বৃহস্পতিবার ৩ জুলাই ২০২৫
১৯ আষাঢ় ১৪৩২
পরিবেশ দূষণে রেডিয়েশন
অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২:৩০ এএম |

 পরিবেশ দূষণে রেডিয়েশনশক্তির ইলেক্ট্রমেগনেটিক তরঙ্গ যেমন রেডিওওয়েভ, প্রদর্শিত আলো এবং এক্স-রে সমূহ যা কিছু সুনির্দিষ্ট অবস্থায় এটম থেকে বিচ্ছুরিত হয় বা বিকিরণ লাভ করে- তাকেই রেডিয়েশন বলে। রেডিয়েশন মানবিক পরিবেশের একটি অংশ। একটি বস্তুকে শক্তি শোষিত হওয়ার পরিবেশে রাখলে অর্থাৎ বস্তুকে অতিরিক্ত তাপমাত্রা বা সুনির্দিষ্ট বিদ্যুৎ প্রবাহে রাখলে যা সাধারণতঃ স্থিরাবস্থায় থাকে তা শক্তি সঞ্চয় করে সক্রিয় অবস্থায় রূপান্তর লাভ করতঃ অতিরিক্ত শক্তি ইলেক্ট্রমেগনেটিক রেডিয়েশনরূপে সঞ্চারিত করতে থাকে। সবচাইতে ভয়ঙ্কর রেডিয়েশন উৎপাদিত হয় প্লুটনিয়াম ও ইউরেনিয়ামের মাধ্যমে যা পরমাণু শক্তি তৈরীতে বা পরমাণু অস্ত্র তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। যদিও পরমাণু শক্তিকে স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং স্বল্পব্যয়ী বলা হয় তবুও তার নিরাপত্তা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভিনিয়ায় ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরণবিলের দুটি দূর্ঘটনার পর এখন অনেক জ্ঞানী লোকদেরই ধারণা জন্মেছে যে পারমানবিক শক্তি কেন্দ্র সমূহ আর নিরাপদ নয়। পারমানবিক শক্তি ব্যবহারের আরেকটি অসুবিধাজনক দিক হচ্ছে রেডিওএকটিভ বর্জ্যসমূহ দশ হাজার বছর পর্যন্ত মারাত্মক ক্রীয়াশীল থাকে এবং তাদেরকে গুদামজাত করা একটি দূরূহ ব্যাপার।
রেডিয়েশনের প্রকারভেদ ঃ রেডিয়েশন টার্মটি আসলে “আয়নাইজিং রেডিয়েশন” রূপে ব্যবহৃত হয় যা শরীরের বিভিন্ন তন্তু ভেদ করতে সক্ষম ও শক্তিরূপে সেথায় সঞ্চিত থাকতে পারে। আয়নাইজিং রেডিয়েশন দুপ্রকারের- ১) ইলেক্ট্রমেগনেটিক রেডিয়েশনঃ এক্সরে এবং গামারে। ২) করপাসকুলার রেডিয়েশনঃ আলফা ও বিটা পার্টিকেল (ইলেকট্রন) এবং প্রোটন। আলফা পার্টিকেল- এক্সরে, গামারে ও বিটা পার্টিকেল থেকে ১০ গুন বেশী ক্ষতিকারক কিন্তু তন্তু ভেদ করার ক্ষমতা অত্যন্ত কম। এক্সরে এবং গামারে'র তন্তু ভেদ করার ক্ষমতা অত্যাধিক।
রেডিয়েশন সংস্পর্শের আধার ঃ ক) প্রাকৃতিক আধার ১) নীলাভ রশ্মি (ভূমন্ডলের বাহির থেকে সূর্যরশ্মির উৎপন্ন)    ২) টেরেস্ট্রিয়েল (মানব পরিবেশের বিভিন্ন রেডিওএকটিভ বস্তু যেমন- মাটি, দালানকোঠা ইত্যাদি) ৩) এটমস্ফিয়ারিক রেডিয়েশন (রেডিওএকটিভ গ্যাস থেকে) ৪) ইন্টারনাল রেডিয়েশন (শরীরের বিভিন্ন তন্তুতে জমাকৃত রেডিওএকটিভ বস্তু থেকে)। খ) মানব তৈরী আধার- ১) এক্সরে (রেডিয়েশনের মানবতৈরী সর্ববৃহৎ আধার) ২) রেডিও একটিভ সংগ্রহশালা বা ফলআউটস (পরমাণু বিকিরণ, পারমানবিক দূর্ঘটনা) ৩) অন্যান্য (টেলিভিশন সেট, রেডিয়াম ডায়েল, লুমিনাস মার্কারসমূহ ইত্যাদি)।
রেডিয়েশন শক্তি সমূহ ঃ ক) রেডিওয়েভ Ñ ওয়ারলেসে ব্যবহৃত হয় যা শোষিত হয় না এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকারক নহে। খ) মাইক্রওয়েভ Ñ স্বল্পদৈর্ঘ্য ইলেক্ট্রমেগনেটিভ ওয়েভ যা উড়োজাহাজ ও জাহাজ চলাচলে রাডারের জন্য ব্যবহৃত হয়। তড়িৎ খাদ্য গরম করতে বাসায় মাইক্রয়েভ ওভেন ব্যবহৃত হয়। ইহা শরীরের তন্তু সমূহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে এবং দীর্ঘস্থায়ী সংস্পর্শে কেটারেক্ট হয়। গ) ইনফ্রারেড রেডিয়েশন Ñঅধিক সময় সূর্যের আলোতে থাকলে এবং সুনির্দিষ্ট কিছু কারখানায় থাকলে অত্যধিক সংস্পর্শে কেটারেক্ট হতে পারে। ঘ) আল্ট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন- সবচেয়ে বড় আধার সূর্য। মাটির উপরিভাগ তা শোষণ করে কিন্তু বরফ প্রায় ৭৫% ভাগ প্রতিফলন ঘটায়। কয়েক মিলিমিটারের বেশী ভেদ করতে পারে না বিধায় চামড়ায় শোষীত হয়ও অত্যধিক সংস্পর্শে স্কীন কারসিনমা হতে পারে। ঙ) নীলাভ রশ্মি বা কসমিক রে Ñ সূর্য থেকে উৎপন্ন এবং এটমোস্ফীয়ার ভেদ করে আসতে আসতে দূর্বল হয়ে যায়।
রেডিয়েশন ইউনিট ঃ রেডিয়েশনের সক্রিয়তা পরিমাপ করা হয়- ১) রন্টজেন Ñসংস্পর্শের একক, একটি নির্দিষ্ট সময়ে রেডিয়েশন শোষনের পরিমাণ। ২) রেড Ñশোষনের একক, প্রতি গ্রামে রেডিয়েশন শোষনের পরিমান ৩) রেম Ñশোষিত ও পরিবর্তনকারী উপাদানের উৎপাদিত রেডিয়েশন। বর্তমানে ১) রন্টজেন পরিবর্তিত হয়ে কোলাম্ব পার কেজি (ঈ/কম) ২) রেড পরিবর্তিত হয়ে গ্রে (এু) ৩) রেম পরিবর্তিত হয়ে জুল পার কেজিতে বর্ণনা করা হয়।
একিউট রেডিয়েশন সিনড্রোম ঃ সমগ্র শরীরে বেশী ডোজের অর্থাৎ ১০০ রেম এর অধিক তন্তু ভেদকারী রেডিয়েশন একবারে দেয়া হলে ১-২ দিনের মধ্যে যে লক্ষণসমূহ ক্রমান্বয়ে দেখা দেয় তাকেই একিউট রেডিয়েশন সিনড্রোম বলে। লক্ষণসমূহকে চারস্তরে ভাগ করা যায়- ১) প্রথম স্তরে কিছু সময় অতিবাহিত হয় রেডিয়েশন সংস্পর্শে আসা ও লক্ষণ দেখা দেয়ার মধ্যে ২) দ্বিতীয় স্তরে সার্বক্ষনিক বমি উদ্বেগ সঙ্গে অনেক সময় ডায়রিয়া ও পেটব্যথা হতে পারে। এ স্তরটি ২৪-৭২ ঘন্টা স্থায়ী হয়। তদুপরি মাথাব্যাথা, চামড়ায় ফুসকুড়িও কনজাংটিভাইটিস পরিলক্ষিত হতে পারে। ৩) তৃতীয় স্তরে ২য় স্তরের লক্ষণসমূহ হতে রোগী মুক্তি পায় এবং অনেকটা আরাম অনুভব করে। এ স্তরে অনেকেরই চুল পড়ে যাবে এবং চামড়া উঠবে। ৪) চতুর্থ বা শেষ স্তরে রক্তে বিভিন্ন খারাপ প্রতিক্রিয়া যেমন- এপ্লাসিয়া অব বোন মেরো, এগ্রানোলাসাইটসিস, থ্রম্বসাইটপেনিয়ার ফলে রক্তক্ষরণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পায়।
তাৎক্ষণিক সাধারণ বিক্রিয়া ঃ ১) কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে- ১০,০০০ রেড বা তার বেশী দিলে Ñ ইন্ট্রাঅকোলার প্রেসার বাড়বে, উদ্বেগ, বমি, পেপিলইডিমা— ১  থেকে ২ ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু ঘটতে পারে। ২) পরিপাকতন্ত্রে- (৪০০ রেডের উপর) অরুচি, উদ্বেগ, বমি, পাতলা পায়খানা, অনেক সময় কাল পায়খানা সহ অতীব খারাপ অবস্থা ৫ দিনের মধ্যে শুরু হয়।      ৩) অস্থি মজ্জায়Ñ (৫০ রেড বা তার বেশী) Ñঅতীব খারাপ অবস্থা আরম্ভ হয় ৫-৬ সপ্তাহ পরে- রক্তের নানাহ পরিবর্তন- পেনসাইটপেনিয়া হিমগ্লবিন স্বল্পতা, শ্বেতকনিকা ও অনুচক্রিকা স্বল্পতাও লক্ষণীয়।
দীর্ঘস্থায়ী রেডিয়েশন বিক্রিয়া ঃ ১) স্বল্পমাত্রায়, অনেক দিনের সংস্পর্শে এপ্লাষ্টিক এনিমিয়া হয় যেমন Ñরেডিওলজিষ্ট, টেকনিশিয়ান এবং রেডিওথেরাপি গ্রহণকারী রোগীসমূহ। ২) ক্রনিক রেডিওডার্মাটাইটিস হতে পারে হঠাৎ বিটারে'র সংস্পর্শে (বোমব্লাষ্ট বা দূর্ঘটনা) সংস্পর্শে আসলে; চুল পড়ে যাওয়া, লাল ধূষর বর্ণের চামড়া, ব্যাথায় প্রতিরোধ স্বল্পতা, স্কোয়ামাস সেল কার্সিনমাও লক্ষণীয়। রেডিওথেরাপী গ্রহণকারী রোগীরা ও রেডিওলজিষ্টগনই এর ভূক্তভোগী। ৩) বেশীমাত্রার গামারে- এক্সরে বা আল্ট্রাভায়োলেট-রে কেটারেক্ট উৎপন্ন করে । ৪) উচ্চমাত্রার রেডিয়েশনের 'অনেক দূরবর্তী বিক্রিয়া হচ্ছে ষ্টেরিলিটি বা প্রজনন ক্ষমতার লোপ। ৫) জন্মের পূর্বে রেডিয়েশনে শিশুর অঙ্গহানী বা ত্রুটি দেখা দেয়। ৬) বিভিন্ন ক্যান্সার- চামড়ায়, হাড়ে ও রক্তে লিউকেমিয়া (মাইলয়েড) দেখা দিতে পারে। লিম্ফমা, থাইরয়েড কার্সিনমা, লাং ক্যান্সারও অনেকক্ষেত্রে লক্ষণীয়। ৭) জীবনকাল খাট হয়ে আসে- ক্যান্সার, রোগ প্রতিরোধহীনতা ও বর্ধিত বার্ধক্যজনিত কারণসমূহের আধিক্যে। ৮) জীন মিউটেশন, ক্রোমোসোমেল এবারেশন জাতীয় জেনেটিক বিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।
রেডিয়েশনের সংস্পর্শ প্রতিরোধ ঃ 
বাহ্যিকভাবে রেডিয়েশন প্রতিরোধে তিনটি ঃ ১) নির্ধারিত সময় ২) নির্দিষ্ট দূরত্ব ৩) রেডিয়েশন শোষণ এর ব্যবস্থা নিলে একজন ব্যক্তি রক্ষা পেতে পারে। প্রিভেনটিভ মেথডে ভেন্টিলেশন, এনক্লোসার এবং পারসোনেল প্রটেকটিভ ডিভাইস এর সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
রেডিয়েশন বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন - ১) নোটিফিকেশন ২) নির্দিষ্ট ক্রিয়াকান্ডের সঠিক সম্মতিপত্র ৩) সঠিক মাত্রা নির্ধারণ ও প্রয়োগের নিশ্চিয়তা ৪) ঝুঁকি অনুযায়ী কাজের বিভাজন ৫) নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি মনিটরিং ৬) উপযুক্ত পেশাজীবি নির্বাচন ৭) প্রায়োগীক ব্যবস্থাদির রেকর্ড সংরক্ষণ ৮) মেডিকেল সার্ভিলেন্স।
প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন- ১) বিনা প্রয়োজনে এক্সরে করা থেকে বিরত থাকা ২) এক্সরে স্থাপনায় পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ ৩) উত্তম টেকনিকের ব্যবহার ৪) প্রয়োগের জন্য নির্ধারিত সময় দূরত্ব ও শোষণকারী দ্রব্যের ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ৫) লেড এপ্রন, রাবার এপ্রনের ব্যবহার ৬) কর্মীদের জন্য ডসিমিটার ব্যবহার ৭) সময় সময় কর্মীদের মেডিকেল পরীক্ষা ৮) নিয়মিত কর্ম সময় ঠিক করে দেয়া ৯) বিশ্রাম, ছুটি ও বিনোদনের ব্যবস্থা।
সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সরকার, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও ব্যক্তিগণ মেনে চললে আগামীতে একটি রেডিয়েশনমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নতুবা গোটা জাতি বিপদগ্রস্থ হতে বাধ্য।    
লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
















সর্বশেষ সংবাদ
এক বছরে সাড়ে ৩ শ ধর্ষণের অভিযোগ কুমিল্লায়
সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পেলে ধারনা করা যাবে নির্বাচন কবে হবে: সিইসি
আজ কুমিল্লায় আসছেন সিইসি
চান্দিনায় মধ্য রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
এক বছরে ৯৬ বেওয়ারিশ লাশ দাফন কুমিল্লায়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা ইকরা মডার্ণ স্কুলের বার্ষিক ফল প্রকাশ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা
জিয়া সাইবার ফোর্স- কুমিল্লা উত্তর জেলা কমিটি অনুমোদন
কুমিল্লায় বিজিবি অভিযানে ৬০ কেজি গাঁজা জব্দ
চান্দিনায় মধ্য রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
‘সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণ নয়’
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২