আজ সেই ইতিহাসের কালো
একদিন,------ ৯ই জুন। ২০০৬ সালের এই দিনে গুয়ানতানামো কারাগারে ঝরে গিয়েছিল
তিনটি প্রাণ, যার একটি ছিল অপরিস্ফুট মুকুল, মাত্র ২১ বছর। ফোটার আগেই যে
হারিয়ে গেল বিস্মৃতির কৃষ্ণগহ্বরে। এদের এখন আর কেউ স্মরণ করে না, এদের
নিয়ে কেউ শোকগাথা রচনা করে নি, পালন করাও হয় না প্রয়াণ দিবস, ঁহবিঢ়ঃ,
ঁহসড়ঁৎহবফ ধহফ ঁহংঁহম----- এদেরই একজনের স্মৃতিচারণ করছি আজ....
গরাদের
ফাঁক দিয়ে দেখা যায় চাদর জড়িয়ে ছেলেটি শুয়ে আছে। নিত্যিই থাকে, কখনো শুয়ে,
কখনো বসে দীর্ঘ গ্রীষ্মের অসহনীয় দিন কিংবা শীতার্ত রাত কাটায় কিশোর
ছেলেটি। লোহার জালে ঘেরা ছোট্ট ঘরটিতে রাখা আছে দুটোবালতি, একটিতে গা, হাত
পা ধোয়ার কাজ চলে, অন্যটি প্রাকৃতিক প্রয়োজনে। নামাজের সময় হলে মেঝের ওপর
একটা তোয়ালে বিছিয়ে সেরে নেয় প্রার্থনা।
কমলা রঙ্গের ঢিলেঢালা
জামাপ্যান্ট পরা, পায়ে বেঢপ স্যান্ডেল, বেড়ি পরানো---- এ নিয়েই প্রশ্নোত্তর
পর্ব বা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরুতে হয়। লোহার জলে ঘেরা ছোট্ট ঘরটিতে
গরমে ফুটতে থাকা অসহনীয় উত্তাপে ছোট্ট ছেলেটি দরদর করে ঘামতে থাকে।
কিশোরটির
নাম ইয়াসির তালাল আল জাহরানি। জন্ম সৌদি আরবে ১৯৮৪ তে । বাবা ছিলেন
সেখানকার পুলিশ ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল।
সম্ভ্রান্ত স্বচ্ছল পরিবারের সযত্নে লালিত সন্তান, ধনাঢ্য পরিবারের আরাম
আয়েশ ছেড়ে ছোট্ট একটি ছেলে বোঝা গেল না কেমন করে হারিয়ে গেল বিপন্ন আদর্শের
অনিশ্চয়তায়। ষোল বছর বয়সে হাই স্কুল শেষ না করেই ইয়াসির চলে যায়
আফগানিস্তানে, সম্ভবতঃ তালেবানদের সঙ্গে কাজ শুরু করে এবং ২০০২ সালে
পাকিস্তানে ধরা পড়ে। পাকিস্তান থেকে তাকে নিয়ে আসা হয় আফগানিস্তানে। অঃ ঃযব
ঃরসব ড়ভ যরং পধঢ়ঃঁৎব, অষ-ঔধযৎধহর ধিং রহরঃরধষষু, ংঁংঢ়বপঃবফ ড়ভ নবরহম “ধ
ভৎড়হঃ ষরহব ভরমযঃবৎ ভড়ৎ ঃযব ঞধরনধহ,” ঃযড়ঁময যব ধিং ষধঃবৎ পড়হংরফবৎবফ
“ঝবপড়হফ ষরহব”. তাকে সন্দেহ করা হয় অস্ত্র সরবরাহের অপরাধে।
এই
আফগানিস্তানেই কালা-ই-জঙ্গি দুর্গটি কুখ্যাত ছিল। এই দুর্গ ১৯৮৯ এ আব্দুর
রহমান তৈরি করেছিলেন। ১২ বছর পরিশ্রম করে ১৮০০০ শ্রমিক এই দুর্গ নির্মাণ
করে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী এর নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯৯৪ - ২০০১
কালা-ই-জঙ্গি দুর্গ তালেবানদের দখলে ছিল,কিন্তু ২০০১ এর নভেম্বর ২৫ থেকে
ডিসেম্বর ০১ পর্যন্ত আফগানিস্তান থেকে ‘তালেবান ইসলামিক আমিরাত’ উৎখাতের
জন্য এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লব ঘটে যায়। এই বিদ্রোহে অন্তত: ৪৭০ জন হত হয়।
কালা-ই-জঙ্গি
গণহত্যা----- এতে শত শত বিদ্রোহীদের বোমা মেরে, গুলি করে, পুড়িয়ে এবং
ডুবিয়ে হত্যা করে আমেরিকান এবং আফগান সৈন্য। এই যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর
নিহতদের মধ্যে ছিলেন জনি মাইক স্প্যান নামে এক ঈওঅ এজেন্ট, ৩২ বছরের এক
তরুণ, তিন সন্তানের বাবা, যিনি অন্যদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ দেন।এই
ঈওঅএজেন্টকে হত্যার দায়ে ইয়াসিরের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। অত্যন্ত
বিপদজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে অতএব কিশোর ছেলেটিকে চালান করা হয় কিউবার
গুয়ানতানামো ডিটেনশান ক্যাম্প কারাগারে। তখন তার বয়স মাত্র ১৭ এবং অন্তরীন
বন্দী নং ৯৩।
এই কুখ্যাত কারাগারটি কিউবার এঞগঙ ইধু ন্যাভাল বেসে।
আমেরিকার নৌবাহিনী আছে এর পরিচালনার দায়িত্বে। টঘ বিশেষজ্ঞরা এই কারাগারকে
অভিহিত করেছেন “ধং ধ ংরঃব ড়ভ ঁহঢ়ধৎধষষবফ হড়ঃড়ৎরবঃু ধহফ ংধরফ রঃং পড়হঃরহঁবফ
ড়ঢ়বৎধঃরড়হ ধিং ধ ংঃধরহ ড়হ ঃযব টঝ মড়াবৎহসবহঃ’ং পড়সসরঃসবহঃ ঃড় ঃযব ৎঁষব ড়ভ
ষধ”ি.
এই কারাগারে সারাদিন কোরআন পড়ে কেটে যায় ইয়াসিরের, পুরো
কোরআন শরীফ মুখস্থ করার ইচ্ছে। মাঝে মাঝে মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে “হাঙ্গাঁর
স্ট্রাইক” করে সকালের বা দুপুরের খাবার ফিরিয়ে দেয়। না খেলে মরে যেতে পারে
এই মর্মে কারারক্ষীরাও তাকে দিয়ে কাগজ সই করিয়ে নেয়। কিন্তু এ সবই ছিল তার
বালখিল্য ছেলেমানুষি। তখন পর্যন্ত ইয়াসিরের মরার ইচ্ছেই ছিল না।
গুয়ানতানামো থেকে ইয়াসির তার বাবা মাকে চিঠি লিখেছিল, বলেছিলঃ ‘আমি ভালো
আছি, আমার জন্যে চিন্তা করো না। আল্লাহ মহান, বাবা-মার প্রতি কর্তব্যপরায়ণ
ছেলেকে আল্লাহ অবশ্যই পুরস্কৃত করেন।’ অন্য বন্দীদের সঙ্গে গল্প করত সে তার
বাবা মাকে কতটা ভালোবাসে। ওরা এখন অনেক দূরে, তবুও পরিবারকে নিয়ে অনেক
গর্ব ছিল জাহারানির।
জানুয়ারি মাস ২০০২ সালে গুয়ানতানামো কার্যকরী হওয়ার
পর ৪১টি আত্মহত্যা প্রচেষ্টার ঘটনা ঘটে। অনশন করার মত এটাও ছিল কারা
কর্তৃপক্ষকে উত্ত্যক্ত করা অথবা মনোযোগ আকর্ষণ। ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা
নিষিদ্ধ। কিন্তু জিহাদীরা এর জন্যে একটা অজুহাত খাড়া করে নিয়েছিল। ধর্ম
কায়েম করার জন্য প্রাণ দেওয়া পুণ্যের কাজ, গৌরবের কাজ। শুধু আদর্শ নয়,
প্রচলিত পুরনো বিশ্বাসও কাজ করছিল যে, তিনজন বন্দী যদি একসঙ্গে আত্মহত্যা
করে তাহলে বাকি সমস্ত বন্দীরা মুক্তি পাবে। একই দিনে অর্থাৎ ২০০৬ সালে
জুনের ৯ তারিখ গুয়ানতানামো কারাগারে একইসঙ্গে তিনজন বেছে নিল আত্মহননের পথ।
মধ্যরাতে বাইরে থেকে সেলের ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল, জাহরানি তার বিছানাটা
পরিপাটি করে গোছালো যেন সে ঘুমুচ্ছে। তারপর গলায় দড়ি ঝুলিয়ে, মুখে কাপড়
গুঁজে, নিজেদের হাত বেঁধে ঝুলে পড়ল তিনজনেই। বিছানার চাদর থেকে তৈরি করা
মজবুত দড়ি ভালোভাবেই সাহায্য করেছিল ওদের।
ইয়াসিরের মৃত দেহ যখন তার
পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তখন শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন ছিল, আর দেহের
বিভিন্ন অঙ্গের সঙ্গে গলার কিছু অংশও ছিল অনুপস্থিত। ইয়াসিনের দুই দফা
ময়নাতদন্ত হয়, কিন্তু কোন বারই তার বাবার হাতে সেই রিপোর্ট পৌঁছয়নি।
যদিও
মানবিক অধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদে স্বোচ্চার হয়েছিল যে এই
তিনজনের মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা নয় বরং শারীরিক নির্যাতন। ঈঅএঊ নামক
সংস্থার কর্মধার মোয়াজ্জেম বেগ ইয়াসিরের বাবাকে যখন সমবেদনা জানিয়েছিলেন
তিনি বলেছিলেন: “ও ধস হড়ঃ ঁহযধঢ়ঢ়ু, হড়ৎ ফড় ও হববফ পড়হফড়ষবহপবং. গু ংড়হ ধহফ
যরং পড়সঢ়ধহরড়হং বিৎব ঃযব ারপঃরসং ড়ভ ধনঁংব ধহফ ঃযবু ফরবফ ভড়ৎ ঃযবরৎ
নবষরবভং. ঞযবৎবভড়ৎব ঃযবু ধৎব সধৎঃুৎং ধহফ ধৎব রহ চধৎধফরংব রহংযধঅষষধয.”
ইয়াসিরদের
সম্পর্কে জবধৎ অফস. ঐধৎৎু ঐধৎৎরং মন্তব্য করেছেন “ঞযবু ধৎব পৎবধঃরাব, ঃযবু
ধৎব পড়সসরঃঃবফ.......... ও নবষরবাব ঃযরং ধিং হড়ঃ ধহ ধপঃ ড়ভ
ফবংঢ়বৎধঃরড়হ,নঁঃ ধহ ধপঃ ড়ভ ধংুসসবঃৎরপধষ ধিৎভধৎব ধিমবফ ধমধরহংঃ ঁং.”
যদিও
১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১ এর পর মুসলিম জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের রোষ তীব্র
হয়, তবুও ঐধৎৎরং এর এই মন্তব্য বিশ্বব্যাপী ধিকৃত হয়, হয় নিন্দিত।
মানবাধিকার সংস্থা,টঘ বিশেষজ্ঞরা গুয়ানতানামো কারাগার বন্ধ করার দাবি তোলে
ঃ‘ঃড় পষড়ংব ঃযরং ঁমষু পযধঢ়ঃবৎ ড়ভ ঁহৎবষবহঃরহম যঁসধহ ৎরমযঃং ারড়ষধঃরড়হং.’
কিন্তু
প্রভূত অর্থব্যয় এবং চরম অখ্যতি সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি এই কারাগার। বর্তমানে
এর বন্দীসংখ্যা ৩২। নিয়মিতই এখানে এখনও লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার।
ইয়াসির
তোমাদের মতাদর্শ ভ্রান্ত কি অভ্রান্ত সেটা সময়ই বলবে। তবু কামনা করব তোমরা
যেখানেই থাকো, শান্তিতে থাকো। কেইবা জানে তোমাদের আত্মত্যাগে কোনদিন নতুন
সূর্য উঠবে কিনা!!
পরিশেষে জীবনের কোন সুখকেই ছুঁয়ে না দেখা এই অবোধ কিশোরদের উদ্দেশ্যে আমার শ্রদ্ধার্ঘ রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই শেষ করি ঃ
‘যে ফুল না ফুটিতে
ঝরেছে ধরণীতে,
যে নদী মরুপথে
হারালো ধারা,
জানি হে জানি তাও
হয় নি হারা।’