ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ
বিভিন্ন ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার
প্রতিবাদে ছাত্রলীগের পদধারী অনেক নেতা পদত্যাগ করেছেন। এর বাইরে অনেক
কর্মী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাঁদের
সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকে কোটা সংস্কার
আন্দোলনকারীদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।
গত সোমবার রাত ১০টা থেকে গভীর
রাত পর্যন্ত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে
চারজন, শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে একজন এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে একজন পদধারী
নেতা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে
পদত্যাগ করা চার নেতা হলেন নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল শাখা ছাত্রলীগের
সাংগঠনিক সম্পাদক নুসরাত জাহান সুরভী, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল
ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. বোরহান উদ্দিন, আইন অনুষদ শাখা
ছাত্রলীগের অর্থ সম্পাদক তানভীর আহমেদ গাজী এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা
ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সামিন বখশ সাদী।
নুসরাত জাহান সুরভী
বলেন, ‘আপনিও মানুষ, আমিও মানুষ। আপনিও জানেন দেশে কী হচ্ছে। সেই মানবিক
দিক বিবেচনা করে আমি শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছি।’
বোরহান উদ্দিন
ফেসবুকে লেখেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকে ছাত্ররাজনীতির সাথে
সম্পৃক্ত ছিলাম। ছাত্ররাজনীতি ছিল আমার পছন্দের জায়গা, ভালোবাসার স্থান।
আজকের পর থেকে ছাত্রলীগের সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কেউ আমাকে ডাকবেন
না, ধন্যবাদ। দত্ত হল কারও বাপের না?’
তানভীর আহমেদ গাজী ফেসবুকে
লিখেছেন, ‘আমি একজন সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা মানুষ, রাজনীতি আমায় শোভা পায়
না। আজকের বর্বরোচিত ঘটনা আমায় সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে।’
সামিন বখশ সাদী
ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ছাত্ররাজনীতির সাথে
সম্পৃক্ত ছিলাম। ছাত্ররাজনীতি ছিল আমার পছন্দের জায়গা। কিন্তু আজকের এই
ঘটনার পর আমার মনে হয় না এ রকম কোনো কিছুর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন।
আমাকে কেউ কখনো এসবের জন্য ডাক দিবেন না। ন্যায় এবং সত্যকে তুলে ধরতে না
পারলে আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা রাখি না।’
এ ছাড়া এই
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধশত ছাত্রলীগ কর্মী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে
ছাত্রলীগের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ প্রতিবেদন
লেখা পর্যন্ত ছাত্রলীগ কর্মীদের পদত্যাগ করার ঘোষণা অব্যাহত আছে।
কোটা
সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে কুষ্টিয়া মেডিকেল
কলেজ ছাত্রলীগের পাঁচজন সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে চারজনই পদত্যাগ করেছেন।
তাঁরা হলেন ফাহমিদ হোসেন অরা, শাহাদাত হোসেন মেহেদী, জায়মা হোসেন ও নিঝুম
হায়দার। চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের ১৬
সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল কেন্দ্রীয় সংসদ।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে
শাহাদাত হোসেন মেহেদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল ঢাকার নির্মম হামলার দৃশ্য
দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছি। একটা রাজনৈতিক দলের ব্যানারে এমন হামলা হতে পারে
না। নিজের বিবেক থেকে সরে আসছি। যত দিন রাজনীতির স্বাভাবিক সুষ্ঠু পরিবেশ
না ফিরবে, তত দিন আর না।’ শাহাদাত আজ সকালে ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কার
আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘এই মিছিল ও
সমাবেশে ছাত্রলীগের আরও তিন-চারজন নেতা যুক্ত হয়েছেন।’
এদিকে গভীর রাতে
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল আবির
ফেসবুকে লেখেন, ‘এক মুহূর্ত ঘুমাতে পারলাম না। সব তির আমার দিকে তুললে,
যাঁরা জানেন, তাঁরা বিশ্বাস করিয়েন।’
এর বাইরে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট
উপজেলায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ছাত্রলীগ থেকে
পদত্যাগ করেছেন কাজী ইসহাক নামের এক নেতা। তিনি উপজেলার আলাওলপুর ইউনিয়ন
ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। সোমবার দিবাগত রাত একটার দিকে
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এ ঘোষণা দেন তিনি।
কাজী ইসহাক বলেন, ‘ছাত্রলীগের
একটা ভালো সময় ছিল এবং আমি বিশ্বাস করতাম, তারা ভালো কাজ করে, কল্যাণে কাজ
করে। দেশের জন্য কাজ করে। কিন্তু তিন বছর ধরে তাদের কর্মকা- আমার ভালো
লাগছে না। আজকের (সোমবার) কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার বিষয়টি মেনে
নেওয়ার মতো নয়। দেশে প্রশাসন আছে, তারা বিষয়টি দেখবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের
আন্দোলনে ছাত্রলীগ সরাসরি ক্ষমতা খাটাতে পারে না। যেহেতু ছাত্রলীগ
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলছে না, তাই আমি ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছি।’
কাজী
ইসহাকের পদত্যাগপত্র পাননি বলে জানিয়েছেন গোসাইরহাট উপজেলা ছাত্রলীগের
সভাপতি আজমল হোসাইন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কাজী ইসহাক দীর্ঘদিন ধরে
সংগঠনে তৎপর নন। আমরা শিগগিরই কমিটি করে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চিন্তা
করেছিলাম। সংগঠনে না থাকার পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর আছে। কিন্তু বিধি অনুযায়ী
তাঁকে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। পদত্যাগপত্র সংগঠনের কারও কাছে না পৌঁছে দিয়ে
ফেসবুকে প্রচার করা কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাজ নয়।’
জামালপুরের
দেওয়ানগঞ্জে মো. ওমর ফারুক আকন্দ নামের এক ছাত্রলীগ নেতা পদত্যাগ করেছেন।
তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি মো. ওমর ফারুক আকন্দ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সানন্দবাড়ী সাংগঠনিক থানা শাখার উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক থেকে পদত্যাগ করছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের (কোটা সংস্কার আন্দোলন) সঙ্গে একাত্মতা পোষণ
করছি। আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না।’
মুঠোফোনে মো. ওমর ফারুক
বলেন, ‘চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা আমার কাছে দুঃখজনক
মনে হয়েছে। গতকাল আন্দোলনকারীদের ওপর ন্যক্কারজনকভাবে হামলা করা হয়েছে। এতে
বহু আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা
প্রকাশ ও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদস্বরূপ আমি পদত্যাগ করেছি।
হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমি ঢাকায় থাকার কারণে জেলা ছাত্রলীগের কাছে
লিখিতভাবে পদত্যাগপত্র জমা দিতে পারি নাই। তবে আমি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছি।’
এ
ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি খাবীরুল ইসলাম খান বলেন, ‘দুই মাস আগেই
ওই কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই ছেলের কোনো পদত্যাগপত্র পাইনি।
বিষয়টি জানাও নাই।’
