খাদ্যপণ্য,
ভোজ্য তেল, জ¦ালানি তেল, পশুখাদ্য ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম,
বেকারি পণ্য, শিশুখাদ্য, প্রসাধনী, খাবার পানি থেকে জীবন রক্ষাকারী ঔষধ
সবকিছুতেই মেশানো হচ্ছে ভেজাল। ভেজাল জ¦ালানি তেলের কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি
টাকার গাড়ী, লাভ ক্যান্ডি, কিটকেট, সাফারি, রোলানা, ক্যাডবেরি, ফাইভ ষ্টার
বাবলিসহ বিশ^বিখ্যাত নানা ব্রান্ডের চকলেট তৈরি হচ্ছে কেরানিগঞ্জের
জিনজিরা এলাকার টিনশেড ঘরে। শিশুদের পছন্দের এসব চকলেট হুবহু নকল করে ছড়িয়ে
দেয়া হচ্ছে সারাদেশে। তৈরি হচ্ছে জনসন এন্ড জনসন, কডমো, পন্ডসসহ বিভিন্ন
বিদেশি ব্রান্ডের কসমেটিকস, বিদেশি পাউডার ড্রিংক্স, জুস, চিপস, ডায়পারসহ
বিভিন্ন পণ্যের নকল। এছাড়া পোল্ট্রি ফার্মের ডিমে পাওয়া গেছে টেনারি
বর্জ্যরে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম, মেশানো হচ্ছে চক পাউডার বা কেলসিয়াম কার্বনেট।
মিষ্টি জাতীয় খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত রং, সোডা, সেকারিন ও মোম।
কাপড়ের বিষাক্ত রং, ইট ও কাঠের গুড়া মেশানো হচ্ছে খাবারের মসলায়। ফলমূল
দ্রুত পাকিয়ে রঙিন বানাতে কার্বাইড, ইথোফেন আর পঁচন রোধে ফরমালিন প্রয়োগ
হচ্ছে অত্যাধিক পরিমাণে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহনের কারণে প্রতিবছর দেশে ৩ লাখ লোক
ক্যান্সারে, দুই লাখ লোক কিডনী রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়বেটিসে আক্রান্ত
হচ্ছে। এছাড়া গর্ভবর্তী মা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করছেন এ কারণে।
বিদেশি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে বা উভয়ের শেয়ারে দেশে
কারখানাগুলি পণ্যসমূহ উৎপাদন করলে এ পরিস্থিতি সামলানো যায়।
বিভিন্ন
পণ্যের মোড়কে নিরাপত্তা সিল বাধ্যতামূলক হলেও সম্প্রতি একাধিক মুদি দোকানে ও
সুপারশপে দেখা যায় থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ব্রান্ডের বেবিশ্যাম্পু, বেবি
শাওয়ার জেল, বেবি অয়েল, বেবি লোশান, বড়দের হেয়ার অয়েল, শ্যাম্পু, পারফিউমের
অধিকাংশ বোতলেই নেই নিরাপত্তা সিল। এগুলোর মধ্যে বেশি নামকরা ব্রান্ডের
পণ্য যেমন আছে, রয়েছে জনপ্রিয় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জনপ্রিয় পণ্যসমূহ।
আছে আমদানি করা বিদেশি পণ্য। হাতেগোনা কিছু পণ্য বাদে অধিকাংশেরই মোড়কে নাই
নিরাপত্তা সিল বা কিডমি স্টিকার। অনায়াসেই সেসব বোতল থেকে প্রসাধনী বের
করা যায়, আবার ঠোকানো যায়, ফলে সেগুলো আসল না নকল তা যাচাইয়ের সুযোগ নাই।
দোকানদারদের
বলতে শুনা যায়, আমরাও কোম্পানীর লোক থেকে মাল কিনি। তারা এভাবেই দেয়। আসল
নকল যাচাইত আমরা করতে পারিনা। অনেক সময় ক্রেতারা এটা জিজ্ঞাসা করে।
ক্রেতাদেরকে বলতে শুনা যায়, শিশুর জন্য কিছু কিনতে গেলে আমরা সর্বোচ্চ
সতর্ক থাকি। সবসময় দেশে উৎপাদিত পণ্য কেনার চেষ্টা করি। অথচ শুধু জনসন ও
জাষ্ট ফর বেবি ব্রান্ডের বেবি শ্যাম্পুর মুখ সিল করা দেখলাম। কডোমো টপ টু
শাওয়ার জেল থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা বলা হলেও বোতলের মুখে সিল নেই।
এগুলো খিলক্ষেতের কোন ঘরের ভেতর তৈরি হয় কিনা তা কিভাবে বুঝা যাবে? এছাড়া
হেয়ার অয়েলের মুখ সিলছাড়া হয় কিভাবে? পাউরুটির প্যাকেটে মেয়াদ থাকলেও ভেতরে
ছত্রাক জমতে দেখা যায়। খেতেও তিতা স্বাদের ও কটু গন্ধযুক্ত হয়।
দোকানদারদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, বিক্রি না হওয়া পাউরুটি কয়েকদিন পরে
ফেরত নিয়ে যায়। এগুলো আবার নতুন ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে পাউরুটি বানায় কিনা কে
জানে।
ভেজাল প্রসাধনী নিয়ে চিকিৎসকরা বলেন, সাবান, শ্যাম্পু, লোশন ক্রিম
সবই বিপজ্জনক মাত্রায় মার্কারি, হাইড্রোকুইনোন, লেডসহ নানা ক্ষতিকর
রাসায়নিক থাকতে পারে। এগুলো শুধু ত্বক নয় নানাভাবে শরীরে প্রবেশ করে
গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা।
শিশুদের ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট বাধাগ্রস্থ হয়। মা ব্যবহার করলে গর্ভের শিশুর
ক্ষতি হয়। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। কিডনী, লিভার
ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এদিকে বিভিন্ন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, লাইসেন্স প্রদান ও
বাজার তদারকি করে বিএসটিআই। সেখান থেকে জানা যায়, ২৯৯ টি পণ্যের
বাধ্যতামূলক মান সনদ নিতে হয়। তাদের ভাস্যে এগুলো তারা কঠোরভাবে মনিটর করে।
বেকারি পণ্য, প্রসাধনী, শিশু খাদ্য এগুলো সবই বাধ্যতামূলক পণ্যের আওতায়
ম্যাজিষ্ট্রেট বা নিয়মিত বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। জেল জরিমানাও
চলছে। তারপরও বাধ্যতামূলক প্রসাধনীর বোতলে সিল দেয়া হচ্ছে না।
ভেজাল আর
নকলে সয়লাব দেশ। জীবন বাঁচাতে রোগীকে দেয়া ঔষধেই অনেক সময় মৃত্যু হচ্ছে
রোগীর। ফর্সা হতে ক্রীম ব্যবহার করে উল্টো ঝলসে যাচ্ছে ত্বক। বড় বড় সুপার
সপেও শ্যাম্পু, তেল, পারফিউম বিক্রি হচ্ছে কোন রকম নিরাপত্তা সিল ছাড়াই।
নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কারণে হরমামেশা ঘটেছে বৈদ্যুতিক অগ্নিদূর্ঘটনা।
খাবারে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রং ও রাসায়নিক। নিষ্পাপ শিশুর খাদ্যেও মেশানো
হচ্ছে ভেজাল। এতে স্বাস্থ্যগত ও আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
জনসাধারণ, ঘটছে অপমৃত্যু। বাড়ছে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা। বিএসটিআই থেকে
অনুমোদন নেয়ার পরও বাজারে পণ্যের মান বজায় রাখছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। তবে
এনিয়ে নেই কোন তদারকি বা বাজার মনিটরিং। মাঝেমধ্যে ভেজাল বিরোধী অভিযান
চললেও দিন দিন বাড়ছে ভেজালের বিস্তার। বিহিত ব্যবস্থা নেয়া একটি জাতীয়
জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। (সংগৃহিত)
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ