কুমিল্লা
বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) প্রতিষ্ঠার ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও স্থাপন হয়নি নিজস্ব
সাব-স্টেশন। অহরহ বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও নেই জেনারেটরের সুবিধা।
এদিকে স্বাভাবিক আবহাওয়াতেও দৈনিক সাত থেকে আট বার বিদ্যুৎ বিভ্রাট কাল হয়ে
দাঁড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থী জন্য। চাহিদার তুলনায় কম
ভোল্টেজ, ঘনঘন লোডশেডিং এবং অনির্ভরযোগ্য সংযোগে বিঘ্ন ঘটছে পাঠদান,
গবেষণা, অনলাইন ক্লাস ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়,
সমসাময়িককালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে
(নোবিপ্রবি) বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলাকালীন জেনারেটর সুবিধা রয়েছে। এছাড়াও ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় ( ঢাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি), ইসলামী
বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও কুমিল্লা
বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোনো স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ সংযোগ বা জেনারেটর ব্যবস্থা।
এরই
মধ্যে গত ২২ মে বিদ্যুৎ সমস্যার দ্রুত সমাধান ও টেকসই বিদ্যুৎ সরবরাহ
নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া গত ২৪ মে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে একই সমস্যার সমাধানে উপাচার্যের
বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।
এনিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সামান্য
বৃষ্টি বা বজ্রপাত হলেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।এই সমস্যার কারণে
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষকদের দৈনন্দিন জীবন ও
শিক্ষাকার্যক্রমে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। তাদের দাবি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ
সমস্যা নিরসন করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান।
এনিয়ে নওয়াব
ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মায়া ইসলাম বলেন, 'হলের সব
সুযোগ-সুবিধার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিদ্যুৎ। কিন্তু এখন কয়েকদিন
ধরে দেখা যাচ্ছে, খুব ঘনঘন লোডশেডিং হচ্ছে—অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা
বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে প্রায়ই হলে খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। ওয়াইফাইয়ের
অবস্থাও খুব খারাপ—বিদ্যুৎ আসলেও কানেক্ট হতে হতে আবার চলে যায়। অনেক
কোর্সের ক্লাস অনলাইনে হয়। দেখা যায় লোডশেডিং এর কারণে ভোগান্তিতে পড়তে
হয়।
বিজয়-২৪ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আদনান সাইফ বলেন,'আমাদের পড়ালেখার
বড় অংশ এখন প্রযুক্তিনির্ভর। ক্লাসে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের ব্যবহার এবং
অনলাইনভিত্তিক কোর্সের কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট আমাদের শিক্ষাজীবনে বড় বাধা
হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্লাস চলাকালে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস
নিতে পারেন না। সামান্য মেঘ বা বাতাসেই বিদ্যুৎ চলে যায়। আবাসিক
শিক্ষার্থীদের জন্য এই সমস্যা আরও ভয়াবহ—গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না
থাকায় বিশ্রাম নেওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।'
কাজী নজরুল ইসলাম হলের আবাসিক
শিক্ষার্থী মো. আরিফুর রহমান বলেন,'বর্তমানে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের হার কুবিতে
আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। একাধারে ঘন ঘন বিদ্যুৎ যায় এবং ফিরতেও সময় লাগে, যার
ফলে টার্ম পেপার, গবেষণা ও প্রস্তুতিতে বড় বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। ওয়াইফাই
রাউটার বিদ্যুৎনির্ভর হওয়ায় ইন্টারনেট সংযোগও বারবার বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। এতে
অনলাইন ক্লাস, রিসার্চ ও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে। দ্রুত
স্থায়ী সমাধানে প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।'
শুধু শিক্ষার্থীরাই
নন, শিক্ষকরাও এই একই সমস্যার ভুক্তভোগী। বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পাঠদানের
স্বাভাবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসরুম আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হলেও
বিদ্যুৎ বিভ্রাটে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার সাময়িক সময়ের জন্য অকেজো হয়ে
যাচ্ছে।
এনিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও
বিজয়-২৪ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ মাহমুদুল হাছান খান বলেন, 'কুমিল্লা
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে নানা
প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে আবাসিক হলগুলোতে বিদ্যুৎ না থাকায় পানি
সংকটের পাশাপাশি ইন্টারনেট সংযোগে সমস্যা দেখা দিচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের
দৈনন্দিন জীবন ও শিক্ষাচর্চায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।'
প্রকৌশল দপ্তর
সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে
কোটবাড়ি সাব-স্টেশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৬০০ কিলোওয়াট অনুমোদন নেওয়া
থাকলেও সর্বশেষ রেকর্ড পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৫০০ কিলোওয়াট সরবরাহ হয়েছে।
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলীর দাবি, রাইস কুকার, হিটার, ইলেকট্রিক চুলা ও
আয়রন মেশিন ব্যবহারের ফলে ভোল্টেজের সমস্যা দেখা দেয়।
এনিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার (বৈদ্যুতিক)
মো. জাকির হোসেন বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ কোটবাড়ি
সাব-স্টেশনের আওতাধীন। এই সাব-স্টেশন থেকে কুমিল্লা বার্ড, পলিটেকনিক,
ক্যাডেট কলেজ, টিটিসিসহ কোটবাড়ি এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সরবরাহ
করা হয়। ফলে সাব-স্টেশনে কোনো মেরামত কাজ বা ঝড়বৃষ্টিতে লাইনে গাছ বা
ডালপালা পড়লেই পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়।'
তিনি আরও বলেন,
'আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা রাইস কুকার, হিটার, ইলেকট্রিক চুলা ও আয়রন
মেশিন ব্যবহার করছেন, যা নির্ধারিত সার্কিট ক্ষমতার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ
টানে। এর ফলে সার্কিট পুড়ে যাওয়া বা ওভারলোড হয়ে লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ার
ঘটনাও ঘটে।'
বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'পিডিবি থেকে
আমরা বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ চাহিদা (৬০০ কিলোওয়াট) জানিয়েছি, তা পূরণ
করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবহার সর্বোচ্চ ৫০০ কিলোওয়াটের
মতো রেকর্ড করা হয়েছে। চাহিদার চেয়ে কম ব্যবহার হওয়ায় সরবরাহে ঘাটতির কোনো
বিষয় নেই।'
কোটবাড়ি সাব-স্টেশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পিন্টু বলেন,
'বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি। এখন পর্যন্ত
বিদ্যুৎ ব্যবহারে ডিমান্ড চার্জ (চাহিদা সীমা) অতিক্রম করেনি। যেহেতু
কোটবাড়ি ফিডার (সাব স্টেশন) থেকে একাধিক প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা
হয়, তাই কোথাও কোনো সমস্যা হলে অন্য সংযুক্ত স্থানগুলোর সংযোগও বিচ্ছিন্ন
হয়ে পড়ে। সম্মিলিত ফিডারে লোডশেডিংও একযোগে হয়ে থাকে।'
তিনি আরও বলেন,
'কিছু সময়ের জন্য পাঁচ-দশ মিনিটের যে বিদ্যুৎ বন্ধ থাকে, তা আসলে লোডশেডিং
নয়— এটি লাইনে সমস্যা দেখা দিলে মেরামতের প্রয়োজনেই সাময়িকভাবে সংযোগ বন্ধ
রাখা হয়।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা সাব-স্টেশন স্থাপন বিষয়ে তিনি
বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অভ্যন্তরীণ সাব-স্টেশন রয়েছে।
তবে একটি প্রধান সাব-স্টেশন স্থাপন করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে
তাদের বিদ্যুৎ চাহিদা উল্লেখ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে
হবে। এটি পুরোপুরি তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়।'
সাম্প্রতিক বিদ্যুৎ
বিভ্রাট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: হায়দার আলী বলেন,
'সাম্প্রতিক সিন্ডিকেট সভায় আমরা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে
আলোচনা করেছি। আমাদের বিদ্যুৎ সংযোগের লাইনটি বনজঙ্গল ঘেরা এলাকায় দিয়ে
এসেছে, ফলে সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।'
তিনি আরও
বলেন, 'আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মাটির নীচ দিয়ে
(আন্ডারগ্রাউন্ড) বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনের ব্যবস্থা করবো। এ বিষয়ে সরকারের
কাছে শিগগিরই লিখিত আবেদন জানানো হবে। আশা করি, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে
বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সমস্যা অনেকাংশে কমে আসবে।'
বিশ্ববিদ্যালয়কে জেনারেটর
সুবিধার বিষয়ে বলেন, 'বুয়েটে জেনারেটর সুবিধা রয়েছে, তবে এটি অত্যন্ত
ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। আপাতত আমরা এই প্রকল্পটি নিয়ে ভাবছি না।'