যে
অদক্ষ বা আধাদক্ষ কর্মী দেশের বাহিরে রয়েছে তার সমসংখ্যক দক্ষ কর্মী
বিদেশে পাঠিয়ে কয়েকগুণ বেশি রেমিট্যান্স পাওয়া সম্ভব। প্রায় দেড় কোটির মতো
বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে নানা পেশায় কর্মরত।
আমাদের অস্থায়ী প্রবাসীরাই যে শুধু তাঁদের অর্জিত অর্থ দেশে পাঠান তা নয়,
স্থায়ীভাবে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীরাও বিভিন্ন উপলক্ষে এবং প্রয়োজনে
দেশে অর্থ প্রেরণ করে থাকেন।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের অর্জিত
রেমিট্যান্সের পরিমাণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়। যে ২০২০ সালে দুই লাখ ১৭
হাজার কর্মী বিদেশে যান এবং দুই হাজার ১৭৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে, ২০২১
সালে ছয় লাখ ১৭ হাজার কর্মী পাঠানো হয় এবং প্রবাস আয় আসে দুই হাজার ২০৭
কোটি ডলার, ২০২২ সালে প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ১২৯ কোটি
ডলার এবং অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৬ হাজার, ২০২৩ সালে
রেমিট্যান্স আসে দুই হাজার ১৯৪ কোটি ডলার, যখন ১৩ লাখ পাঁচ হাজার কর্মী
প্রেরণের রেকর্ড সৃষ্টি হয়, ২০২৪ সালে ১০ লাখ ২১ হাজার কর্মী বিদেশে যান
এবং প্রবাস আয় যাবৎকালের সর্বোচ্চ দুই হাজার ৬৮৯ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০২৪ ও
২০২৫ সালের (চলমান) রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ
রয়েছে বলে মনে হয়। এগুলো হতে পারে বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে প্রবাসীদের
আগ্রহ বেড়েছে এবং হুন্ডির ব্যবহার কমেছে, আগের চেয়ে প্রবাসীদের আয় অর্থাৎ
বেতন-ভাতাদি বেড়েছে, দক্ষ কর্মী প্রেরণে জোর দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি।
আমাদের
নিকটবর্তী দেশ ভারতেপ্রতিবছরের বিদেশগামী কর্মীর সংখ্যা কখনো আমাদের সমান,
কখনো আমাদের চেয়ে সামান্য বেশি। ভারত ২০২১ ও ২০২২ সালে যথাক্রমে আটলাখ ৩০
হাজার ও ১৩ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছিল। অথচ ওই দুই বছর তাদের প্রাপ্ত
রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৮৬ বিলিয়ন ও ১১১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে
ভারতের রেমিট্যান্স যথাক্রমে ১২৫ বিলিয়ন ও ১২৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে। যে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে প্রতিবছর পাঠানো কর্মীর
সংখ্যার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য না থাকলেও বাংলাদেশের বার্ষিক রেমিট্যান্স
ছিল ভারতের এক-পঞ্চমাংশ। অর্থাৎ কোনো বছর কম বা বেশি কর্মী প্রেরণ করার
ওপর ওই বছরের রেমিট্যান্সের পরিমাণ নির্ভর করে না। একটি বছর সেই দেশটির মোট
প্রবাসীর সংখ্যা এবং তাদের আয়ের ওপর সাধারণত রেমিট্যান্স প্রেরণের পরিমাণ
নির্ভর করে। প্রবাসে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা সংখ্যা যত বেশি হবে, রেমিট্যান্সও
তত বাড়বে।
বিগত ১৫ বছরে বিদেশে প্রেরিত কর্মীদের কর্মদক্ষতার শ্রেণি
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে অদক্ষ বা আধাদক্ষ কর্মীদের সংখ্যা মোট সংখ্যার
৭০ শতাংশের বেশি, দক্ষ শ্রেণি ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে। যদি চিত্রটি
উল্টিয়ে দেওয়া যায় অর্থাৎ দক্ষ কর্মী ৭০ শতাংশের কাছাকাছিও নিয়ে যাওয়া যায়,
তাহলে বাংলাদেশের বার্ষিক রেমিট্যান্স বর্তমানের চেয়ে চার- পাঁচ গুণ
বৃদ্ধি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নেতাদের অনিচ্ছা, সংশ্লিষ্ট
এজেন্সিগুলোর বাধা, বিশ্ব শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরিতে
দেশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব এবং সরকারের বিদ্যমান নিয়ম- নীতি বিবেচনায়
এই বিষয়টির ইতিবাচক সুরাহা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু
ঘটাতে হলে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদ্ধতিতে যেমন পরিবর্তন আনতে
হবে, তেমনি একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মীবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যার
মধ্যে বিদেশে কর্মী প্রেরণে নিযুক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও অন্তর্ভুক্ত
করা আবশ্যক হতে পারে ।
আমরা যদি দক্ষ কর্মী পাঠানো এবং রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়াতে চাই, তাহলে আমাদের-
১.
অদক্ষ কর্মী প্রেরণ ধীরে ধীরে হ্রাস করতে হবে এবং দক্ষ কর্মী পাঠানোকে
অগ্রাধিকার দিতে হবে ২. অভিবাসী পদ্ধতি অনুসরণে বিদেশে কর্মী পাঠাতে
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যা ন্যূনতম অভিবাসন ব্যয় ও কর্মীদের
স্বার্থ নিশ্চিত হয়।৩.প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোকে উৎসাহিত
করতে হবে।৪. বাংলাদেশের সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে বিদেশে দক্ষ কর্মী পাঠাতে
উৎসাহিত করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে৫. দক্ষ
কর্মীর চাহিদা থাকা শ্রমবাজার শনাক্ত করতে হবে অর্থাৎ কোন কোন দেশে কী কী
ক্ষেত্রে কতজন দক্ষ কর্মী প্রয়োজন, সেসব তথ্য সংগ্রহ এবং প্রয়োজনে সেসব
দেশের সহযোগিতায় আমাদের কর্মীদের আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জনে পদক্ষেপ
নিতে হবে।৬. দক্ষ কর্মীদের উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র সংস্থানে বাংলাদেশের
দূতাবাসগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অবশ্যই কাক্সিক্ষত ফল পেতে হলে অধিক
আয়ের কর্মের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী সৃষ্টি এবং সুপরিকল্পিত অভিবাসন
ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে ।৭. শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশে কারিগরি শিক্ষা
অগ্রাধিকার দিতে হবে।৮. কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সেবার মান বৃদ্ধি
লাভএ
বিদেশে কর্মী প্রেরণ কোনো মানবব্যবসার খাত নয় বা ওই সব কর্মী কোনো
পণ্যও নন। তাই বিদেশে কর্মী প্রেরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও
ব্যক্তিদের, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো এবং রিক্রুটিং
এজেন্সিগুলোর মানসিকতায় পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। এজেন্সিগুলো কর্তৃক
নিয়োজিত দালালদের মাধ্যমে অভিবাসী প্রত্যাশী। কর্মীদের সংগ্রহ করার
পদ্ধতিটি শোষণের আরেক হাতিয়ার। এ ক্ষেত্রে দেশের মানুষকে, বিশেষ করে বিদেশে
কর্মপ্রত্যাশী কর্মীদের নিজেদেরও সচেতন হতেহবে।
আমাদের দেশে রিক্রুটিং
এজেন্সিগুলো বিদেশগামী কর্মীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে অনেক
বেশি অর্থ আদায় করে থাকে। এই অতিরিক্ত অর্থ খুব সহজেই বিদেশে পাচার হয়ে
যায়। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো নজরদারিআওতায় আনা যেতে
পারে। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এজেন্সিগুলোর প্রত্যেকের নামে
যেসংখ্যক কর্মীর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের কতজন বিদেশে প্রেরণ করা
হয়েছে, সে হিসাবটিও নজর করাপ্রয়োজন।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।