শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
১২ শ্রাবণ ১৪৩১
জনস্বাস্থ্যে রবীন্দ্র ভাবনা
অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ১:১৩ এএম |

 জনস্বাস্থ্যে রবীন্দ্র ভাবনা

রবীন্দ্র বাংলায় একটু উচ্ছাসের সুর আছে, কিন্তু দুই বাংলায় অনেক মানুষ ছিলেন এবং এখনো আছেন, যারা রবীন্দ্রদীক্ষায় দীক্ষিত, রবীন্দ্র সংস্কৃতিতে লালিত। এক সময় কেউ কেউ ভাবতেন, রবীন্দ্রনাথ পুরুষের পৌরুষকে দুর্বল করেন, তার কাছ থেকে শুধু কোমলতা আর পেলবতার পাঠ নেয় সবাই। এটা আসলে মিথ্যের নামান্তর। তার ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ গান গেয়ে বাঙালি বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত অক্লেশে নিজের ফাঁসির আদেশ শুনছেন। রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া মানে সন্যাস হওয়া নয়, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নয়, কাপুরুষতায় দীক্ষা নেয়া নয়। রবীন্দ্রপাঠ মানে হচ্ছে বৃহৎ জীবনপাঠের নামান্তর, যে প্রাণসম্পদ জীবনকে আরও প্রগাঢ়ভাবে, তীব্রভাবে অনুভব করতে শেখায়, যে জীবন ‘দুঃখ-বিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে’ ব্রতী হতে শেখায়, যে জীবন মৃত্যুকেও তুচ্ছ করতে শেখায় Ñ‘মরতে মরতে মরণটারে, শেষ করে দে একেবারে।’
আধুনিককালে অর্থনীতিবিদ স্বাস্থ্যকে মানবসম্পদে অন্তর্ভুক্ত করে, উৎপাদনের সাথে বিশেষভাবে জড়িত বলে মনে করেন স্বাস্থ্যকে। সুস্বাস্থ্যের অধিকারীরাই বেশি উৎপাদন করতে পারে এবং বেশি সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ স্বাস্থ্যকে সভ্যতা সৃষ্টির সঙ্গে অচ্ছেদ্য রূপে দেখেছেন। তাঁর মতে “শারীরিক দুর্বলতা থেকে মানসিক দুর্বলতা আসে। যার কেবল কোনরকমে বেঁচে থাকা চলে, জীবনধারণের জন্য যা দরকার তার বেশি একটু উদ্বৃত্ত হয় না, তার প্রাণে বদান্যতা থাকে না। প্রাণের বদান্যতা না থাকলে বড়ো সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারে না। যেখানে প্রাণের কৃপণতা, সেখানে ক্ষুদ্রতা আসবে।” তাই পল্লী সমাজকে স্বনির্ভর ও সমগ্র করে গড়ে তোলার জন্য স্বাস্থ্যকে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়েছেন এবং নিছক সম্পদ সৃষ্টির তাড়নার চেয়েও স্বাস্থ্যকে কবি সমাজ সভ্যতা গড়ার মত মহৎ, আরো বিস্তৃত প্রাঙ্গণে নিয়ে এলেন।
রবীন্দ্রনাথ মানবতাবাদী, অনন্য সাধারণ তাঁর মানবিকতা। তিনি অজানা পথচারীকে ঘরে এনে যেমন চিকিৎসা করেছেন, তেমনি শিলাইদাহে-পূন্যাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা হেমন্তচন্দ্র বিদ্যারতœকে রাত জেগে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছেন। নিজের জমিদারি অঞ্চলে কলেরা দেখা দিলে তিনি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রও খুলেছেন। কিন্তু মানুষের স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা নিয়ে কবির চিন্তার মূলে শুধু এ সুস্পষ্ট অভিমত যে, এ বিষয়টি সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পল্লী প্রকৃতি দেখে তিনি মুগ্ধ, আবার তার অসহায় রোগজীর্ণমূর্তিতে তিনি ব্যাথিত। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীকে তিনি লিখেনÑ “যখন গ্রামের চারদিকের জঙ্গলগুলো জলে ডুবে পাতালতা গুল্ম পারতে থাকে, গোয়ালঘর ও লোকালয়ের বিবিধ আবর্জনা চারিদিকে ভেসে বেড়ায় পাট পচালির গন্ধে বাতাস ভারাক্রান্ত, উলঙ্গ পেটমোটা সরু রুগ্ন ছেলেমেয়েরা যেখানে সেখানে জলে কাঁদায় মাখামাখি ঝাঁপাঝাঁপি করতে থাকে, মশার ঝাঁক স্থির জলের উপর একটি বাস্পস্তরের মত ঝাঁক বেঁধে ভেসে বেড়ায়, গৃহস্তের মেয়েরা ভিজে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বদলায় ঠান্ডা হওয়ার বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে জল ঠেলে ঠেলে সহিষ্ণু জন্তুর মত ঘরকন্নার নিত্যকর্ম করে যায় Ñতখন সে দৃশ্য কোনমতেই ভাল লাগে না।” কবি কিন্তু মানুষের এ দূরবস্থার জন্য প্রকৃতিকে দায়ী করেননি। সমাজ জীবনে রন্ধ্রে রন্ধ্রে এ অস্বাস্থ্যের কারণ লুকিয়ে আছে। ১৯২৩ সালে কলকাতায় ম্যালেরিয়া নিবারণী সভায় রবীন্দ্রনাথ সমাজ জীবনের প্যাটার্নের সাথে স্বাস্থ্যের সমস্যাকে যুক্ত করে বক্তব্য পেশ করেন।
কলেরা-গুটিবসন্ত-প্লেগ যেন ক্রমাগত ভারতবর্ষকে তাদের স্থায়ী এক ভয়ঙ্কর লীলাক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছিল। কবির মনে হয়েছিল মৃত্যু যেন এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে প্রাণকে ব্যঙ্গ করছিল। মৃত্যু ঘটতো, ব্রিটিশ শাসনে, জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ ৫ বছর পার হওয়ার আগেই। ২০ বছরের পর ৫০ শতাংশ আর ৬০ বছরের পর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেঁচে থাকত। কবি ‘মৃত্যু জর্জরিত’ এবং ‘মৃত্যুতাড়িত’ সময়কে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং মৃত্যুর এ ভয়ঙ্করতা রোধ করতে তিনি আধুনিক ভারতের নেতৃবর্গের মতো বক্তৃতা মঞ্চে তাঁর ইতিকর্তব্য সারেননি। তিনি অস্বাস্থ্যের করাল রূপ শিলাইদহ, পতিসর থেকে বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে দেখেছেন এবং এর কারণ অনুসন্ধানে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছিল Ñএ মৃত্যু কেবল গ্রামের মানুষের অশিক্ষা ও অজ্ঞাতাজনিতই নয় Ñতীব্র ঔপনিবেশিক শোষণই প্রধানত এর গোড়ায় ছিল।
রবীন্দ্রনাথ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে একটা পরিচিতি লাভ করেন তাঁর পরিবার ও প্রজাদের সীমিত গন্ডির মধ্যে এটা কবির একটা প্যাসনের মত ছিল। কিন্তু এ চিকিৎসক হয়েই তিনি গ্রামীণ মানুষের দূর্বিসহ অসহায় জীবনটিকে মর্মে উপলব্ধি করলেন এবং আরও উপলব্ধি করলেন যে, এ ভয়ানক রোগগুলির বিস্তার ভারতবাসীর অশিক্ষা-অপরিচ্ছন্নতা থেকে মাত্র নয় এবং ভারতবাসীর দারিদ্রের কারণও তাদের অপরিণামদর্শিতা ও অত্যাধিক জনসংখ্যা নয়, যা ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে উপর তলার কিছু স্বদেশি বিশিষ্টজনদেরও যুক্তি ছিল।
রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণের পর একটি চিঠিতে ভারতে জনবিস্ফোরণ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন Ñ“কথাটার ভিতরকার ভাবটা এই যে, বাহির থেকে যে শোষণ চলছে তা দুঃসহ হত না। যদি স্বপ্ন অন্ন নিয়ে স্বপ্নলোকে হাঁড়ি চেঁচে পুছে খেত।” কবি জনবিস্ফোরণের তত্ত্ব খারিজ করেন ১৮৭১ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড ও ভারতবর্ষের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার উল্লেখ করে। ঐ সময়ের তথ্য বলছে যে, ভারতে যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩৩ শতাংশ ইংল্যান্ডে প্রজা বৃদ্ধির হার তখন ভারতের দ্বিগুণ ৬৬ শতাংশ। অথচ বিপুল জনবিস্ফোরণ সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের জনজীবন ছিল স্বচ্ছন্দ।
১৯২২ এ রবীন্দ্রনাথ যখন এ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির কাজে নামেন, ব্রিটিশ শাসকরা তখন কেবল নিজেদের এবং খুব বেশি হলে সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্য নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে Ñগ্রামের ত প্রশ্নই আসে না। তবুও ১৯ শতকের শেষে তারা কিছুটা নজর দেয় জনস্বাস্থ্যের দিকে এবং উপলব্ধি করে যে, শ্রমিক ও বৃহত্তর সমাজ এবং তার পরিবেশসহ সুস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা না হলে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ক্রমোন্নতি সম্ভব নয়। তাই রবীন্দ্রনাথকেও ব্রিটিশ শাসনে ‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই’ বলে চিৎকার করতে হয়েছে। যেমন আজও ভারতবাসীকে কবির মৃত্যুর পর সুস্থ-সবল জীবনের জন্য দাবির মিছিলে পা মেলাতে হচ্ছে। রাষ্ট্র কয়েকজন শাসকের নয়, রাষ্ট্র দেশবাসীর। তাই মহামারীর কাল সমুদ্র পার হতে- মাভৈঃ বলে তরি ভাসাতেই হবে সকলের সম্মিলিত শক্তিতে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ












সর্বশেষ সংবাদ
শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি
অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করুন : প্রধানমন্ত্রী
গ্রেপ্তার বাড়ছে কুমিল্লায়
চিরচেনা রূপে অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
আহতদের চিকিৎসা ও রোজগারের ব্যবস্থা করবে সরকার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
শিক্ষার্থীদের আমি রাজাকার বলিনি, বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
কুমিল্লায় আট মামলায় গ্রেপ্তার দেড় শতাধিক
আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
গ্রেপ্তার বাড়ছে কুমিল্লায়
অফিসে হামলার সময় চেয়ে চেয়ে দেখলেন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২ | Developed By: i2soft