তানভীর দিপু।।
আকাশে মেঘ ঘন হলেই মন খারাপ হয় গোমতী নদীর পাড়ের মানুষের। টানা বৃষ্টি হলেই ভয় জেঁকে বসে। কয়েকমাস আগেই অতিবৃষ্টিতে ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে গোমতীর বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার ধকল না কাটতেই এবছর আবার বৈরী আবহওয়ার কবলে পড়েছে এই এলাকার মানুষ। গত কয় দিন বিভিন্ন মাধ্যমে আবহাওয়ায় পূর্বাভাস এই এলাকার মানুষকে ভারী বৃষ্টি ও নদীর পানি বৃদ্ধির কথা বলছে। আর এই বৃষ্টিপাত ও নদীর পনি বৃদ্ধির পূর্বাভাস এখন কুমিল্লার নদী পাড়ের মানুষের কাছে ভয়ের বার্তা। বেশি ভয়ে থাকেন নদীর বেরিবাঁধের ভেতরের বাসিন্দারা। তাদের ভয়, নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলে আবার না হারাতে হয় বসত ভিটা, মাথা গোঁজার ঠাঁই। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কতৃপক্ষ বলছে, আতংকিত না হয়ে- সবাইকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে সচেতন হতে হবে।
অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ী ঢলের কারনে ২০২৪ সালের ১৮ আগষ্ট থেকেই হঠাৎ বিপৎসীমার উপরে প্রবাহিত হতে শুরু করে গোমতী নদী। এতে ডুবে যায় বেরিবাঁধের সব বাড়ি ঘর- কৃষিজমি। আগাম প্রস্তুতি না থাকায় সব ফেলে প্রাণ হাতে নিয়ে বাঁধের উপর আশ্রয় নেয় হাজারো মানুষ। এরই মধ্যে ভারতে গোমতীর ডাম্বুলা বাঁধ খুলে দেয়ায় ২২ আগষ্ট রাতে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার উপরে প্রবাহিত হতে শুরু করে। নদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির কারণে বুড়িচং উপজেলার বুড়িবুড়িয়া এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে বানের পানিতে তলিয়ে যায় শতাধিক গ্রাম। প্রায় দেড় হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ডুবে যায় কৃষি জমি, ভেসে যায় ফিশারি, গবাদি পশু- হাস মুরগির খামার। তিরিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতির কথা জানায় সরকার। সেই ভয় এখনো তাড়া করে বেড়ায় এই এলাকার মানুষজনকে। ভারী বৃষ্টিপাত আর আবহাওয়ার পূর্বাভাস শুনলেই মন খারাপ হয় তাদের।
কুমিল্লার সদর উপজেলার দুর্গাপুর এলাকার গোমতীর বেরিবাঁধের ভেতরের বাসিন্দা জেলে প্রমোদ রঞ্জন বলেন, গত তিন চারদিন আগে থেকেই ফেসবুকে-খবরে শুনছি গোমতী নদীর পানি বাড়বে। এরপর থেকেই আকাশে মেঘ ধরলেই ভয় লাগে। আবার না গত বছরের মত হয়। টানা বৃষ্টি হলেই নদীর পানি বাড়বে- আর বাড়িঘর সব ডুববে।
প্রমোদ জানায়, গত বছর ভেবেছিলাম পানি অতটা উপরে উঠবে ন। কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ ঘরের ভিতরে পানি ঢুকতে শুরু করলো। বাচ্চাগুলারে নিয়া কোন রকম পাড়ে উঠেছি। বাকি সব ডুবেছিলো প্রায় ১৫ দিন। তাই এবার আগে থেকেই ভয় লাগছে।
উপকূলীয় জেলা না হওয়ায় কুমিল্লার মানুষের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার অভ্যস্ততা নেই। কিন্তু গত বছরের বন্যার আঘাত এবছর জেলায় যে কোন প্রতিকূল আবহাওয়ার খবর আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। বার বার খোঁজ নেয়া হচ্ছে নদীর পানি বাড়লো কতটুকু বাড়ছে, বিপৎসীমা ছাড়ানোর সম্ভাবনা আছে কি না।
সদর উপজেলার পালপাড়া এলাকার গোমতী পাড়ের বাসিন্দা সত্তোরোর্ধ্ব বয়সী কৃষক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, গতবার যে বন্যা হয়েছে এরকম আমার জীবনে দেখিনি। মানুষ যদি আগে জানতো তাহলে ঘরবাড়ি নিয়ে পাড়ে রাখতে পারতো। সরকারের উচিত মানুষকে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেয়া। প্রয়োজনে মাইকিং করা। সঠিক তথ্য জানলে বিপদ না থাকলে মানুষ আতংকিত হবে না।
একই এলাকার বাসিন্দা হালিমা খাতুন জানান, বন্যার পর এই বছর বাঁধ মেরামতের কাজ হচ্ছে। এটা দেখে কিছুটা হলেও সাহস পাই। আশা করি এই বছর আর বাঁধ ভাঙবে না।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান জানান, এখন যে বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করার সম্ভাবনা নেই। আতঙ্ক না ছড়িয়ে আসলে আমাদের আবহাওয়া নিয়ে সচেতন হতে হবে। আমর গোমতী নদীর বিষয়ে আপডেট রাখছি।
কুমিল্লা আবহাওয়া অফিসের প্রধান আরিফুর রহমান বলেন, কুমিল্লায় বুধ, বৃহষ্পতি ও শুক্রবার এই তিনদিনের ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ছিলো এবং বৃষ্টি হচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, আমরা কুমিল্লা যে কোন দূর্যোগ পরিস্থিতি নিয়ে প্রস্তুত আছি। খুব বেশি দুর্যোগ প্রবন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কুমিল্লায় ৫৮৬টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত থাকে সব সময়। এছাড়া গোমতীর বুড়বুড়িয়া বাঁধ মেরামত কাজ শেষ। অন্যান্য জায়গায় বাঁধ সংস্কার কাজও চলমান রয়েছে। আশা করছি, কুমিল্লার মানুষ যে কোন বৈরী পরিবেশে আগে থেকেই সতর্কতা পাবেন।