ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
কুমিল্লায় সম্পত্তির লালসায় নিজ কন্যাকে খুন!
জহির শান্ত / রণবীর ঘোষ কিংকর ||
Published : Friday, 8 October, 2021 at 12:00 AM, Update: 08.10.2021 1:01:45 AM
কুমিল্লায় সম্পত্তির লালসায় নিজ কন্যাকে খুন!
কুমিল্লার চান্দিনায় সম্পত্তির লালসায় প্রতিপক্ষ ভাতিজাদের ফাঁসাতে নিজ কন্যাকে খুন করেছে পিতা ও অন্যান্য স্বজনরা। গত ২ অক্টোবর গভীর রাতে চান্দিনা উপজেলার গল্লাই ইউনিয়নের বসন্তপুর ভূইয়াপাড়া গ্রামে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার কিশোরী মেয়েটির নাম সালমা আক্তার। সে ওই গ্রামের সোলেমান মিয়ার কন্যা। হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে লাশ ক্ষতবিক্ষত করে পুকুরে ফেলে দেয়া হয়। মামলা করা হয় প্রতিপক্ষ ভাতিজাদের বিরুদ্ধে। এখানেই শেষ নয়। পরবর্তীতে ঘটনার সুচারু নাট্যরূপ দিতে নিজের গলাতেই ছুরি চালিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে হাসপাতালে ভর্তি হন সোলেমান। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। কিশোরী সালমা হত্যাকাণ্ডের চারদিনের মধ্যেই মূল রহস্য উদ্ঘাটন করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় এ ঘটনায় জড়িত থাকা ৭ জনের মধ্যে দুই জনকে। বাকিরাও আছে পুলিশের কড়া নজরদারীতে। বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম. তানভীর আহমেদ।
এ হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন হওয়ার পর স্তম্ভিত হয়ে পড়ে চান্দিনার গল্লাই ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামসহ গোটা এলাকা। আর পুলিশ বলছে, সম্পত্তি পেতে আপজনকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা খুব কমই ঘটে। এ ঘটনাটি অত্যন্ত জঘণ্য ও মর্মান্তিক।
জানা যায়, বসন্তপুর গ্রামের সোলেমান ব্যাপারীর সাথে দীর্ঘদিন যাবৎ জমি সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল তার আপন ভাতিজা শাহজালাল ও শাহ কামাল এর সাথে। তাদের ওই সম্পত্তি একাধিকবার দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন সোলেমান। ওই ঘটনায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়। এতে সোলেমান এর স্ত্রী সামান্য আহত হওয়ায় থানায় মামলা করেন সোলেমান। কিন্তু ওই মামলায় হত্যা চেষ্টার ধারা-৩২৬ যুক্ত না হওয়ায় আইনজীবির পরামর্শে ভাতিজাদের ফাঁসাতে নিজেদের পরিবারের কাউকে নিজেরাই গুরুতর আহত করে হত্যা চেষ্টা মামলার পরিকল্পনা করেন। ওই পরিকল্পনায় অবশেষে নিজের মেয়েকেই হত্যা করেন পাষন্ড পিতা।
সোলেমান ব্যাপারীকে সহযোগিতা করেন তার আপন দুই ভাই মো. আব্দুল বাতেন ও লোকমান, সোলেমান ব্যাপারীর উকিল শ্বশুর একই গ্রামের আব্দুর রহমান, তার এক বন্ধু মো. খলিল, সহ আরও ২জন। ওই সাতজনের পরিকল্পনায় গত ১ অক্টোবর বিকেলে সোলেমান তার স্ত্রী ও বড় মেয়েকে হাসপাতাল থেকে শ্বশুর বাড়ি চান্দিনার রাণীচরা গ্রামে পৌঁছে দিয়ে আসেন। দুই ছেলে ঢাকার একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করার সুবাদে সেই রাতে বাড়িতে ছিলেন সোলেমান ও তার ছোট মেয়ে সালমা আক্তার (১৪)।
কুমিল্লায় সম্পত্তির লালসায় নিজ কন্যাকে খুন!১ অক্টোবর (শুক্রবার) সন্ধ্যার পর পিতা সোলেমান ব্যাপারী ও তার মেয়ে সালমা রাতের খাবার শেষে মেয়েকে ঘরে রেখে বাহির হয়ে যান সোলেমান ব্যাপারী। ওই রাতে উকিল শ্বশুর আব্দুর রহমান এর ঘরে হত্যার পরিকল্পনা করে গভীর রাতে বাড়িতে এসে মেয়েকে শ্বাসরূদ্ধ করে হত্যার পর মরদেহ ঘর থেকে বের করে গলা কেটে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথারী কুপিয়ে মরদেহ পাশের একটি পুকুরে ফেলে দেয়। ভাতিজাদের উপর দোষ চাপাতে রাতেই ঘরের পিছনের টিন ও সামনের দরজা খুলে ফের আব্দুর রহমান এর বাড়িতে চলে যান সোলেমান। ওই ঘটনায় পরদিন ভাতিজাসহ ১০জনের নাম উল্লেখ করে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন সোলেমান ব্যাপারী। ওই মামলার পর থেকে এলাকা ছাড়া মামলার আসামীরা।
এদিকে, হত্যাকান্ডের ঘটনার পর থেকেই রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পুলিশ। পুলিশী তদন্তের তীর যখন পিতা সোলেমান ব্যাপারীর দিকে ছুটে তখন পুলিশের সন্দেহের বিষয়টি আঁচ করতে পারেন সোলেমান ব্যাপারী।  তদন্ত কর্মকর্তা গত ৪ অক্টোবর (সোমবার) স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ইসমাইল হোসেনকে ফোন করে মামলার বাদী সোলেমানকে নিয়ে সন্ধ্যায় থানায় আসার জন্য বললে ওইদিন সন্ধ্যার পর থেকে নিখোঁজ হন সোলেমান। সোলেমান এর পরিবারও থানায় ফোন করে নিখোঁজের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সোলেমান নিখোঁজের ঘটনায় পুলিশও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন।
পরদিন ৫ অক্টোবর (মঙ্গলবার) ভোরে বাড়ির পাশের একটি বাগানে গলায় ও দুই পাশে ছুরিকাঘাত অবস্থায় পাওয়া যায় সোলেমান ব্যাপারীকে। আহত সোলেমান ব্যাপারী পুলিশকে জানায়, তার ভাতিজরাসহ অন্যান্য আসামীরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু ওই ঘটনায় পুলিশের সন্দেহ আরও ঘনিভূত হয়। সিনিয়র অফিসারদের সাথে নিয়ে চলে তদন্তের গভীরতা।  এক পর্যায়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়ে বুধবার (৬ অক্টোবর) আব্দুর রহমান ও খলিলকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে কিশোরী সালমা হত্যাকান্ড এবং পুলিশের সন্দেহ এড়াতে সোলেমান এর গলায় ছুরিকাঘাত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন তারা। পরে রাতেই বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেয় আটক আব্দুর রহমান ও খলিল মিয়া।
চান্দিনা থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আরিফুর রহমান জানান, সোলেমান ব্যাপারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় তাকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। তবে আমাদের পুলিশের নজরদারীতে রয়েছে।
মামলার বিষয়টি জানতে চাইলে ওসি আরও বলেন, যাদেরকে আটক করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা গ্রহণ করা হবে। নিহত সালমা আক্তার এর পিতা সোলেমান ব্যাপারী বাদী হয়ে যে হত্যা মামলা করেছেন সেই মামলায় প্রতিপক্ষ কাউকে হয়রানি করা হবে না এবং ওই মামলার বিষয়ে সিনিয়র অফিসার ও বিজ্ঞ আদালতের পরামর্শক্রমে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আফজাল হোসেন ও চান্দিনা থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আরিফুর রহমান। লোমহর্ষক ওই ঘটনার বিবৃতি দিতে গিয়ে শিউরে উঠেন পুলিশ কর্মকর্তাও।