
আবুল কাসেম ফজলুল হক ||
বাংলাদেশের
সুবর্ণ জয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষপূর্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
শতবর্ষপূর্তি ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশ যখন অনুষ্ঠানমুখর, উৎসবমুখর তখন
বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এক বিশ্বশান্তি সম্মেলন।
এতে ৫০টি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানরা কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা যোগদান
করেন। তা ছাড়া শান্তিপ্রয়াসী কয়েকজন লেখক, গবেষক ও কর্মী এতে অংশগ্রহণ
করেছেন। তিন দিন ধরে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা, সংঘাত, যুদ্ধ ও শান্তি
প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় সরকারগুলোর করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ
করেন। কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে সম্মেলন সমাপ্ত হয়। যদি পৃথিবীর সব রাষ্ট্র
থেকেই, বিশেষ করে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো থেকে এ বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়,
তাহলে তা শান্তির পথে অগ্রগতির সহায়ক হবে।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে দুটি
বিশ্বযুদ্ধের কালে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যুদ্ধের অবসান ও
দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা বিষয়ে ক্রমাগত আলোচনা-সমালোচনা হয়। দুই
বিশ্বযুদ্ধের দ্বারা যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্রগুলো তো বটেই, তাদের বাইরেও
পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রের জনগণই বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা পরাজিত
হয়েছে তারা এবং যারা জয়ী হয়েছে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটা যুদ্ধবিরোধী
মনোভাব দুনিয়াব্যাপী গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এক শ বছর ধরে
যুক্তরাজ্য ছিল পৃথিবীর এক নম্বর শক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে
যুক্তরাজ্যের স্থলাভিষিক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও
বছর দশেক ধরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে মাঝে মাঝেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
দেখা দিয়েছে। মানবজাতির সৌভাগ্য যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটেনি। তখন ওয়াশিংটন ও
মস্কোর মধ্যে চলেছে তীব্র আদর্শগত বিরোধ, যা অভিহিত হয়েছে ঠাণ্ডা যুদ্ধ
বলে। ঠাণ্ডা যুদ্ধে মস্কো টিকতে পারেনি, ওয়াশিংটন জয়ী হয়েছে। অনেকে ধারণা
করেছিলেন যে এবার গণতন্ত্র কায়েম হবে এবং ওয়াশিংটন-কথিত স্বাধীন বিশ্ব—ফ্রি
ওয়ার্ল্ড গড়ে উঠবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। মার্ক্সবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধারণা
বহুলাংশে আবেদনহীন হয়ে পড়েছে, গণতন্ত্র পর্যবসিত হয়েছে নিছক
নির্বাচনতন্ত্রে। বাস্তবে দুনিয়াব্যাপী প্রায় সব জাতি, সব রাষ্ট্র আদর্শহীন
হয়ে পড়েছে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আর বিশ্বযুদ্ধ না হলেও পৃথিবীর
অনেক এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে এবং সেসব যুদ্ধও ক্ষতির কারণ হয়েছে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির
কল্যাণে, শ্রমশক্তির কল্যাণে এখন পৃথিবীতে উৎপাদন ও বৈষয়িক অনেক বেড়েছে
এবং বেড়ে চলছে। এখন সদিচ্ছা ও সর্বজনীন কল্যাণে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও
বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করা হলে পৃথিবীর সর্বত্র সব মানুষ খেয়ে-পরে
নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারবে। অসাম্য থাকবে। প্রকৃতি সব মানুষকে সমান করে
সৃষ্টি করেনি। প্রকৃতি-সৃষ্ট অসাম্যের ওপর আইন-কানুন ও রীতি-বিধি দ্বারা
মানুষ যে যে অসাম্য কায়েম করেছে, তার অবসান ঘটাতে পারবে।
এর জন্য
রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা—দুটোরই পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সোভিয়েত
ইউনিয়নের বিলুপ্তির (১৯৯১) পর কায়েমি স্বার্থবাদীরাই প্রায় সব রাষ্ট্রে
ক্ষমতাসীন আছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক
আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করা হচ্ছে না। উৎপাদন ও সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে
সঙ্গে অসাম্য বাড়ছে, অন্যায়-অবিচার বাড়ছে, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, সার্বিয়ায়
কয়েক বছর যুদ্ধ হয়েছে, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া প্রভৃতি
রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ন্যাটো লাখ লাখ সৈন্য পাঠিয়ে লাখ লাখ
মানুষকে হত্যা করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই রাষ্ট্রগুলোতে গত বিশ বছরের মধ্যে
অন্তত ১৬ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস প্রভৃতি
জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় বিদেশি
সৈন্যের উপস্থিতির ও গণহত্যার কারণে। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষার জন্য যে শান্তি
রক্ষা বাহিনী গঠন করেছে, তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি বৃহৎ শক্তিবর্গের স্বার্থে।
করোনা
মহামারির মধ্যেও অস্ত্র উৎপাদন বেড়ে চলছে, পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ যুদ্ধের
প্রস্তুতি বাড়াচ্ছে। চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের হুমকি
দিয়ে চলছে। চীন ও রাশিয়াও পাল্টা প্রস্তুতি নিয়ে চলছে। বৃহৎ গোটা দশেক
রাষ্ট্রের বাইরে অন্য কোনো রাষ্ট্রের মধ্যেই বিশ্বব্যবস্থা ও শান্তি নিয়ে
চিন্তা-ভাবনা নেই।
বিশ্বশান্তির জন্য দরকার বিশ্বব্যাপী ন্যায়-অন্যায়
বিষয়ে প্রচুর চিন্তা-ভাবনা ও ন্যায়সংগত কার্যক্রম। জাতিসংঘ হয়ে আছে বৃহৎ
শক্তিবর্গের সংঘে। জাতিসংঘকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করা দরকার। শুধু
জাতিসংঘের কাছে একটি সেনাবাহিনী রেখে সব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করতে
হবে। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির জন্য জাতিসংঘকে কাজ করতে
হবে। জাতিসংঘের গঠনতন্ত্রের আমূল সংস্কার দরকার। যুদ্ধ ও শান্তি সম্পর্কে
গভীরতর চিন্তা-ভাবনা দরকার। প্রত্যেক রাষ্ট্রের ব্যবস্থাকে সর্বজনীন
গণতন্ত্রের আদর্শ নিয়ে পুনর্গঠিত করতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা উন্নত করা আর
বিশ্বব্যবস্থা উন্নত করার চিন্তা ও কাজ একসঙ্গে করতে হবে।
বাংলাদেশের
রাজনীতি সম্পর্কে ১৯৮০-র দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে আমি
লিখেছিলাম : বেসামরিক স্বৈরাচারের পর সামরিক স্বৈরাচার, সামরিক স্বৈরাচারের
পর বেসামরিক স্বৈরাচার তারপর আবার সামরিক স্বৈরাচার এবং আবার বেসামরিক
স্বৈরাচার... এই ধারাতেই তো চলছে বাংলাদেশের রাজনীতি। এই ধারায় অগ্রসর হয়ে
গণতন্ত্রে উত্তরণের সম্ভাবনা কোথায়? স্বৈরাচার সামরিকই হোক আর বেসামরিকই
হোক—ক্ষমতাসীনই হোক আজ ক্ষমতাবহির্ভূতই হোক—অন্ধকারের শক্তি। আর
রাজনীতিবিদদের ও বুদ্ধিজীবীদের নীতিহীন, কর্মসূচিহীন ঐক্য জনসাধারণকে
গভীরতর সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করে; সংকট থেকে একটুকুও উদ্ধার করে না।
গত
চল্লিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি কি উন্নত হয়েছে? রাজনীতি কী?
রাজনীতি কেন? গণতন্ত্রকে পরিণত করা হয়েছে নির্বাচনতন্ত্রে। বাংলাদেশের
সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো কি নির্বাচন করার সামর্থ্য অর্জন করেছে? নির্বাচন
কেন? গণতন্ত্র কী?
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশ্বশান্তির জন্য মাঝে মাঝে
মহাত্মা গান্ধীর কোনো কোনো উক্তি প্রচার করা হয়। তা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের
সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে। সর্বজনীন কল্যাণের জন্যও গান্ধীর চিন্তাকে কাজে
লাগানো সম্ভব। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর গান্ধী দেশবাসীর উদ্দেশে
যা লিখেছিলেন, তার কিছুটা এখানে উদ্ধৃত করছি। গান্ধী লিখেছিলেন, “আমার
বিশ্বাস, যেখানে কাপুরুষতা ও হিংসা—এ দুটোর একটিকে বেছে নেওয়ার প্রশ্ন
উঠবে, সেখানে আমি হিংসাকেই বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেব।...
“তবে আমি
বিশ্বাস করি, হিংসার চেয়ে অহিংসা অসংখ্য গুণে শ্রেয়। শাস্তিদানের চেয়ে
ক্ষমাপরায়ণতা অনেক বেশি পুরুষোচিত। ক্ষমাপরায়ণতা সৈনিকের ভূষণ। আর শাস্তি
দেওয়ার শক্তির সংযমই ক্ষমাপরায়ণতা। একটি অসহায় প্রাণীর দিক থেকে
ক্ষমাপরায়ণতা অর্থহীন। আমি ভারতকে অসহায় মনে করি না, নিজেকেও অসহায় জ্ঞান
করি না। আমি শুধু চাই, ভারতের ও আমার শক্তির মহত্তর লক্ষ্য সাধনে ব্যবহার
করতে।
“...আমার অহিংসা ধর্ম শুধুমাত্র মুনি-ঋষিদের ধর্ম নয়। এটা সাধারণ
মানুষেরও ধর্ম। অহিংসা মনুষ্য প্রজাতির বিধি, আর হিংসা পশুদের। পশুদেরও
আত্মা রয়েছে, কিন্তু সে আত্মা সুপ্ত। দৈহিক শক্তির নিয়ম ছাড়া অন্য কোনো
নিয়ম তারা জানে না। কিন্তু মানব মর্যাদার কাঙ্ক্ষিত বস্তু হলো মহত্তর বিধি,
সে চায় তার আত্মার শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে।
“যে সমস্ত ঋষি হিংসার মধ্যে
অহিংসা ধর্মকে আবিষ্কার করেছেন আমি তাঁদের নিউটনের চেয়েও মহত্তর প্রতিভার
অধিকারী বলে মনে করি। তাঁরা ওয়েলিংটনের চেয়েও বড় যোদ্ধা। তাঁরা নিজেরা
অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা এ বিদ্যার
ব্যর্থতাও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তাঁরা এই ক্লান্ত বিশ্বাসকে শিখিয়ে
গিয়েছেন—হিংসার মধ্যে নয়, অহিংসার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মুক্তি।
“...পাপীর
ইচ্ছার কাছে বিনম্র নতিস্বীকার এর অর্থ নয়। এর অর্থ হলো অত্যাচারীর
বিরুদ্ধে নিজের সত্তার সর্বমুখী প্রতিরোধ খাড়া করা। এই মানবিক বিধি অনুযায়ী
কাজ করে মানুষও তার মর্যাদা রক্ষার জন্য, ধর্ম ও আত্মাকে বাঁচানোর জন্য এক
মহাপরাক্রমশালী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। রুখে দাঁড়াতে
পারে ওই সাম্রাজ্যের পতন ও পুনরুজ্জীবনের পথ তৈরি করতে।
“আমি চাই
ভারত-আত্মার বিনাশ নেই, সর্ব প্রকার দৈহিক দুর্বলতা ও সমগ্র বিশ্বের
শারীরিক শক্তির বিরুদ্ধে সে জয়ী হতে পারে—এই বোধে ভারত জেগে উঠুক।
“অহিংসা
কাপুরুষদের মুখোশ নয়, অহিংসা সাহসীদের সবচেয়ে বড় গুণ। যাঁরা অহিংসার চর্চা
করেন তাঁদের অসিযুদ্ধে নিপুণ ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি সাহসী হতে হবে।
ভীরুতার সঙ্গে অহিংসার কোনো সম্পর্ক নেই। অসিযুদ্ধে নিপুণ ব্যক্তি সহজে
নিজেকে অহিংস করতে পারেন। সুতরাং অহিংসার মধ্যে আঘাত হানার ক্ষমতাও আছে।
অহিংসা হলো প্রতিশোধস্পৃহার উপর আরোপিত সচেতন ও ইচ্ছাকৃত সংযম। তবে
নিষ্ক্রিয়, নির্বীর্য এবং অসহায় নতিস্বীকারের চেয়ে প্রতিশোধস্পৃহা বরং
শ্রেয়। কাল্পনিক বা বাস্তব অনিষ্টের আশঙ্কা থেকেই প্রতিশোধস্পৃহা সৃষ্টি
হয়ে থাকে।”
গান্ধীর এত কথা আমি উল্লেখ করলাম এই জন্য যে বিশ্বশান্তির
জন্য আজ গভীর ও গভীরতর চিন্তা ও চেতনা দরকার। অতীতের শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের
চিন্তা থেকে আমরা অনেক কিছু গ্রহণ করতে পারি।
লেখক: আহমদ শরীফ চেয়ার অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়