ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
তাঁরাও শহিদ
Published : Tuesday, 7 December, 2021 at 12:00 AM
তাঁরাও শহিদশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||
প্রথম পর্ব
    গ্রামের নাম পিপিয়াকান্দি। এ গ্রামে মুসলমান ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের কেউ বাস করে না। কথাটা পুরো সত্যি নয়। গ্রামের উত্তরপ্রান্তে বেশ ব্যবধানে রামদয়াল ঘোষের বাড়ি। নিজ গ্রাম পিপিয়াকান্দির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তার ভিটার উত্তর পাশে মোহাম্মদপুর গ্রাম শুরু হয়েছে সরকারবাড়ি দিয়ে। বলতে গেলে পাশাপাশি, যদিও গ্রাম ভিন্ন।
    রামদয়াল ঘোষের বাড়িটির এলাকা বিস্তৃত। বাড়ি-পুকুর-পুকুরপাড়ে বাগবাগিচা, বাড়ির চারদিকে ফলফলাদির গাছ প্রচুর। কী নেই। আম-জাম-কাঁঠাল-তাল-নারিকেল-খেজুর-জাম্বুরা-পেয়ারা থেকে আমলকি-জলপাই-লটকন-জামরুল সবই আছে। কে খায়? রামদয়ালের দু’ছেলে। বড় মণীন্দ্র নিরুদ্দেশ, ছোট ধীরেন্দ্র বোকা প্রকৃতির। স্ত্রী ষষ্ঠী সাদামনের মানুষ। সহজ-সরল ও দরদী। সকলেই তাকে পছন্দ করে। কাজেই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ একাই রামদয়ালকে করতে হয়। ফলে তদারকি করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেন। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সময় স্বাভাবিক থাকে না। ঝগড়া না হলেও অতীষ্ট হয়ে অন্যের প্ররোচণায় মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন। একসময় তিনি মামলাবাজ হয়ে যান এবং অহেতুক মামলার কারণে আস্তে আস্তে জায়গাজমি বিক্রি শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত রামদয়ালের বাড়িটি ছাড়া আর কিছুই নেই।
    তারপরও রামদয়ালকে মানুষ মনে রাখে। তাকে পুণ্যবান বলে স্বীকৃতি দেয়। তার কারণ, তার পুকুরের জল এতটাই ভালো, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই এ পুকুরের জল পান করে, পুকুরে স্নান করে, আবার গরু-বাছুরকে স্নানও করায়। এলাকায় প্রতিটি বাড়ির নিজস্ব পুকুর আছে। সরকার বাড়ির দু’দিকে দুটি পুকুর আছে। কিন্তু জলপানের জন্য রামদয়ালের পুকুরের জলের উপরই বিশ্বস্ততায় নির্ভর করতে হয়। কথাটি একটু বুঝিয়ে বলি।
    ১৩৬১-৬২ সনে দু’বছর পর পর প্রবল বন্যায় গ্রাম-গঞ্জ জলে ডুবে যায়, একাকার হয়ে যায় মাঠ-ঘাট-বাড়ি-বাজার-রাস্তা। নৌকা বা ভেলা ছাড়া যোগাযোগের কোনো উপায় ছিল না। ঘরের ভেতরও জল আর জল। তখনও দেখা গেছে পাড়া-প্রতিবেশীরা নৌকা বা ভেলা করে রামদয়ালের পুকুরে এসে খাবারের জল নিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই বুঝতে চাইছে না- জল যেখানে একাকার, সেখানে এ পুকুরের জলের মধ্যে পার্থক্য কি? তারপরও ঘোষের পুকুরের জল পরিষ্কার-স্বচ্ছ ও স্নিগ্ধ। তা পান না করলে তৃপ্তি পাওয়া যায় না।


    আজ এতদিন পরও রামদয়াল ঘোষ বা তার বংশধর কেউ নেই, কিন্তু পুকুরটি তার জলের জন্য এখনও বিখ্যাত। এই পুকুরের মালিক এখন নূরমিঞা। কিন্তু পুকুরটি ‘ঘোষের পুকুর’। রামদয়াল ঘোষ, দৃশ্যত হারিয়ে গেছেন, অনেকেই এ ধারায় কেউ বেঁচে বর্তে নেই। তাদেরকে কেউ মনেও রাখে না। কিন্তু একটি পুকুরের জন্য রামদয়াল ঘোষের নামটি উচ্চারণ না করলেও ‘ঘোষের পুকুর’ নামটি স্থায়ী হয়ে রয়ে গেছে। তাতে কোনো সাইনবোর্ড নেই, নিশানাও নেই, কালপ্রবাহে এখন আর কেউ পুকুরের জল পান করে না। এলাকায় বাড়ি বাড়ি টিউবওয়েল বা ডিপটিউওয়েল, বিদ্যুতের কৃপায় মাটির নীচের জলই সকল কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আগের মতো কেউ ঘোষের পুকুরে যায়ও না, স্নান করে কী না তাও জানা যায় না। অব্যবহৃত একটি পুকুর। মালিক নূরমিঞা একবার পুকুরটি ভরাট করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু কোথা থেকে যেন বাধা আসে, সাহস পায় না। মনে হয়-রামদয়াল ঘোষ কোনো না কোনো পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
    নূরমিঞার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা বাড়ি-জমি-পুকুর ভাগ করতে গিয়ে পুকুরটি ভরাট করতে উদ্যোগ নেয়। ভরাটও করে। কিন্তু ভরাট পুকুরের মধ্যে কেউ বাড়ি করতে সাহস পায় না। কোনো ফসলও ফলায় না। একদিন হয়ত এ সংস্কার দূর হয়ে যাবে, মানুষ স্থানীয় স্মৃতিধর ইতিহাস মুছে দিবে-কিন্তু যতদিন কারও মনে এই পুকুরের কথা অন্তর নাড়া দিবে, তখনই মনটা কেঁদে উঠবে।
    এই কথা বলছি এজন্য যে, সরকার বাড়ির রমণীবাবুর বড় ছেলে কোলকাতা থেকে পিতৃভূমি দেখতে এসে রামদয়াল ঘোষের পুকুরটির খোঁজ নিয়েছে, তা দেখতে এসে ভরাট জমি দেখে স্তব্ধ হয়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে বলে উঠেছে-‘এই পুকুরে কতদিন স্নান করেছি, জলকেলি করেছি, এ পুকুরের জল পান করে তৃষ্ণা মিটিয়েছি। আত্মার সাথে এ পুকুর মিশে আছে। জলের নাম যদি জীবন হয়, তাহলে ঘোষের পুকুর হলো জীবনদাতা।’
    অবশ্যই আবেগের কথা। কিন্তু মনেরও তো কথা, প্রাণের কথা নয় কি? রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
    ‘তুমি মিলেছ মোর দেহের সনে,
    তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,
    তোমার ওই শ্যামলাবরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা।’


    পিপিয়াকান্দির মানুষগুলো গরিব। শ্রমজীবী তারা। নিজেদের জমি কম, অন্যের জমিতে কাজ করে, জন খেটে জীবিকা নির্বাহ করে। ঘর দরজা যেন অস্থায়ী আস্তানা। লেখাপড়া করার সুযোগ কম, সময়ও যেন নেই। সেখানে জনসংখ্যা বাড়ে, কিন্তু জীবিকার সংস্থান সংকুচিত হয়ে যায়। কীভাবে যেন একটি পরিবার শিক্ষিত হয়ে যায়। যিনি শিক্ষিতব্যক্তি তাঁর নাম নওয়াব আলী। তাঁর পিতা ছইয়া গাজী, নৌকার মাঝি। নওয়াব আলী গ্রামছাড়া হয়ে শহরে চলে যায়, এবং কোনো একজন দয়াবানের বদান্যতায় বি,এ ও এলএলবি পাশ করে গ্রামে ফিরে আসে। তিনি কুমিল্লা শহরে ওকালতি আরম্ভ করেন। সময়টা বিংশশতাব্দীর চল্লিশ দশকের কথা। তিনিই গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন, গ্রামের ছেলেদের পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টি করেন। প্রথম প্রথম কেউ সময় নষ্ট করতে চায়নি। পরে ২/৩ ক্লাস পডুয়া ছেলে পাওয়া যায় এবং একসময় এ স্কুল থেকে পঞ্চমশ্রেণি পাশ করে কোথাও গিয়ে লজিং থেকে বা অন্য কোনো উপায়ে শিক্ষিত হতে থাকে পিপিয়াকান্দির জনপদ।

    এখন আর পিপিয়াকান্দি গ্রামকে গরিবের আবাসস্থল বলা যাবে না। শহরে নানা প্রকার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে ভাগ্য ফিরিয়ে নিয়েছে। আবার এ গ্রামের কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে এখন ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে গেছে। এ ইতিহাস খুব দীর্ঘদিনের পরিক্রমা নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ গ্রামের লোকের ভাগ্যের চাকা সচল হয়ে গিয়েছিল, যেমনটি এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে একটি ঘটনার কথাই বলতে চাই।


    পিপিয়াকান্দির হযরত আলী, তার ডাক নাম ভোতা এবং বড়বোন গদি ও ছোটবোন পদি। তারা শারীরিকভাবে খুবই বলিষ্ঠ। ভোতা প্রায় ছয়ফুট লম্বা, তেমনি তার শরীর। গদি সাড়ে পাঁচফুট হলেও এতটাই ভারী যে নিজের শরীর নিয়ে চলাচল করাই যেন কষ্টকর। বিশেষকরে তার স্তন দুটি এতটাই বিশাল, কেউ কেউ বলত-একটি বালিশ হিসেবে মাথা রেখে অন্যটি মুখে দিয়ে নিশ্চিন্তে সময় কাটানো যাবে এবং ক্ষুধাও নিবৃত্ত করা যাবে। তবে এ কথা গদির সামনে কেউ বলতে সাহস করত না। তেড়ে আসত, তার গালিগুলোর ভাষা ছিল অশ্রাব্য। মোহাম্মদপুরের হিন্দু পাড়ায় দৈনিক যাতায়াত ছিল, চেয়েচিন্তে যা পেত, তা-ই খেয়েপরে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। ১৯৭১ সালে প্রায় না খেয়েই মারা যায়। তখন হিন্দুরা পালিয়ে বেড়িয়েছে নানা স্থানে।
    ভোতার এক ছেলে তাজু (তাজুল ইসলাম) এবং এক মেয়ে জয়দন (জয়ধন)। শারীরিকভাবে স্বাস্থ্যবতী। খুব কর্মঠ। ভোতার ছোটবোন পদিকে বিয়ে দেয়া হয় একই গ্রামে হোরার সঙ্গে (হোরা>হারিছ)। তাদের তিন ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের নাম কালী। গায়ের রং ততটা কালো নয়, নামই কালী। তার শরীরও হৃষ্টপুষ্ট।

    জয়দন ও কালী আপন ফুফাত ও মামাত বোন। সমবয়সী। বড় ভাব তাদের। একসাথে চলাফেরা। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিজনেরই তিনবার বিয়ে হয়েছিল। কোনো বিয়েই টেকেনি। বিয়েগুলো তিনবছরের মধ্যে কী কারণে ভেঙে গেছে, জানা যায়নি। তখন পুরুষেরা তিনবার তালাক শব্দটি উচ্চারণ করলেই বিয়ে ভেঙে যেত। মেয়েদের এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা বা অধিকার অথবা প্রতিবাদ ছিল না। তালাক হলেই বাপের বাড়ি। কিন্তু বাপের বাড়িতে তাদের আশ্রয় দেয় কে? বরং তিরস্কার ও তাড়িয়ে দেয়ার কঠিন পরিস্থিতির চিত্রই দেখা যেত।
    তাদের তিন তিনটি বিয়ে হলেও তাদের কোনো সন্তানসন্ততি ছিল না। জীবিকার জন্য এ দু’জন হিন্দুপাড়ায় কাজ করত। কাজের মধ্যে প্রধান হলো ঢেঁকিতে ধান ভানা। এতে খাওয়া পেত, পয়সা কড়ি কমই। বাড়ি-ঘর-উঠান ঝাড়ু দেওয়া, কাপড়-চোপড় ধোঁয়া ইত্যাদি সব। বিলাসিতা নেই। একটি সাধারণ শাড়িকাপড় শরীরে জড়িয়ে থাকত, সবটা শরীর ঢাকা পড়ত না। এতে তাদের যেমন অসুবিধা হতো না, অন্য কারও দৃষ্টি আকর্ষিত হতো না।
    জয়দন ও কালী স্বাধীন। গ্রামে সাধারণত মেয়েরা সন্ধ্যা বা রাতে চলাচল করত না। কিন্তু এ নিয়ম তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তারা কোনো পুরুষকেই পাত্তা দিত না। পুরুষদের প্রতি তাদের দারুণ অভিমান। তাদের কাছে সকল পুরুষ অযোগ্য ও ব্যর্থ। মনে হয় বিয়ে ভাঙার প্রধান কারণ দৈহিক তৃপ্তির অপ্রতুলতা। যারা স্বামী হয়েছিল, তারা নিজেরাই মুক্তি পেতে চেয়েছে। কাজেই জয়দন ও কালী পুরুষদের ভয় করবে কেন? তাদের জীবনের ইতিহাস হয়ত প্রায় একরূপ।
    কালী তার অভিজ্ঞতার কথা জয়দনকে বলে, জয়দনও হয়ত বলে। তাদের জীবনে রোমান্স বলে কিছু নেই। কিন্তু মানুষ হিসেবে, মেয়ে হিসেবে তো স্বপ্ন থাকে, জীবনকে নানাভাবে ভোগ করার বাসনা থাকে, দরিদ্র পরিবারে এরূপ প্রত্যাশা করা বাতুলতা। যেখানে খেয়েপরে বেঁচে থাকাই সংগ্রাম। তবে দু’জনের একজায়গায় অনুভূতি প্রায় একরূপ।
    তাদের প্রথম বিয়ে, প্রথম স্বামী, প্রথম স্বামী-সান্নিধ্য-কিছুটা স্মৃতিধর ও স্বাপ্নিক। এ দিনটির জন্য প্রতিটি মেয়ে অপেক্ষায় থাকে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে অবসর সময় স্মৃতিচারণ হয়।

(ক্রমশঃ)
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
 মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫