুৎও নেই, এমন অবস্থা অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়। এছাড়াও
কোম্পানিগুলো অর্থ কর্তন বিপাকে ফেলছে গ্রাহকদের। অবাক হতে হয় টাকা রিচার্জ
করার সাথে সাথে অর্থ কেটে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি
কমিশনের সিদ্ধান্ত মিটার বিতরণের সময় ৩০ টাকা ডিমান্ড চার্জ, মোট বিলের ৫
শতাংশ ভ্যাট দেওয়া বাধ্যতামূলক। উল্টোদিক হলো প্রিপেইড মিটার গ্রাহককে
প্রতি মাসে ৪০ টাকা মিটার ভাড়া দিতে হয়। আমরা প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল
দিচ্ছি কেন মিটার ভাড়া দিব এসব কথা সব গ্রাহকেরই। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির
চাপ কমাতে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে
পাইকারি ও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ। একই সঙ্গে
বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সঞ্চালন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন
মূল্যহারও বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ দাম ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই
কার্যকর হচ্ছে। তখন থেকে বিলের সঙ্গে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে ভোক্তার।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম
দাঁড়িছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা, যা আগে ৮ টাকা ২৫ পয়সা ছিল। পাইকারি পর্যায়ে গড়ে
প্রতি ইউনিটের নতুন দাম হবে ৭ টাকা ৪ পয়সা, যা আগে ছিল ৬ টাকা ৭০ পয়সা।
বিদ্যুতের
মূল্যবৃদ্ধির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নতুন করে বিদ্যুতের
মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে কম ব্যবহারকারী লাইফ লাইন গ্রাহকদের শূন্য থেকে ৫০
ইউনিট ব্যবহারকারী প্রতি ইউনিটে ২৮ পয়সা করে বাড়ে। শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট
ব্যবহারকারী একজন আবাসিক গ্রাহকের প্রতি ইউনিট প্রতি ৪১ পয়সা বাড়বে। এতে
তার মাসিক বিদ্যুৎ বিল বাবদ সর্বোচ্চ খরচ বাড়বে ৩১ টাকা। ২০০ ইউনিট
পর্যন্ত ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকের প্রতি ইউনিটে ৫৭ পয়সা খরচ বাড়বে। এতে
তার মাসিক বিল বাড়বে সর্বোচ্চ ১১৪ টাকা।
সেচ গ্রাহকদের প্রতি ইউনিটে
৪৩ পয়সা করে বাড়বে। ফলে এক হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী একজন সেচ
গ্রাহকের মাসিক সর্বোচ্চ বিল বাড়বে ৪৩০ টাকা। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির
বিষয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের তথ্য মতে এখন বিদ্যুতের
গড় উৎপাদন খরচ পড়ছে ১২ টাকার মতো আর ৭ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। চলতি বছর
বিদ্যুতের ৪৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। ধীরে ধীরে কয়েক বছর ধরে
সমন্বয় করা হবে। কম ব্যবহারকারী গ্রাহকের বিদ্যুতের দাম কম বাড়বে আর উপরের
দিকে বেশি বাড়বে।
বিদ্যুৎ বিলের প্রিপেইড মিটারের ভাড়া সরকার গ্রাহকদের
নিকট ৪০ টাকা করে নেন, এ বিষয়ে হোমনার ফতেরকান্দি বাসিন্দা হাসান ভূইয়া
তাঁর ফেইসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেন আমার ঘরে নিজের টাকায় মিটার কিনে লাগানোর
পর ও প্রতি মাসে মিটার ভাড়া দিতে হয়, অথচ আমার জমিতে তিনটি বিদ্যুতের খুটির
ভাড়া নেই। খুটির কারনে জমিতে চাষাবাত করতে সমস্যা হচ্ছে। আমাদের নিজের
টাকায় বিদ্যুতের মিটার কিনে যেহেতু মিটারের ভাড়া দিতে হয়, আমার জমির মধ্যে
বিদ্যুতের খুটির কেন ভাড়া পাব না ? তিনি বলেন হয় জমির ভাড়া দেওয়া ব্যবস্থা
নেন, না হয় মিটারের ভাড়া মওকুফ করুন।
পিডিবির কুমিল্লা থেকে জানায় যায়,
কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ¥ীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী জেলায় গড়ে
বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট। চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যায় ১
হাজার ২০০ মেগাওয়াট বা ৩০০ মেগাওয়াট। এ জন্য গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ
বেড়েছে বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ে ।
বিগত সরকারের আমলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন
সক্ষমতা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াটে। কিন্তু চাহিদা
সর্বসাকূল্যে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কম! তারপরও ঠেকানো যায়নি লোডশেডিং।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে দেশে দিনে গড়ে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট
বিদ্যুৎতের চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার
মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এতে প্রতিদিন লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় দেড়
হাজার মেগাওয়াটের মতো। বেসরকারি খাতে তেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে
বকেয়ার পরিমান বেশি থাকায় উৎপাদনে বাধা পড়ছে । এমন পরিস্থিতিতে লোডশেডিং
হচ্ছে।
দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। তবে চাহিদা মত
যোগান কখনই ছিলো না। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার
চেষ্টা ছিলো। সামিটের ভাসমান টার্মিনাল বন্ধ থাকায় সরবরাহ নেমেছে ২৬০ কোটি
ঘনফুটে। আর বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ঘনফুটে। এমন
পরিস্থিতিতে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন উৎপাদন দাঁড়িয়েছে
৫ হাজার মেগাওয়াট। যেখানে তিন মাস আগেও এখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিলো
প্রতিদিন ৬ হাজার মেগাওয়াট।
ইতিমধ্যে নবাগত বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ
সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান তাঁর এক বক্তব্যে বলেন- বিদ্যুৎ
খাতের অনিয়মের কাঠামো ভেঙে দিতে চাই। এ খাতে ঘটা অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে
কমিটি গঠন করা হবে। তিনি আরো বলেন গ্যাস ভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট সহসা
বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। রূপসা বিদ্যুৎ কেন্দ্র
স্থাপনে ৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হলো কিন্তু মানুষ এটা থেকে কোনো উপকার
পাচ্ছে না। প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে খালিশপুরে রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট
বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মিত হলেও গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না।
বাড়তি
চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে উৎপাদন করতে না পারায় উৎপাদন ঘাটতি হচ্ছে
বিদ্যুতের। এতে বিতরণ কম্পানিগুলোকে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। রাজধানীতে
লোডশেডিং না হলেও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিভাগের গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে
লোডশেডিং। দেশের ৮০ শতাংশের বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে
রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড । এই
প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ এলাকায় বর্তমানে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে।
দেশে
বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে ক্রয় চুক্তির আওতায় বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ সংস্থা ও
কোম্পানিগুলোর কাছে পাইকারি মূল্যে বিক্রি করে পিডিবি। সেই বিদ্যুৎ
গ্রাহকদের কাছে খুচরা মূল্যে বিক্রি করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের
সমিতিগুলো, ডিপিডিসি ও ডেসকোসহ ছয়টি বিতরণ সংস্থা। এই প্রক্রিয়ায় পিডিবি যে
দামে বিক্রি করে তাতে ঘাটতি থেকে যায়। আর সেই ঘাটতি সরকার ভর্তুকি দিয়ে
সমন্বয় করে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দুই বছরে বেশি সময় ধরে ভর্তুকি
অনিয়মিত হয়ে গেছে। ডলার ও টাকা সংকটের কারণে নিয়মিত অর্থ ছাড়তে পারছে না
অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে জ্বালানি বিল পরিশোধ এবং সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি।
সরকার বেশি দামে
বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার দেনায়
ডুবছে পিডিবি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি
বরাদ্দ রাখা আছে। এ অবস্থায় একটি প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। বর্তমান সরকার
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ বিভাগের দিকে নজর দেওয়ার দরকার। বিদ্যুৎ
কোম্পানিগুলো পুনর্গঠন প্রয়োজন। এখনই সময় পুনর্গঠন মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিভাগের
নৈরাজ্য থামানোর।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ,বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।