গণতান্ত্রিক
ব্যবস্থার অন্যতম উপাদান গণমানুষের ভোটের অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার বিগত
সরকারের আমলে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে সর্বত্র দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন
সংঘটিত হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমাদের উচিত এই ব্যবস্থাকে রোধ করে
একটি জবাবদিহিমূলক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করা। আমরা মানুষের
পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে। কোনো দলের পক্ষে নই, আমরা নিরপেক্ষ। সচেতন নাগরিক
হিসেবে আমাদের যা করণীয়, আমরা এখনো তা করতে পারিনি। আমাদের ভোটের অধিকার
নিশ্চিত করতে হবে।
একদিকে ভোটারদের ভোট প্রদানে যেমন অনীহা তৈরি
হয়েছিল, তেমনি এটি একটি রোগ অথবা রোগের উপসর্গে পরিণত হয়েছিল। রোগের
উপসর্গও আমরা দেখতে পাচ্ছি। কাজেই এই রোগের চিকিৎসা করতে হলে শুধু উপসর্গকে
চিহ্নিত করলে হবে না। রোগের কারণও চিহ্নিত করতে হবে। সাধারণ মানুষ ও
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তা নিয়ে অনাগ্রহের মূল কারণ আমাদের চিহ্নিত করতে
হবে। এর মূল কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মানুষের প্রতি অনাস্থা। নির্বাচনি
ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হওয়ার কারণ- ভোট দিতে গেলে সঠিকভাবে
ভোট দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে তাদের মনে শঙ্কা ছিল।
দেশে বহুদিন ধরে
সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না বলে অনেকে মনে করে থাকে। এ ধরনের নানান শঙ্কা তাদের
মনে কাজ করে। কাজেই তারা ভোট দিলে বা না দিলে তাতে কিছু এসে যায় না।
ক্ষমতাসীনরা যাদের চায় তারাই নির্বাচিত হবে। এই নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার ওপর
মানুষের ব্যাপক অনাস্থা। এর একটি কারণ হলো, যে প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনি
ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে তার মধ্যে অন্যতম হলো নির্বাচন কমিশন,
প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের ওপর মানুষের অনাস্থার কারণ
ছিল ব্যাপক দলীয়করণ। অনাস্থা নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার ওপর এবং এসব
প্রতিষ্ঠানের ওপর। এসব কারণে মানুষ ভোট দিতে চায়নি এবং তারা মনে করে তারা
ভোট দিলেও তাদের প্রত্যাশিত প্রার্থীদের পরাজয় নিশ্চিত।
কাজেই ভোটদানে
তারা অনীহা প্রকাশ করে এসেছে সবসময়। কাজেই নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায়
ব্যাপকভাবে সংস্কার দরকার। সংস্কারের মাধ্যমে এ অবস্থা দূর করতে হবে। তা না
হলে নির্বাচনিব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। অর্থাৎ নির্বাচনিব্যবস্থা কোনোভাবেই
কার্যকর হবে না। বিগত সরকারের আমলে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নির্বাচনে টাকার
খেলা। যোগ্য-অযোগ্য যেই হোক তারা মনোনয়ন কিনে নিত। মনোনয়নের পর তারা
বিভিন্নভাবে টাকা-পয়সা ব্যয় করে তাদের জয় নিশ্চিত করত।
বাংলাদেশ অনেক
সমৃদ্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা এ কথাও বলি যে, এখনো স্বাধীনতার অনেক স্বপ্ন
আমাদের পূরণ হয়নি। মানুষ ভোট দিতে গেছে কিন্তু ভোট দিতে পারেনি। ভোটের মাঠে
বিকল্প থাকতে হয়। নিজেদের মধ্যে ভোট হলে তো সেই বিকল্প থাকে না। তাই মানুষ
অতীতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। পছন্দমতো প্রার্থী
বাছাই করতে নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক হওয়া প্রয়োজন, যা বিগত
সময়গুলোতে দেখা যায়নি।
দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই
চলবে না। গণতন্ত্র, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ভোটাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক
পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের সচেতন ব্যক্তিদের ভূমিকা রয়েছে।
মানুষের ভোটের অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত একটি মানবাধিকার। তাই
নির্বাচনে জনগণ যেন তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত না হন,
সেটি আমাদের দেখতে হবে।
গণতন্ত্র মানেই বহুদলীয় গণতন্ত্র। আমাদের
বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটেছিল। এই পদ্ধতিতে যেখানে জনগণ বিনা
দ্বিধায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে। যে
প্রতিনিধিরা তাদের হয়ে কাজ করবেন। তাই বিএনপি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ
দলকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন হলে মূলত একদলীয় শাসন কায়েম হবে। যাকে
কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও
নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীকে
পরিপূর্ণভাবে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে। সীমাহীন দলীয়করণের মাধ্যমে বিগত
সরকার ও প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যকার বিভাজন প্রায়
সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে পড়েছিল। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অনেকেই দলীয়
ক্যাডারের মতো আচরণ করেছেন। তারা সরকারের দমনপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে
কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার
বৈশিষ্ট্য হলো কার্যকর নজরদারি ও দায়বদ্ধতার কাঠামোর উপস্থিতি। একটি
রাষ্ট্রে মোটাদাগে দুই ধরনের দায়বদ্ধতা বিরাজমান- নিম্নমুখী দায়বদ্ধতা ও
সমান্তরাল দায়বদ্ধতা। নিম্নমুখী দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয় ভোটের মাধ্যমে।
পাঁচ বছর পর পর ক্ষমতাসীনদের যদি ভোটের জন্য জনগণের দ্বারস্থ হতে হয়,
তাহলেই এ ধরনের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সরকার জনগণের স্বার্থে ও
কল্যাণে কাজ করে। আর সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে হলে যদি জনগণের সম্মতির প্রয়োজন
না পড়ে, তাহলে সরকার যথেচ্ছাচার করতে পারে।
আমরা এতদিনে সেটাই দেখে
এসছি। যারা তাদের ক্ষমতায় এনেছে এবং টিকিয়ে রেখেছে, তাদের স্বার্থের প্রতিই
গুরুত্ব দিতে ব্যস্ত থাকে। ফলে গণতন্ত্র নষ্ট হয়। সরকারের সমান্তরাল
দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয় কতগুলো সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ ও ‘নন-স্টেট’ বা
রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কতগুলো সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে
সরকারের স্বচ্ছতা-দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয়। আদালতের মাধ্যমে আইনের শাসন
প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলো ভেঙে পড়লে সরকার দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন ও অন্যান্য
কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়, যার লক্ষণ দৃশ্যমান। আর এটি ঘটেছে পক্ষপাতদুষ্ট
ব্যক্তিদের এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের এবং তাদের ওপর নানাভাবে অন্যায় ও
অযাচিত চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে। একতরফা নির্বাচন এ পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে
তোলে।
এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের করণীয় হলো- এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে
নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে এবং দলীয়করণের অবসান ঘটাতে হবে। নির্বাচনের সময়
আমাদের নির্দলীয় সরকার দরকার, যারা পক্ষপাত-বহির্ভূত নির্বাচন অনুষ্ঠিত
করবে। একই সঙ্গে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য দলীয়
প্রভাবমুক্ত করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করতে হবে।
প্রশাসনকে
সুদক্ষ করে গড়ে তোলাই এখন প্রধান কাজ। এর কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া গত
সরকারের আমলে দেশে কোনো নির্বাচনিব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। সেগুলো মেরামতেও
অন্তর্র্বতী সরকার নজর দিয়েছে। বিগত সময়ে নির্বাচন কমিশন, আদালত,
জনপ্রশাসনসহ সব কিছুই ছিল বেদখল। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন দলীয়করণের ফলে
মানুষের ভিতর এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছিল নির্বাচনিব্যবস্থার প্রতি।
সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার হারিয়েছিল। দেশে কোনো নির্বাচনিব্যবস্থা
কার্যকর ছিল না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের ফলে অযোগ্য, অদক্ষ ও
দুর্নীতিগ্রস্তদের দখলে চলে যায়। কাজেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করে
জনবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এটি পুনর্গঠনের বিকল্প নেই।
লেখক: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন