৯৩
হিরোশিমার ও নাগাসাকির
পারমাণবিক বোমার বর্ষণে লাখ দুয়েকের মতো মানুষ নিহত হয়। প্রায় সবাই
অসামরিক নারী-পুরুষ, শিশু। আধ ঘন্টার হুঁশিয়ারি পেলে অধিকাংশই গ্রাম অঞ্চলে
পালিয়ে বাঁচত। কিন্তু তা হলে তো পারমাণবিক বোমা বর্ষনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ
হতো না। উদ্দেশ্যটা ছিল জাপানকে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা।
বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে জাপানের হাইকমা- নারাজ ছিলেনরাজী থাকলে
পারমাণবিক বোমাবর্ষনের আবশ্যক হতো না। হিরোশিমা ও নাগাসাকির পরেও হাইকমা-ের
মাথা নত হয় না। তারা আরো কিছুকাল যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন, যদি না স্বয়ং স¤্রাট
হিরোহিতো বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের অপমানকর সিদ্ধান্তটা নিতেন। যুদ্ধ আরো
কিছুদিন চালিয়ে জাপানের বিশেষ কোনো লাভ হতো না। সেই তো আত্মসমর্পণ করতেই
হতো। তফাৎটা এই যে বিনা শর্তে না হয়ে সেটা হতো শর্তাধীন। শর্তগুলো কি
বিজিতের অনুকূলে হতো, না বিজেতার অনুকূলঃ স¤্রাট বিশেষ কোনো প্রভেদ দেখতে
পান না। মাথা হেঁট হলো এই যা তফাৎ। তিনি দেশের স্বার্থে জাতির স্বার্থে
বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেন। সেকালে মৌর্য স¤্রাট কলিঙ্গের যুদ্ধে এক লক্ষ
মানুষের বিনাশ দেখে গভীরভাবে অনুতপ্ত হন। জয়ের আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হয়।
তিনি ছিলেন চন্ডাশোক, হলেন ধর্মাশোক। যুদ্ধবিগ্রহ বরাবরে জন্যে ত্যাগ
করলেন। সা¤্রাজ্যের প্রজাদের শান্তির বলা ভয় দিলেন।
সা¤্রাজ্যের বাইরেও
শান্তির জন্যে তৎপর হলেন। একালে সে রকম একটা সুযোগ এসেছিল আমেরিকান
প্রেসিডিন্টেরও জীবনে। হিরোশিমায় ও নাগাসাকিতে যা ঘটে তা কলিঙ্গের সঙ্গে
তুলনীয়। কলিঙ্গের যুদ্ধে শুধু নিষ্ঠুর, কারণ আহতদের সংখ্যা নিহতদের
দ্বিগুণ। আর পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে যারা নানা জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত
তাদের দুর্ভোগ এই ষাট বছরেও দূর হয়নি। পরন্তু তাদের আধি ব্যাধি সংক্রামিত
হয়েছে তাদের দুর্ভোগ এই ষাট বছরেও দূর হয়নি। পরন্তু তাদের আধি ব্যাধিতে
আক্রান্ত তাদের দুর্ভোগ এই ষাট বছরেও দূর হয়নি। পরন্ত তাদের আধি ব্যাধি
সংক্রামিত হয়েছে তাদের সন্তান সন্ততিতে। আরো কয় পুরুষ ধরে হবে তা কেউ বলতে
পারে না। যারা বেঁচে বর্তে আছে তাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি পায় না, চাকরি যদি
বা পায় বিয়ে করতে পারে না। পাছে তাদের রোগ তাদের সন্তুতির শরীরে সংক্রামিত
হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রমান স¤্রাট অশোকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঘোষণা করতে পারতেন
যে আমেরিকা আর কখনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না। তার নির্মাণ থেকে
বিরত থাকবে। সে সময় একমাত্র আমেরিকার ভান্ডারেই পারমাণবিক অস্ত্র ছিল।
সুতরাং আমেরিকার পক্ষে তেমন কোনো ঝুঁকি ছিল না। আবার লড়াই বাধলে সাধারণ
বোমাই পড়ত, পারমাণবিক বোমা নয়। ফলাফল নির্ধারিত হতো সাধারণ অস্ত্র দিয়ে বল
পরীক্ষার দ্বারা। কিন্তু পারমাণবিক বোমা যদি এক পক্ষের ভা-ারে থাকে আর সেই
পক্ষ সেটা ব্যবহার করতে চায় তা হলে অপর পক্ষ তা নির্মাণও করবে, ব্যবহারও
করবে। গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ও শক্তি বহু গুণ
বেড়ে গেছে। একটা বোমাই এখন একটা দেশকে বিধ্বস্ত করতে পারে। দু’পক্ষের বোমা
পড়ে দুটো দেশ তো বিধ্বস্ত হবেই, তেজস্ক্রিয় পদার্থ পড়ে নিরপেক্ষ দেশও ধ্বংস
হতে পারে। আর ধ্বংস হলে কেবল মানুষ নয়, পশুপাখি গাছপালা কীটপতঙ্গ প্রভৃতি
যাবতীয় প্রাণী ধ্বংস হবে। তাছাড়া পৃথিবীর উপর নেমে আসবে ধুলো বালি ঝড়ে এমন
এক অন্ধকার রাত্রি বা সূর্যের আলোকে প্রবেশ করতে দেবে না দিনের পর দিন,
মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। এর নাম পারমাণবিক শীতকাল। যদি বা কেউ বেঁচে
থাকে সে সম্বৎসরব্যাপী শীতের প্রকোপে অসুস্থ হয়ে মারা যাবে। যুদ্ধ
ব্যাপারটা এককালে বীরত্বব্যঞ্জক ছিল। বীরত্ব প্রমাণ করার বহু সুযোগ মিলত।
কিন্তু এখন যুদ্ধ বাধে তবে জনাকয়েক ডানপিটে পাইলট গোটা কয়েক পারমাণবিক বোমা
ফেলে যুদ্ধ শেষ করে দিতে পারে। তারা নিজেরাও যে বাঁচবে তা নয়। তাদের
বীরত্বের প্রশংসা করার জন্যেও আর কেউ বেঁচে থাকবে না। যুদ্ধ শেষ, মানুষ
শেষ, বীরগাথা শেষ। পারমাণবিক অস্ত্র বিনিময়ের ফলে সমুদ্রও যে উদ্বেল হবে না
তা নয়। প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ দেখে ওপেনহাউয়ার সহ¯্র সূর্যের সঙ্গে
তুলনা করেছিলেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের এমন দুর্মতি কেন হবে যে সে
বিধাতার ভূমিকা গ্রহণ করে মহাপ্রলয় ঘটাবে? প্রলয়ের পরে নব সৃষ্টির ক্ষমতা
কি তার আছে? একমাত্র বিধাতাই সেটা পারেন । যার সৃষ্টির ক্ষমতা নেই, ধ্বংসের
ক্ষমতা আছে, তাকে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দেওয়া কি নিরাপদ? অথচ তাকে নিবৃত্ত
করার জন্যে যে উপায় অবলম্বন করা হচ্ছে সেটাও তো সেই প্রলয়ঙ্কর অস্ত্রের
নিলস নির্মাণ। তোমরা হাতে যদি অ্যাটম বোমা থাকে আমার হাতেও অ্যাটম বোমা
থাকবে। তোমার হাতে যদি নিউট্রন বোমা থাকে আমার হাতেও নিউট্রন বোমা থাকবে।
ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। ইতিমধ্যে আমেরিকা, রাশিয়া ছাড়া আরো কয়েকটি নেশন
প্রকাশ্যে বা গোপনে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হয়েছে। মুখে অবশ্য বলছে,
পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারই আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার লক্ষ্য। এখন
পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের কোনো রকম নিদর্শনই আমরা কোথাও দেখতে পেলাম
না। যেটা দেখতে পাচ্ছি সেটা এই যে শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্যে কল্পিত
যন্ত্রও যুদ্ধকালে মারণ যন্ত্রে রূপান্তরিত হতে পারে। মানুষের রাসায়নিক
প্রতিভা এক মুঠো ধুলোকে এক মুঠো সোনায় রূপান্তরিত করতে না পারক এক মুঠো
ঘাতক বস্তুতে রূপান্তরিত করতে পারে। কমার্শিয়াল প্লেন হয়ে যাবে ওয়ার প্লেন।
গাড়ি নির্মাণের কারখানা হয়ে যাবে ট্যাঙ্ক নির্মাণের কারখানা। বিসুবিয়াস
আগ্নেয়গিরির উপরে সবুজ আস্তরণ। সেখানে লোকে পরম নির্ভয়ে চাষ করে। বাস করে।
বংশবৃদ্ধি করে। কিন্তু হঠাৎ একদিন বিসুবিয়াস সক্রিয় হয়। লাভাবর্ষনে মানুষের
সর্বনাশ ঘটে।
আজকের দিনের পৃথিবীও তেমনি বিসুবিয়াস আগ্নেয়গিরি।
পারমাণবিক বিস্ফোরনে এর অধিবাসীরা সমূলে বিনষ্ট হতে পারে। সকলেই জানে, অথচ
অবশ্যম্ভাবী লাভাবর্ষণকে রুখতে পারছে না। যে কোনো দিন যে কোনো একটা ক্ষুদ্র
ঘটনাকে উপলক্ষ করে মহাযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। যেমন বেধেছিল প্রথম
মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে সেরাজেভোতে অস্ট্রিয়ার যুবরাজের হত্যাকে উপলক্ষ করে।
প্রথম মহাযুদ্ধের বহু পূর্বেই টলস্টয় প্রভৃতি মনীষীরা হুঁশিয়ারি দিয়ে
রেখেছিলেন। যে মারণাস্ত্র নির্মাণের প্রতিযোগিতার নিশ্চিত পরিণাম সেইসব
মারণাস্ত্র দিয়ে পরস্পরের বিনষ্টি। কিন্তু তখনকার দিনের বুদ্ধিমানদের
যুক্তি হলো উভয় পক্ষে ব্যালান্স অব পাওয়র থাকলে কোনো পক্ষই যুদ্ধ বাধিয়ে
দেবে না। অকাট্য যুক্তি। মহাশক্তিরা কেউ যুদ্ধ বাধিয়েও দেয়নি। বেধে গেল
জনাকয়েক সার্বিয়ান সন্ত্রাসবাদীর অবিমৃষ্যকারিতায়। যুদ্ধের জন্যে সেজে
থাকলে যুদ্ধ হবেই। অস্ত্রসজ্জার ভিতরেই যুদ্ধের মূল নিহিত রয়েছে। আজকের
দিনেও একই যুক্তি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। যুদ্ধের জন্যে সর্বদা প্রস্তুত থাকাই
যুদ্ধ নিবারণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। অধিকাংশ নাগরিক মনে প্রাণে বিশ্বাস করে
যে, আমরা যদি প্রস্তুত না থাকি তবে আমরাই হেরে যাব। অতএব সর্বস্ব খরচ করে
মারণাস্ত্র বানাও। সবচেয়ে শক্তিশালী মারণাস্ত্র। যার সাহায্যে আমরাই জিতব।
এই মোহ নাৎসীদেরও ছিল। জাপানীদেরও ছিল। জার্মানরা কেবল যে হেরে গেল তা নয়,
দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। আর জাপানীরাও দ্বিধাবিভক্ত হতে পারত, যদি যুদ্ধ আরো
একমাস কি দু'মাস স্থায়ী হতো। রাশিয়া ইতিমধ্যে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
করেছিল। সে অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হয়ে জাপানের উত্তরের দ্বীপটা দখল করে
নিত। আমেরিকার পারমাণবিক বোমাবর্ষণের তাড়াহুড়ার কারণ নাকি তাই আর জাপান
স¤্রাটের সহসা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণেরও। তিনিও চাননি যে জাপান জার্মানীর
মত বিভক্ত হয়। যুদ্ধ হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়ায় জাপানের ক্ষতি যা হয়েছে লাভ হয়েছে
তার চেয়ে বেশী। সেইজন্যে জাপানীদের মনে এখন মার্কিন বিদ্বেষ নেই। মস্ত বড়ো
একটা লাভ অতি ভয়ঙ্কর সামুরাই কুলের পতন। ইতিহাসের মঞ্চ থেকে ওরা বরাবরের
মতো বিদায় নিয়েছে। সাধারণ জাপানী একটা মহৎ ভয় থেকে মুক্ত এটাও এক প্রকার
মুক্তি। জাপান তার অর্থ পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের খাতে অপচয় করেনি। সেটা
শিল্পে বাণিজ্যে ও কৃষিতে নিয়োগ করে পৃথিবীর তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত
হয়েছে। প্রতিযোগিতা আমেরিকাকেও হটিয়ে দিতে যাচ্ছে রাশিয়াকেও।
ব্রিটেন
ফ্রান্স তার তুলনায় পশ্চাৎপদ। চীনের তো কথাই নেই। তবে পশ্চিম জার্মানী তার
সমকক্ষ হতে পারে। সেও মারণাস্ত্র নির্মাণে অর্থের অপচয় করেনি। তবে সে নর্থ
আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের সভ্য। নোটের চাপে তাকেও সামরিক খাতে অর্থ
ব্যয় করতে হচ্ছে। এ নিয়ে জার্মানদের মধ্যে যথেষ্ট বিক্ষোভ। আবার যুদ্ধ
বাধলে তারাই তো হবে দাবাখেলার গুটি। তাদের দেশ আবার ধ্বংসস্তুপ হবে। অথচ
যুদ্ধের সাধ এখনো মেটেনি প্রচ্ছন্ন নাৎসীদের। লড়কে লেঙ্গে পূর্ব জার্মানী।
ওপারে ওরাও তো বলতে পারত, লড়কে লেঙ্গে পশ্চিম জার্মানী। কিন্তু ওকথা বলছে
না। ওরা হীনবল বলে নয়, ওদেরও যথেষ্ট শক্তি আছে। কিন্তু ওরা জানে যে তৃতীয়
মহাযুদ্ধে কোনো পক্ষই জিতবে না, কোনো পক্ষই হারবে না, কোনো পক্ষই
আত্মসমর্পণ করবে না, উভয় পক্ষই লড়তে লড়তে মরে ভূত হয়ে যাবে। তাদের
পারমাণবিক অস্ত্রই তাদের নিশ্চিহ্ন করবে। সেটা হলো পারস্পরিক আত্মহত্যার
অস্ত্র। ফরাসী বিপ্লবের সময় অভিজাতদের এক সুইসাইড ক্লাব ছিল। মেম্বাররা
মুখোস পরে একই মুহূর্তে পরস্পরকে গুলী করে মারতেন। যাতে বিপ্লবীদের হাতে
মরতে না হয়। একালে আমরা সেই সুইসাইড ক্লাবের নব জন্ম দেখছি। পাঁচটি নেশন
মিলে এক সুইসাইড ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই ক্লাবে প্রবেশ পাওয়া অপরের
পক্ষে বারণ। তা সত্ত্বেও কয়েকটি প্রবেশ প্রার্থীর চেষ্টার ত্রুটি নেই।
ইসরাইল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, আর্জেটাইনরা এরাও পারমাণবিক অস্ত্র
নির্মাণ করছে বলে শোনা যায়। পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ এইখানে যে ক্ষুদ্রুতর
শক্তিও নিজে মরে বৃহত্তর শক্তিকে মরণকামড় দিয়ে যেতে পারে। লেবাননে আমরা
শিয়া আত্মঘাতীদের পরাক্রম দেখে অবাক হচ্ছি। তাদের আত্মহত্যার দাপটে
ইসরাইলকে লেবানন ত্যাগ করতে হয়েছে। তাদের দাপটে মার্কিনদেরও কম ক্ষতি হয়নি।
এটা একটা নতুন রণকৌশল। তবে আত্মঘাতীরা কিছু ধরে রাখতে পারে না। তারা চরম
ত্যাগ করতে পারে ও চরম ক্ষতি করতে পারে, এই পর্যন্ত । ভাবী মহাযুদ্ধেও
সুইসাইড ক্লাবের মেম্বারা মাটির উপর বেশী দূর অগ্রসর হতে পারবেন বলে মনে হয়
না। মাটি যার দখলে আছে তার দখলেই থাকবে।
যুদ্ধের কথা না ভেবে শান্তির
কথাই ভাবতে হবে। অস্ত্রশস্ত্রের আস্ফালন ছেড়ে শান্তি বৈঠক মিলিত হতে হবে ।
নেগোশিয়েসনস চালাতে হবে। দরাদরি করতে হবে তাতে তেমন রোমাঞ্চ নেই। যুদ্ধের
মতো শান্তি রোমাঞ্চকর নয়। তবু শান্তিরই প্রয়োজন বেশী। সে প্রয়োজন ক্রমশ আরো
বাড়বে। বার বার ব্যর্থ হলেও শান্তির প্রচেষ্টাই শ্রেয়। বিধাতার
আশীর্বাদধন্য তাৎপর্যই হচ্ছে যুদ্ধে যোগ না দেবার স্বাধীনতা। শান্তির অর্থ
কী? যুগে যুগে তার অর্থ তলোয়ারকে ভেঙে লাঙল বানানো। উৎসাদন ছেড়ে উৎপাদন।
তার সঙ্গে যোগ করা যাক বন্টন । একালের মানুষ চায় সুষ্ঠুভাবে বন্টন। যাতে
সকলেই প্রয়োজনমতো ভোগ্য সামগ্রী পায়। উৎপাদনে ক্যাপিটালিস্ট কমিউনিস্ট কেউ
কারো চেয়ে কম যায় না। বন্টনের বেলাই কম বেশী। সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ না হলে এরা
যে এক হাত লড়বেই এটা একরুকম সুনিশ্চিত। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার এই লাস্ট রাউ-টা
দেখতে দুই পক্ষের দর্শকরাই উদ্গ্রীব। যেমন ছিল সেকেন্ড রাউন্ড দেখার জন্যে
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। তখনকার খেলাটা ফাসিস্ট বনাম অ্যান্টিফাসিস্ট এই দুই
টীমের মধ্যে সেবার এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। চার্চিল স্ট্যালিন ভাই-ভাই।
রুজভেল্টও ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে হাত মেলান। কে যে কার সাহায্যে যুদ্ধে জয়ী হয়
তা নিয়ে বিতর্ক আজ অবধি শোনা যায়। রুশদের মতে তারা মদত না দিলে
ইঙ্গমার্কিনরা নাৎসীদের হারাতে পারত না। ইংরেজ মার্কিনদের মতে তারা মদত না
দিলে রুশরা নাৎসীদের উপর জয় হতে পারত না। এ বিতর্ক আরো কতকাল চলবে কে জানে?
চলতে চলতে একদিন হয়তো লাস্ট রাউ- ডেকে আনবে। সেটাই কাপ ফাইনাল।
বাস্তবিক,
কার বোমা যে কার উপরে পড়বে তা কি কেউ বলতে পারে? পারমাণবিক বোমা যখন
প্রথমে পরিকল্পিত হয় তখন তার লক্ষ্য ছিল নাৎসী জার্মানী, যেখানে ইহুদীদের
উৎসাদন করা হচ্ছিল। কিন্তু সেখানে না পড়ে সেটা পড়ল জাপানের উপর, যেখানে
ইহুদীই ছিল না। মার্কিন পারমাণবিক বোমা যদিও তৈরি হচ্ছে রাশিয়ার উপর
নিক্ষেপের মানসে তবু প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জবানীতেই আমরা শুনছি।
তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যাতে স্বাধীন না হয়। আশ্চর্য
হওয়ার কী আছে মার্কিন বোমা যদি একদিন ইসরাইলক রক্ষা করতে আরবদের উপর বর্ষিত
হয়? তবে যতদূর অনুমান করতে পারি প্রথম নিক্ষেপটি রাশিয়ার জন্যেই উদ্দিষ্ট।
এক মিনিটের মধ্যেই রাশিয়া তার বদলা নেবে। সব আগে থেকে তৈরি। কাউকে কিছু
ভাববার সময় দেওয়া হবে না। কিন্তু কারো জানা নেই কার বোমাটি কোন্খানে পড়বে।
এমনও তো হতে পারে যে মস্কোর বদলা নিউ ইয়র্ক না হয়ে রোম লেনিনগ্রাডের বদলা
ওয়াশিংটন না হয়ে প্যারিস, কিয়েভের বদলা শিকাগো না হয়ে ল-ন। এসব শহরের ধ্বংস
মানে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিরই ধ্বংস। অপূরণীয় ক্ষতি। নিউ ইয়র্ক আবার
গড়ে উঠতে পারে রোম আর কখনো নয়। ওয়াশিংটন আবার গড়ে উঠতে পারে, কিন্তু
প্যারিস আর কখনো নয়। শিকাগো আবার গড়ে উঠতে পারে, কিন্তু ল-ন আর কখনো নয়।
এইখানেই ট্র্যাজেডি।