টুম্পা
আক্তার(২০)। দেড় বছর বয়সী এক ছেলে সন্তানের জননী। পিতা সাদ্দাম হোসেন ও
মাতা রহিমা বেগম। কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা গ্রামের
বাসিন্দা। কাজ করেন চৌদ্দগ্রাম উপজেলার একটি ইটভাটায়। টুম্পা আক্তারের মতো
সারাদেশে হাজার হাজার নারী শ্রমিক ইটভাটায় কাজ করে। প্রতি বছর পহেলা মে
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হলেও ইটভাটায় নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত মজুরি
বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। নেই মাতৃত্বকালিন ভাতা। ইটভাটায় নারী শ্রমিকদের
বৈষম্যহীন মজুরি দিতে ভাটা মালিকদের বাধ্য করতে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া
প্রয়োজন।
জানা গেছে, সারাদেশের ইটভাটা মালিকরা দারিদ্র্যতার সুযোগকে
কাজে লাগিয়ে সামান্য মজুরিতে নারী শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে। এসব
প্রতিষ্ঠানে ৯-১০ঘন্টায় একজন পুরুষ শ্রমিক ৫-৬’শ টাকা আয় করলেও নারী
শ্রমিকদের গড় আয় ১০ঘন্টায় মাত্র ২-৩’শ টাকা। এমনই দাবি ভাটায় কর্মরত নারী
শ্রমিকদের। আর ইটভাটায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করছে অসংখ্য পরিবার।
নারীদের জন্য নেই পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা। নেই ধর্মীয় ইবাদতের স্থান।
স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে নেই এসব দরিদ্র্য
নারী শ্রমিকদের কোন তথ্য। এ সুযোগে ইটভাটা মালিকরা নীরবে চালাচ্ছে নারী
শোষণ। প্রতিনিয়ত ঠকছে এসব নারী শ্রমিকরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,
প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠেন ইটভাটার নারী শ্রমিকরা। সকাল ৬টা থেকে
বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাদের। প্রতি হাজার ইট দু-চাকার ভ্যান
গাড়িতে ঠেলে চুল্লির নির্দিষ্ট এলাকায় নিয়ে যায় মাত্র ৯৫-১২০টাকায়। দু’জন
নারী শ্রমিক প্রতিদিন ৩ হাজার ইট বহন করে। গড়ে ১ জন নারী শ্রমিক ২’শ থেকে
আড়াই’শ টাকা আয় করে।
ইটভাটার নারী শ্রমিক টুম্পা আক্তার বলেন, স্বামীর
আয়ে সংসার চলে না। বাধ্য হয়ে ইটভাটায় কাজ করি। আমার কাজ-কাঁচা ইট শুকালে
দু-চাকার ভ্যানে করে চুল্লির নির্দিষ্ট এলাকায় নিয়ে যাই। এখানে আমার স্বামী
ও মা কাজ করেন। সাথে রয়েছে আমার দুই বছর বয়সী ছেলে। কাজ করার সময় ছেলেকে
ইটভাটায় খেলতে দেই। কাজের সময় বেশি পরিশ্রম হলেও ছেলের মুখ দেখে সব কষ্ট
ভুলে যাই। দেশের সব ইটভাটায় নারী শ্রমিকদের মজুরি পুরুষ শ্রমিকদের থেকে কম।
এছাড়া মাতৃত্বাকালিন কোন ভাতা নেই। সরকারের উচিত-ইটভাটায় নারী শ্রমিকদের
প্রতি বৈষম্য দূর করা।
ইফতি বেগম নামের অপর নারী শ্রমিক বলেন, সর্দার
বা মাঝি আমাদের নিয়ে আসছে ১৫ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে। ৬ মাস কাজ করলে ৩০
হাজার টাকা পাব। এর মধ্যে খাওয়া বাদ খরচ হয় অনেক টাকা। সারাদেশেই শ্রম
আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নারী ও কিশোরী শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা করে
যাচ্ছে ইটভাটা মালিকরা।
চৌদ্দগ্রামে ইটভাটা মালিক শাহাদাত হোসেন বলেন,
‘শ্রমিকদের একজন সর্দার আছে। তিনি সৃজনের শুরুতে অগ্রিম মজুরি দিয়ে
নারী-পুরুষ শ্রমিক ইটভাটায় নিয়ে আসে। পুরুষ ও নারীর মজুরি বৈষম্য হয় কিনা
আমার জানা নেই। তবে গত মাসে এক নারী শ্রমিকের ডেলিভারির জন্য ১০ হাজার টাকা
সহযোগিতা করেছি’।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শাহনাজ আক্তার বলেন,
‘মাতৃত্বকালিন ভাতার জন্য স্থানীয় বাসিন্দা হতে হবে। ইউপি চেয়ারম্যানের
মাধ্যমে আবেদন করলে মন্ত্রণালয় সেটা অনুমোদন করে। তবে ইটভাটায় কাজ করা
দূর-দূরান্তের নারী শ্রমিকরা তাদের নিজ উপজেলায় আবেদন করতে হবে। এছাড়া নারী
শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য দূরীকরণে সরকার কাজ করছে’।
চৌদ্দগ্রাম
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জামাল হোসেন বলেন, ‘পুরুষ শাষিত সমাজে
সর্বক্ষেত্রে কিছুটা বৈষম্যের শিকার। বৈষম্য দূরীকরণে নারীরাই ভুমিকা রাখতে
হবে। সরকার নারীদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করছে। এছাড়া কয়েকটি ইটভাটায়
অভিযান চালিয়ে পরিবেশ আইন অমান্যসহ বিভিন্ন অভিযোগে জরিমানা করা হয়েছে।
নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্যের কোন অভিযোগ পাইনি। কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত
সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে’।