প্রতিষ্ঠার
এক যুগ পার হলেও কুমিল্লা নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র থেকে বের হয় নি তাঁর
জীবনী ও রচনা নিয়ে কোন গবেষণা গ্রন্থ কিংবা প্রকাশনা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল
ইসলামের সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা, কারাবরন করা, প্রেম এবং
জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ অংশ কুমিল্লাজুড়ে থাকার পরও তাঁকে
নিয়ে কুমিল্লার বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠানে হয় নি নিজস্ব কোন গবেষণা। যদিও
প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছেন, প্রকাশনা শাখা নেই কুমিল্লা কেন্দ্রে। এছাড়া
বাজেট স্বল্পতা ও কেন্দ্রের সুনজরকে এই অবহেলার কারণ বলে দায়ী করছেন নজরুল
গবেষকরা। তারা বলছেন- প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকেই গবেষণায় উদ্যোগ ও সহযোগিতার
জোরালো কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নি কোন দিন।
নজরুল গবেষকদের মতে, জাতীয় কবি
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত
পাঁচ দফায় প্রায় এক বছর কুমিল্লায় ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি ১৯২১ সালের
২১ নভেম্বর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দায়ে নগরীর রাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হন
এবং ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর নগরীর ঝাউতলা থেকে গ্রেপ্তার হন সম্রাজ্যবাদী
অপশক্তির বিরুদ্ধে লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতার জন্য।
কবির দুই
জীবনসঙ্গীর প্রথমজন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের খাঁ বাড়ির
আলী আকবর খানের ভাগনি নার্গিস আসার খানম আর অপরজন কুমিল্লা নগরীর বসন্ত
কুমার সেনগুপ্তের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা দুলী। তবে কবি তাঁর নাম দিয়েছিলেন
প্রমীলা। গবেষকগণ বলছেন, কুমিল্লা জেলায় থেকে কাজী নজরুল ইসলাম অন্তত ৫৩টি
রচনা, কবিতা, গান লিখেছেন- যা বাংলাদেশের আর কোথায় হয় নি।
কুমিল্লায়
কবির রচিত সাক্ষ্য হিসেবে রয়েছে দোলন চাপা, অগ্নিবীনা, ছয়ানট, ঝিঙে ফুল,
পুবের হাওয়ার মত বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থের বিভিন্ন কবিতা। আবারো কোন কোন
গবেষকের মতে, কাজী নজরুল ইসলাম ৭৩ দিন ছিলেন দৌলতপুরে। সেই সময়ে তিনি ১৬০টা
গান ও ১২০টা কবিতা লিখেছিলেন। ‘পাঁপড়ি-খোলা’ নামের বিখ্যাত কবিতাটাও
লিখেছিলেন এখানে বসে। এছাড়াও ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায়-বেলায়’,
‘হারমানা-হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক প্রিয়া’ কবিতাগুলো
লিখেছিলেন।
এই জেলায় কবির স্মৃতিধন্য ঘটনাবহুল এলাকাগুলো হলো- বর্তমান
নজরুল এভিনিউ প্রমীলা দেবীর বাড়ি, ধর্মসাগরের পশ্চিমপাড়ে কবিতার আসর,
ঝাউতলায় গ্রেপ্তার হওয়া, বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, নানুয়া দিঘীর পাড়, দারোগা
বাড়ি, ইউসুফ স্কুল রোড বজ্রপুর, মহেশাঙ্গণ ঈশ^র পাঠশালা, কুমিল্লা বীর
চন্দ্র্রনগর মিলনায়তন- টাউন হল, চর্থায় শচীন দেববর্মনের বাড়ি, নবাব বাড়ি,
বাদুর তলায় ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি, রাণীর দিঘীর পড় ফুলার
হোস্টেল-কলেজিয়েট স্কুল প্রাঙ্গন, কুমিল্লা রেলস্টেশন, কোতয়ালী থানা,
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার, মুরাদনগরের দৌলতপুরের আলী আকবর খাঁ এর বাড়ি
উল্লেখযোগ্য।
জাতীয় কবির জীবনে কুমিল্লার প্রভাব ও তাঁর লেখনি নিয়ে
গবেষণা, গ্রন্থনা ও প্রকাশনা এবং কবির স্মৃতিস্মারক সংরক্ষণ-প্রদর্শণের
জন্য ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র। কিন্তু
প্রতিষ্ঠার এক যুগ পার হলেও জাতীয় কবিকে নিয়ে বিশেষায়িত এই প্রতিষ্ঠান থেকে
বের হয় নি কোন স্বতন্ত্র গবেষণা গ্রন্থ কিংবা প্রকাশনা। অথচ কবির জীবনী,
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা, লেখন, পঠন ও চর্চার জন্য কুমিল্লা নজরুল
ইন্সটিটিউট কেন্দ্রের তিন তলা ভবনে রয়েছে যাদুঘর, লাইব্রেরী, চর্চাকেন্দ্র,
মিলনায়তন, আবাসিক কক্ষসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা রয়েছে। লাইব্রেরিটিতে
রয়েছে জাতীয় কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে অন্তত ৪ হাজার বই। যাদুঘরটিতে কাজী
নজরুল ইসলামের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র, বই-খাতা, কলম, পা-ুলিপিসহ অমূল্য
সংগ্রহ রয়েছে।
কুমিল্লায় নজরুলকে নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখির জন্য শিক্ষা
বিভাগের কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুসের ‘কুমিল্লায় নজরুল’ বইটি আকড় গ্রন্থ
হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের নজরুল ও কুমিল্লা,
নজরুলের বিদ্রোহী নজরুল ও প্রমীলা পরিবার, নজরুল চর্চা: প্রসঙ্গ কুমিল্লা
বইগুলোতেও কুমিল্লাতে নজরুলের পদচারণা নিয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় উঠে এসেছে।
তবে এসব বই লেখকগণ নিজস্ব তাগিদে লিখেছেন।
বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপক
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বলেন, ‘ইন্দ্রকুমার সেনের সাথে সখ্যতায় কাজী নজরুল ইসলাম
কুমিল্লায় ৫ বার এসেছেন। এর মধ্যে দুই মাস দৌলতপুর, নয় মাস কুমিল্লা শহরে।
কুমিল্লায় নজরুলকে নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারা অনুভব করলেন যে- নজরুলের
সৈনিক জীবনের পরে ১৯২১ সাল থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিনি যে কুমিল্লায় ৫ বার
এসেছেন সেসময় তাঁর জীবনে এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে যা নজরুলের জীবনের
উল্লেখযোগ্য অংশ এবং সন্দিগ্ধ অংশ। তারা গবেষণা করে সেটি প্রতিষ্ঠিত করতে
পেরেছিলেন যে, নজরুলের জীবনে সাহিত্য রচনায়, সঙ্গীতে এবং ব্যক্তিগত জীবনে
কুমিল্লার প্রভাব আছে। তাই কুমিল্লাবাসীর পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে
দাবি করা হলো- নজরুলকে নিয়ে গবেষণার জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান
স্থাপনের। কেবল মাত্র এই লক্ষ্যেই বাংলাদেশে ঢাকার বাইরে কুমিল্লায় নজরুল
ইন্সটিটিউট কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।’
নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র স্থাপনের
উদ্দেশ্য কি ছিলো এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বলেন, ‘এই
ইন্সটিটিউটটির মাধ্যমে প্রধানত কুমিল্লায় নজরুলের জীবনী গবেষণার মাধ্যমে
তুলে ধরা। কিন্তু দুঃখের তিনটি বিষয় হলো- প্রথমত, যারা নজরুল ইন্সটিটিউটে
চাকরি করতে এসেছেন- তাদের নজরুলকে নিয়ে তাদের প্রেম বা জ্ঞানগরিমা কতটুকু
তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় নাই। দ্বিতীয়ত, নজরুল ইন্সটিটিউটে আমরা মনে
করেছিলাম- কুমিল্লায় যারা স্বনিষ্ঠভাবে গবেষণা করেন ইন্সটিটিউট তাঁদের ডেকে
নিবেন এবং তাদেরকে সুযোগ সুবিধা দিয়ে গবেষণার কাজ প্রসারিত করবে। কিন্তু
তারা সে জিনিসটা করে নাই। তৃতীয়ত, একসময় দেখা গেলো নজরুল ইন্সটিটিউটে যে
জনবল কাঠামো প্রয়োজন তা আর নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। তাই নজরুল ইন্সটিটিউটটি
বর্তমানে কবির নামধারী শে^তহস্তীর মত কুমিল্লায় অবস্থান করছে। এখন
কুমিল্লায় আমরা যারা নজরুলকে নিয়ে যে অল্পস্বল্প লেখালেখি করি বা করতে চাই
তা আমরা ব্যক্তিগত ভাবেই করি, তা নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে কিছুই করা হয় না।
এই বিষয়টি নিয়ে আমি পরিপূর্ণভাবে হতাশ।’
বিদ্রোহী ও সাম্যের কবি
নজরুলের পদচারণায় স্মৃতিধন্য এই জেলায় কবির জীবনী ও কর্মকান্ড নিয়ে গবেষণা ও
গ্রন্থনার জন্য ইন্সটিটিউটে পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত এবং সুযোগ সুবিধা রয়েছে।
তবে ইন্সটিটিউটের বাজেট, উদ্যোগ ও কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার অভাবে দীর্ঘ
দিনেও কুমিল্লা কেন্দ্র থেকে কোন গবেষণা গ্রন্থ ও প্রকাশণা বের হয় নি বলে
ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নজরুল গবেষকগণ। এবিষয়ে নজরুল গবেষক ড. আলী হোসেন
চৌধুরী বলেন, নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র আসলে ঢাকার বাইরে কিছু ভাবছেন না।
আর এখানে যারা আছেন তারা নিয়মমাফিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এটি
কোন রুটিনের কাজ নয়, সৃজনশীল কাজ। এই সৃজনশীলতা চর্চার জন্য যে উদ্ভাবনী
চিন্তা ও ক্ষমতা দরকার তাতে সহযোগিতা করতে হবে। বিশেষ করে যে অর্থনৈতিক
সহযোগিতা দরকার হয়, সেটি মাথায় রেখে নজরুল ইন্সটিটিউক কেন্দ্র যদি কোন
পরিকল্পনা গ্রহন করে তবে ই কুমিল্লার জন্য এবং কুমিল্লায় নজরুলের জন্য ভালো
কিছু হবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা কুমিল্লা নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র
চেয়েছিলাম, পেয়েছি। কিন্তু যে কারণে চেয়েছিলাম তা হয় নি। গবেষণা ও সৃজনশীল
চর্চা চেয়েছিলাম- তা হয় নি। এখানে যারা আছেন তাদেরও করণীয় তেমন কিছু নাই,
ঢাকা থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে যে কি করা যায়।
কুমিল্লা নজরুল
ইন্সটিটিউট কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ জানালেন, কুমিল্লা নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্রে
কোন প্রকাশানা শাখা নেই। এই কেন্দ্রের সকল প্রকাশনা ঢাকা কেন্দ্র্র থেকে
প্রকাশিত হয়ে কুমিল্লা কেন্দ্রে আনা হয়। এছাড়া বিগত সময়ে বাজেট স্বল্পতার
কারণে গবেষণা খাতে নজর দেয়া সম্ভব হয় নি। তবে কুমিল্লার জন্য জাতীয় কবির
জীবনী ও কর্মকান্ড নিয়ে আলাদা গবেষণা ও গ্রন্থনার জন্য নতুন করে নজরুল
গবেষকবৃন্দকে আহ্বান করা হবে।
কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের
শিক্ষার্থী ইকবাল হাসান বলেন,‘ কুমিল্লায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের
প্রতিটি ঘটনা নিয়ে গবেষনার পর বিশ্লেষণ করে আলাদা আলাদ গ্রন্থ প্রকাশ করা
সম্ভব। কুমিল্লায় কবির বিদ্রোহী হয়ে ওঠা, প্রেমিক হয়ে ওঠা, একজন জীবন সঙ্গী
হয়ে ওঠারমত ঘটনা এবং এই জেলায় কবির গান-কবিতা লেখা ও চর্চা নিয়েও আলাদা
গবেষনা হওয়া উচিত। সেই গবেষণা থেকে উঠে আসা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে চাইলে
কুমিল্লা নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র আলাদা প্রকাশনা করতে পারে। কবিকে
উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন দিবসে সেগুলো বিশেষ ভাবে প্রকাশ পেতে পারে।’
নজরুল
ইন্সটিটিউট কেন্দ্রের সহকারী লাইব্রেরিয়ান খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সব
প্রকাশনা ঢাকা থেকে হয়। আমরা ঢাকা থেকে গিয়ে বই নিয়ে আসি। কুমিল্লা থেকে
কিছুই হয় না। এখানে যে লাইব্রেরী আছে সেখানে নজরুলকে নিয়ে প্রচুর বই আছে
এবং নিয়মিত পাঠকও আসেন। তবে কুমিল্লা থেকে কোন গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য
কুমিল্লাবাসী দাবি করতে পারেন।’
কুমিল্লা নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্রের
উপ-পরিচালক মোঃ আল আমিন বলেন, ‘কুমিল্লায় জাতীয় কবির জীবনের যে
গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে তা নিয়ে গবেষকরা ব্যক্তিগত ভাবে লেখালেখি
করেছেন। তবে কুমিল্লা নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র থেকে আলাদা ভাবে কোন গবেষণা
করা হয় নি এবং কোন গ্রন্থ প্রকাশ হয় নি। আমরা গবেষকদের আহ্বান করবো এবং
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই বিষয়ে জানাবো। আমরা এখন নজরুল সঙ্গীত চর্চা, কবিতা
আবৃত্তি ও নাচ, উচ্চারণ প্রশিক্ষণের মত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে
যাচ্ছি।’
কুমিল্লা থেকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণা ও
গ্রন্থনা প্রকাশনা যৌক্তিক উল্লেখ করে মোঃ আল আমিন বলেন, ‘কুমিল্লা নজরুল
ইন্সটিটিউট কেন্দ্র থেকে কোন বই, কোন ম্যাগাজিন কিংবা গবেষণা গ্রন্থ
প্রকাশের আহ্বান করা হলে স্থানীয় লেখক ও গবেষকরা বেশি আগ্রহী হবেন।’