ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
আবরার হত্যার বিচার এবং সামাজিক সচেতনতা
Published : Saturday, 11 December, 2021 at 12:00 AM
নিরঞ্জন রায় ||
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ সেই প্রতিষ্ঠানের কিছু সহপাঠীর দ্বারা নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হওয়ার পর আমি ‘আবরার ও ডেভান একই পরিস্থিতির শিকার’ শিরোনামে স্থানীয় একটি পত্রিকায় কলাম লিখেছিলাম। কারণ একই সময় টরন্টোর সন্নিকটে একটি ছোট শহর হ্যামিলটনে ১৪ বছর বয়সী ডেভান সেলিভ নামের এক স্কুলছাত্র একইভাবে তার সহপাঠীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে নিহত হয়। এই ঘটনাটি আরো নির্মম ছিল এ জন্য যে ডেভানকে স্কুলের সামনে তার মায়ের উপস্থিতিতেই নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে তার কয়েক সহপাঠী। লেখাটি পাঠ করে অনেকেই এমনকি আমার অনেক ঘনিষ্ঠজন আমাকে বলেছিলেন যে আবরার হত্যার বিচার হবে না; কিন্তু কানাডায় ডেভান হত্যার বিচার ঠিকই হবে। তাঁদের যুক্তি বাংলাদেশ বিচারহীনতার দেশ। এখানে সহজে কোনো অন্যায়ের বিচার হয় না। আর কানাডা-আমেরিকা ন্যায়বিচারের দেশ। তাই এখানে সব অন্যায়ের বিচার হবে এটাই স্বাভাবিক। এসব উন্নত দেশ সত্যিকার অর্থেই ন্যায়বিচারের দেশ তাতে কারো কোনো দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। এখানে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অন্যায় করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে তা তিনি যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন। কিন্তু বিচারের পথ এতটাই জটিল, দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল যে কতজন বিচারের দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে সেটাই বড় প্রশ্ন।
যাহোক, আবরার হত্যার বিচার হয়েছে এবং সেই বিচারে অভিযুক্ত ২০ আসামির ফাঁসির আদেশ এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের পথ পেরিয়ে এই রায় একদিন কার্যকরও করা হবে নিশ্চয়ই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং বা র‌্যাগ ডের নামে নিরীহ ছাত্রদের নির্যাতনের পরিণতি যে কী ভয়ংকর হতে পারে তা আবরার হত্যার বিচারের রায়ের মাধ্যমে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে। এই ২০ জন অভিযুক্ত ছিল দেশের সেই সময়ের সবচেয়ে মেধাবী তরুণ। তাদের একসময় উচ্চশিক্ষিত হয়ে দেশে-বিদেশে অবদান রাখার কথা ছিল। এখন তারাই থাকবে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে এবং একসময় ফাঁসির দড়িতে ঝুলে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। কিছু মানুষের দৃষ্টিতে বিচারহীনতার তকমা দেওয়া বাংলাদেশে আবরার হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু একই সময় একই রকম পরিস্থিতির শিকার হয়ে টরন্টোর সন্নিকটে হ্যামিলটন শহরে স্কুলছাত্র ডেভান হত্যার বিচার সম্পন্ন হওয়ার খবর আমরা এখনো জানি না এবং কবে সম্পন্ন হবে তা অনুমান করা কঠিন। বিচার হয়তো একদিন হবে এবং অভিযুক্তরা সাজাও পাবে। কিছুদিন জেল খেটে আবার জামিনে বের হয়ে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপনও করবে নিশ্চয়ই। জামিন না পেয়ে জেলে থাকলেও মানবিধাকারের নাম করে সব সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করবে নিশ্চয়ই। কেননা আমেরিকা-কানাডা যেমন শতভাগ ন্যায়বিচারের দেশ, তেমনি সর্বোচ্চ মানবিধাকারের দেশও বটে। কিছুদিন আগে এখানকার ধনীর দুলাল মদ পান করে মাতাল হয়ে গাড়ি চালানোর সময় একটি গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে তিন শিশুসহ পাঁচজনকে নিহত করে। বিচারে সেই ধনীর দুলালের জেলও হয়েছিল বেশ কয়েক বছরের। কিন্তু দুই বছর জেল খেটেই জামিনে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে ঠিকই। নিজের বাড়ির উঠানে খেলা করার সময় দুই শিশুসন্তানের ওপর গাড়ি উঠিয়ে হত্যা করার পরও সেই বেপরোয়া গাড়িচালক জামিনে বেশ ভালোই আছে। এক ব্যক্তি বরফ পরিষ্কারের গাড়ি ইচ্ছাকৃতভাবে পুলিশ অফিসারের ওপর উঠিয়ে দিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরও পাগল বিবেচিত হয়ে বেকসুর খালাস পেয়ে যান। এ তো গেল জামিনে মুক্ত হওয়ার ঘটনা। এক নাবালক মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করার অপরাধে এক আসামির যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেই সাজাপ্রাপ্ত আসামি মানবাধিকারের নামে জেলখানায় এমন সব সুযোগ-সুবিধা দাবি করে বসেছেন, যা মেটাতে গিয়ে এখানকার সরকারকে প্রতিবছর ভালো অঙ্কের ট্যাক্সপেয়ারের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এমন খবর এখানকার মূলধারার সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছিল। আর বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি এবং বাংলাদেশের আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর চৌধুরী তো আমাদের ট্যাক্সের টাকায় বেশ বহাল তবিয়তেই আছে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে আমেরিকা-কানাডা শতভাগ ন্যায়বিচারের দেশ। কিন্তু সবার বিচার নিশ্চিত করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। সব অন্যায় বা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা চূড়ান্ত বিচার পর্যন্ত পৌঁছায় কি না তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে সব সময় জানাও সম্ভব হয় না। এই টরন্টো শহরে প্রায় প্রতিদিনই গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। প্রতিবছর প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জন হতভাগ্য মানুষ গোলাগুলিতে নিহত হয়। এত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে কি না বা কবে নাগাদ হবে তা এখানকার কেউ জানে না। বিচার তো অনেক দূরের কথা, বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারাও এখানকার পুলিশ নির্ধারণ করতে পারে কি না সন্দেহ আছে। আর পারলেও সেসব খবর যেহেতু মিডিয়ায় আসে না, তাই আমরা জানতেও পারি না। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা আমাদের দেশের পুলিশ করতে পারেনি। এ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা বা নিন্দার শেষ নেই। কিন্তু আজ থেকে কয়েক বছর আগে এই টরন্টো শহরে বিশাল ওষুধ প্রস্তুতকারী কম্পানির ধনাঢ্য মালিক বেরি সারমেন সস্ত্রীক নিজ বাড়িতে নির্মমভাবে নিহত হন। আজ পর্যন্ত সেই খুনের কোনো রকম কূলকিনারা এখানকার পুলিশ করতে পারেনি। এ নিয়ে কোনো রকম উচ্চবাচ্য কোনো তরফ থেকেই নেই। এসব ঘটনা উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে আমি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে কানাডার বিচারব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করছি। আমার উদ্দেশ্য মোটেই তা নয় এবং এই চেষ্টা করা অবিমৃশ্যকারিতা ছাড়া কিছুই নয়। আমি শুধু এতটুকু বলার চেষ্টা করছি যে প্রতিটি দেশের যেমন অনেক ভালো দিক আছে, তেমনি আছে কিছু খারাপ দিক। আমাদের বাংলাদেশে অনেক ভালো দিকে আছে এবং সেই সঙ্গে আছে কিছু খারাপ দিক। কিন্তু কী কারণে যেন আমরা আমাদের ভালো দিক তুলে ধরার পরিবর্তে খারাপ দিকগুলো খুব বেশি তুলে ধরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এর সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে কিছু পেইড দালাল, যাদের কাজই হচ্ছে সারাক্ষণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত থাকা। পক্ষান্তরে এসব উন্নত দেশে সব সময় ভালো দিকই তুলে ধরা হয়। খারাপ দিক নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই হয় না।
আবরার হত্যার অভিযোগে ২০ জন বুয়েটের ছাত্রের ফাঁসির দণ্ডাদেশ নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক। এই বিচারের রায় দেখে যদি আগামী দিনে অপরাধীরা শিক্ষা গ্রহণ করে এবং অপরাধ করা থেকে বিরত থাকে, তাহলেই দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। আমাদের দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দীর্ঘদিনের এবং অপরাধ করে যেনতেনভাবে পার পেয়ে যাওয়ার নজির যথেষ্ট আছে। তার পরও কিছু ঘটনার যে বিচার হয় না তেমন নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব সাজা দেওয়ার ঘটনা তেমনভাবে ফলাও করে প্রচারিত হয় না এবং মানুষ খুব বেশি জানেও না। ফলে মানুষ শুধু জানে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, অপরাধী ছাড়া পেয়েছে ইত্যাদি। ঘটনার যে বিচার হয়, বিচারে সাজা হয় এবং সেই সাজা কার্যকরও হয়; সেগুলো মানুষের অগোচরেই থেকে যায়। আমরা মনে করি, কোনো ঘটনা যেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়, ঠিক তেমনি সমান গুরুত্ব দিয়েই সেই ঘটনার বিচার এবং বিচারের রায় কার্যকরের সংবাদও সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়েই প্রচার করা প্রয়োজন। এগুলো নিয়ে বেশি আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। এমনকি সেই রায়ের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষামূলক ভিডিও চিত্র নির্মাণ করে তা প্রচার করা এবং স্কুল-কলেজেও দেখানো উচিত। এতে ভবিষ্যতে মানুষ অপরাধ করার আগে কিছুটা হলেও একটু ভাববে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া কোনোভাবেই এ ধরনের অপরাধ কমানো সম্ভব নয়।

লেখক:ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা