মনুষ্যত্ব মানে কী? মানুষের
পক্ষে নিশ্চিতভাবেই এটা এক মূল প্রশ্ন। যদিও আদর্শ জীবনে আমরা পৌঁছতে পারব
না, তবু সেদিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য এমন কিছু ধারণা ও সংকল্পের প্রয়োজন হয়,
যেসব ত্যাগ করলে মনুষ্যত্বের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। বিভিন্ন ঐতিহ্যে এইসব
ধারণাকে বিভিন্ন ভাষায় ও শব্দে প্রকাশ করা হয়েছে। শব্দে আবদ্ধ হয়ে পড়লে
কিন্তু বিপদ আছে, সেটা এক ধরনের পৌত্তলিকতা। শব্দকে অতিক্রম করে, বিচার ও
আলোকিত অনুভূতির সাহায্যে, যথাসাধ্য মূলভাবে প্রবেশ করা আবশ্যক।
প্রাচীন
ঐতিহ্যের চতুর্বর্গের কথা বলা হয়েছে। ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ, এই নিয়ে
চতুর্বর্গ। এ নিয়ে সংক্ষেপে ও সাধ্যমতো সহজ ভাষায় কিছু আলোচনা করা এখানে
আমাদের উদ্দেশ্য। ঐতিহ্য থেকে শব্দ গ্রহণ করে নিলে ভাববিনিময় অধিকাংশ
মানুষের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ নয়। আবার বিচারের দ্বারা শব্দার্থ যথাসম্ভব
পরিশুদ্ধ করে না নিলে, শব্দই মনুষ্যত্বের অভিমেুখে যাত্রার পথে বাধা হয়ে
দাঁড়ায়।
মানবজাতি নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত। শুধু যে ধর্মকে আশ্রয় করে
সম্প্রদায় গঠিত হয় এমন নয়। যেখানেই ব্যক্তিবিশেষের চরম আনুগত্য সমগ্র
মানবজাতির প্রতি নয়, বরং খণ্ডক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ কোনো দল অথবা গোষ্ঠীর প্রতি,
সেখানেই মানবতার এই খণ্ডিত রূপকে সাম্প্রদায়িকতার তুল্য বলে স্বীকার করা
যেতে পারে। ধর্মের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন মতাদর্শকে অবলম্বন করেও যূথবদ্ধ
হিংস্রতা আমাদের যুগে গড়ে উঠেছে বারবার পৃথিবীর নানা স্থানে। যারা
মানবতাবাদে বিশ্বাসী তাদের সংগ্রামটা হওয়া দরকার সর্বপ্রকারের অনুদার অন্ধ
আনুগত্যের বিরুদ্ধে ।
বিষয়টাকে আরও একটু ব্যাপ্ত করে দেখা যাক। মানুষের
সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের পটভূমিতে আছে মানুষের সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির
সম্পর্ক। প্রকৃতির প্রতি আদিম মানুষ অনুভব করেছে একটা ভয়মিশ্রিত প্রবল
আকর্ষণ। এখানে আশঙ্কা ও আকর্ষণ দুটিই সমান সত্য। একদিকে প্রকৃতি জীবপালিনী,
সৃষ্টির অনন্ত উৎস। অন্যদিকে আছে তার ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক রূপ, আদিম মানুষের
বুদ্ধির অগম্য। ভীতিমিশ্রিত অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে নানা কুসংস্কার, যা
থেকে মানুষ আজও মুক্ত নয়। আদিম ধর্মের মূলে ছিল একই সঙ্গে অন্ধ ভীতি ও
বিশ্বের প্রতি মুগ্ধ আকর্ষণ।
ধর্মকে ভীতির আতিশয্য থেকে মুক্ত করতে
সাহায্য করেছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান বলে, এই বিশ্বপ্রকৃতি নিয়মের দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত। যুক্তির সাহায্যে এইসব নিয়মকে জানা সম্ভব। আমাদের জ্ঞানের
পরিধির ভিতর এখনও ধরা দেয়নি বিশ্বের সকল নিয়ম। তবু বিজ্ঞানীর বিশ্বাস,
বিশ্বে আছে নিয়মের রাজত্ব। এইসব নিয়মের যতটা জানা গেছে তা থেকে গড়ে উঠেছে
নতুন নতুন প্রযুক্তি। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রকৃতির ওপর মানুষের
ক্রমবর্ধমান আধিপত্য। এটা কম লাভ নয়। কিন্তু এতেই আবার নিহিত আছে একটা বিষম
বিপদ। আধিপত্যের একটা মাদকতা আছে। আধিপত্যের মাদকতাই একদিন ডেকে আনতে পারে
সভ্যতার বিনষ্টি।
ভয়ের ধর্মের পাশে পাশে আমরা শুনেছি অন্য এক ধর্মের
কথা, প্রেমের ধর্ম। যু্িক্তর সঙ্গে প্রীতির কোনো বিরোধিতা নেই। কিন্তু
যু্িক্তর গর্ভজাত সন্তান নয় প্রেম। যুক্তিকে মান্য করে নিয়েও প্রেম তার
অতিরিক্ত কিছু। এ দুয়ের মিলন আবশ্যক। এই মিলন ঘটানোর কাজেই মানুষের ধর্ম
খুঁজে পেতে পারে তার অনন্য সার্থকতা।
ধর্ম নিয়ে আলোচনা আপাতত স্থগিত
রাখা যাক। চতুর্বর্গে ধর্মের পাশে স্থান পেয়েছে, অর্থ। এই বিষয়টির প্রতি
এবার খানিকটা মনোযোগ দেওয়া যাক। জীবনধারণের জন্য অর্থের প্রয়োজন, এ কথা
সবাই স্বীকার করবেন। আলোচনার প্রথম স্তরে অর্থকে ধরে নেওয়া যেতে পারে
অন্নের সমার্থক শব্দ রূপে। এদেশের ঐতিহ্যে অন্নকেও স্থান দেওয়া হয়েছে
ধর্মের কাঠামোর ভিতর। মানুষের মনে খাদ্যের প্রতি আকর্ষণ স্থান পেয়েছে
প্রকৃতির নিয়মেই, জীবনধারণের সহায়ক হিসেবে। ক্ষুধার্ত মানুষ খাদ্য থেকে
তৃপ্তি লাভ করে, একটা মাত্রা অবধি এটাই স্বাভাবিক। এই মাত্রার ভিতর খাদ্যে
অরুচি একটা অসুস্থতার লক্ষণ।
কিন্তু মানুষ মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। খাদ্যের
প্রতি স্বাভাবিক রুচি যখন মাত্রা অতিক্রম করে তখন সেটা হয়ে ওঠে লোভ।
মানুষের সংস্কৃতিতে এই লোভ একটা বড়ো স্থান করে নিয়েছে। এর সপক্ষে নানা কথা
দাঁড় করানো হয়েছে। অন্ন শব্দটি ত্যাগ করে এবার আমরা গ্রহণ করব আরও ব্যাপক
অর্থবোধক একটি শব্দ, ভোগ্যবস্তু। ভোগ্যবস্তুর অপচয় অভিজাত শ্রেণির
বৈশিষ্ট্য। নবাবি অথবা জমিদারি সংস্কৃতিতে এই অপচয়ের অভাব কার্পণ্য বলে
ধিক্কৃত, অপচয়ে আছে ঔদার্যের প্রমাণ। সংস্কৃতির এই বৈশিষ্ট্য এখন আর অভিজাত
শ্রেণির ভিতর সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে স্ফীতকায় মধ্যবিত্তের ভিতর।
এটা
একাধিক কারণে দুঃখজনক। এতে ধনী ও দরিদ্রের ভিতর অসাম্য বড়ো বেশি প্রকট হয়ে
উঠেছে এমন এক যুগে যখন এই অসাম্য সমাজের ও পরিবেশের স্বাস্থ্যের পক্ষে
প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিকর। আরও একটা কথা আছে, যদিও সেটা প্রায় অস্বীকৃত থেকে
যায়। ভোজনবিলাসে অথবা ভোগবাদে, এমনকি যারা ভোগী তাদেরও সুখ বৃদ্ধি ঘটে না।
স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের সামান্য শাকান্ন থেকেও তৃপ্তি লাভ করার একটা
সামর্থ্য থাকে। বিলাসী মানুষ সেই সামর্থ্য হারায়। তখন বিলাসের বন্ধনকে সুখ
বলে গণ্য করার ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে বেড়ে চলে দুশ্চিন্তা, যা
আছে তার হারানোর ভয়, প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপর্যস্ত হওয়ার
আশঙ্কা। দারিদ্র্য লক্ষ্য হতে পারে না। কিন্তু বিলাসও মুক্তির পথ নয়। এতে
ব্যক্তির ও সমাজের জীবনে দুর্নীতি বাড়ে, আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এই কথাই
বলে। যারা ধনী তাদের মধ্যেই যেন বিশেষভাবে ধনের আকাক্সক্ষা বেড়ে চলেছে, আর
সেই আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য কোনো নীতি রক্ষা করে চলতেই তারা রাজি নয়।
চতুর্বর্গে অর্থকে উপেক্ষা করা হয়নি, কিন্তু তাকে স্থান দেওয়া হয়েছে ধর্মের
অর্থাৎ সুনীতির পাশে। স্থির বিচারে এটাই সংগত, তা নইলে ঘটে বিপর্যয়। যারা এ
কথা মানে না তারা সমসাময়িক সমাজকে দোষ দিয়ে নিজেদের দোষ অস্বীকার করতে
অভ্যস্ত। এটা কিন্তু কোনোভাবেই যুক্তির কথা নয়, মনুষ্যত্ব রক্ষা করার পথও
নয়।
বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি মানুষের যে স্বাভাবিক মুগ্ধতাবোধ আদিমকাল থেকে
লক্ষ করা যায়, নরনারীর প্রেমে পাওয়া যাবে তারই এক ঘনিষ্ঠ প্রতিফলন। তবে সেই
সঙ্গে কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। সেটাই প্রত্যাশিত, কারণ প্রকৃতির একটা
বিশেষ উদ্দেশ্য, বংশরক্ষা, যৌন আকর্ষণের মূলে স্থান পেয়েছে। মহাবিশ্বের
প্রতি মুগ্ধতাবোধে যে বিস্ময়বোধ ও মৃদুতা আছে তার সঙ্গে প্রতিতুলনায় যৌন
আকর্ষণের তীব্রতা অনেক বেশি। একই কারণে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার আঘাতও
বিশেষভাবে তীব্র। এই আঘাতের দুঃসহতার একটা পরিমাপ পাওয়া যায় প্রণয়ঘটিত
আত্মহত্যায়, যেটা বিরল ঘটনা নয়।
বিশ্বপ্রেম ও যৌনপ্রণয়ের আরও একটা
পার্থক্য উল্লেখযোগ্য। বিশ্বপ্রেমে সম্পত্তিবোধ নেই, যদি থাকে তবে সেটা
বিশ্বপ্রেম নয়। যৌনপ্রণয়ে অতি সহজে প্রভুত্বকামিতার অনুপ্রবেশ ঘটে।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে সম্পত্তিবোধ এমনভাবে মিশে গেছে যে,
বহুক্ষেত্রেই অবশেষে প্রেমবোধ ক্ষয় হয়ে যায়, সম্পত্তি বোধই প্রবলভাবে বিরাজ
করে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেখা দেয় কখনো সন্দেহপরায়ণতা, তিক্ততা, নির্দয়
কলহ। এইভাবে যৌনপ্রেমের ভিতর থেকেই উৎপন্ন হয় তাকে ধ্বংস করার শক্তি। এ এক
বিষম সমস্যা যা জীবনকে কদর্য করে তোলে।
এই সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে সমাজ ও
গতানুগতিক ঐতিহ্য যে পথ বেছে নিয়েছে তার সঙ্গে আমরা পরিচিত। ‘নারী নরকের
দ্বার।’ নরনারীর সম্পর্কের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা গভীর পাপবোধ।
এভাবে কিন্তু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। এতে যৌনতা অথবা
প্রভুত্বকামিতা কোনোটাকেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে কপটতা,
গোপনীয়তা, যৌনপ্রবৃত্তির বিকৃতি এবং নির্দয়তা।
এই পরিণাম দুঃখজনক বিশেষত
এই কারণে যে, নরনারীর সম্পর্কের ভিতর একটা অতুলনীয় মাধুর্যের সম্ভাবনা
আছে। দেহ ও আত্মার ভিতর একটা কঠিন বিভেদ নির্ণয় করে এবং এ দুয়ের ভিতর
প্রথমটি অধম ও দ্বিতীয়টি উত্তম এই প্রত্যয়ের দ্বারা আমরা একটি সরল সত্যকে
আড়াল করে দিই। দেহ দিয়ে যেমন কুৎসিতকে প্রকাশ করা যায় তেমনি সুন্দরকেও। ‘এই
লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর!/পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর,
সুন্দর হে সুন্দর।’ আত্মাও বাঁশি বাজায় দেহের ভিতর দিয়েই।
নরনারীর
প্রেমকেও স্নাত করা যায় স্নেহ ও শুভেচ্ছায়। যে ভালোবাসার ভিত্তিতে স্নেহ ও
শুভেচ্ছা নেই তাকে ভালোবাসা বলাটাই ভ্রম। যে প্রভুত্বকামিতা প্রেমকে বিকৃত
করে তোলে তাকে আমরা ঠেকাব কী করে? এটাই জরুরি প্রশ্ন। প্রেমের সঙ্গে কিছুটা
অনাসক্তির মিলন ঘটিয়ে তবেই রোধ করা যায় প্রেমের অধঃপতন। প্রস্তাবটা প্রথম
দৃষ্টিতে অবাস্তব মনে হতে পারে। তবু এটা সত্য। মনে রাখা দরকার যে, সার্থক
শিল্পী এই কাজটাই করেন, প্রেম ও অনাসক্তির সংযোগের ভিতর দিয়েই ঘটে তাঁর
শিল্পকর্ম। তিনি যখন কোনো নগ্ন নারীদেহ চিত্রিত করেন তখনও এই ভাবটাই কাজ
করে। নরনারীর দৈহিক সঙ্গমেও পাপ নেই যদি তাতে থাকে কামনার সঙ্গে স্নেহেরও
স্পর্শ। আর জীবনের এক বৃহত্তর লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েই নরনারীর সম্পর্ক
লাভ করে তার প্রকৃত ভারসাম্য।
কেউ বলবেন, সত্যের পরীক্ষা হয় প্রয়োগের
ভিতর দিয়ে। বিজ্ঞানী নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই অভিমতটাকেই পুষ্ট করবেন।
ভ্রান্ত ধারণা স্থায়িত্ব পায় না, পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়ে তার ভ্রান্তি
ধরা পড়ে। পরিত্যক্ত ভ্রান্ত ধারার পথ ধরেই বিজ্ঞান ক্রমশ এগিয়ে যায় সত্যের
দিকে। শীঘ্র হোক, বিলম্বে হোক, সত্যই জয়ী হওয়ার শক্তি ধরে।
একই
সিদ্ধান্তে আসবে ধর্ম, অথবা সুনীতির সমর্থকবৃন্দ, অন্য এক যুক্তির সহায়তায়।
মিথ্যাভাষণে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়ে। সত্যভাষণে
পারস্পরিক আস্থা অটুট থাকে। এই আস্থাই সমাজ ও সংহতির ভিত্তি। যে সমাজে
সত্যের স্থান নেই তার ক্ষয় অনিবার্য। কিছু মানুষের সাময়িক স্বার্থে মিথ্যা
লোভনীয় মনে হতে পারে, কিন্তু সত্যের আশ্রয়েই সমাজের সামগ্রিক স্বার্থ জয়ী
হয়। পরিবারের ভিতর মিথ্যাচরণ ব্যাপক হলে পরিবারও ভেঙে পড়ে।
এই রকমের
যুক্তির কেন্দ্রে আছে সমাজসংরক্ষণের চিন্তা। কিন্তু এসব অতিক্রম করেও আরও
কিছু কথা আছে। সেখানে সত্যের যোগ ব্যক্তির অন্তরের মুক্তির সঙ্গে। লোভ ও ভয়
থেকে যে মিথ্যার জন্ম, তাতে মন যতই আকৃষ্ট হোক না কেন তবু সেটা একটা
বন্ধনের দশা। যেখানে মুক্তি সেখানে চিত্ত ভয়শূন্য, মিথ্যার জটিলতায় আমাদের
উচ্চারণ পদে পদে বিঘ্নিত নয়। সমাজের সংকীর্ণ সংস্কারে আমাদের আত্মোপলব্ধি
সেখানে আচ্ছন্ন নয়। বিদ্বেষে বিকৃত নয়, বরং বাক্য সেখানে ‘হৃদয়ের উৎসমুখ
হতে উচ্ছ্বসিয়া ওঠে’, ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডি অতিক্রম করে আমাদের অন্তর
তখন বৃহৎ বিশ্বের সঙ্গে যোগের জন্য প্রস্তুত। এই শেষের কথাটি আরও একটু
ব্যাখ্যা করে বলা যাক।
মানুষ যদিও সমাজবদ্ধ জীব তবু তার ভিতর অন্য এক
আবেগ আছে যা তাকে সমাজের সীমানা ছাড়িয়ে নিয়ে যায়, তাকে নিমগ্ন করে এক পরম
একাকিত্বে এবং সেই সঙ্গে তাকে তাকাতে শেখায় মহাবিশ্বের প্রতি অন্তহীন, সকল
বৈষয়িক আকাক্সক্ষাহীন, অকারণ বিস্ময়ে। ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকালমাঝে/আমি
মানব কী লাগি একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে।’ ভালো-মন্দ শুভাশুভ সম্বন্ধে কালে আবদ্ধ
সকল ধারণাকে অতিক্রম করে মহাবিশ্বের সঙ্গে যোগসূত্রে ব্যষ্টির চেতনায়
মুক্তির যে উপলব্ধি, তারই স্পর্শ পাওয়া যায় প্রাচীন বাংলার মোক্ষসাধনায়। এই
বোধ অন্য কোনো ঐতিহ্যে এমন উজ্জ্বলভাবে ওজস্বিনী ভাষায় বারংবার বর্ণিত
হয়েছে বলে আমি জানি না।
এইখানেই বাঙালি ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য, অতুলনীয়
ঐশ্বর্য। আবার এইখানেই তার বিশেষ দুর্বলতা। দুটি কথাই আমাদের মনে রাখতে
হবে, আমাদের চিন্তায় এদের স্থান দিতে হবে যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে। কোন
কোন কর্মকে কর্তব্য বলে স্বীকার করতে হবে, প্রশ্নটা এই নিয়ে। আমাদের
প্রাচীন চিন্তায় পারিবারিক আচরণবিধির কথা আছে, জাতি-বর্ণ নির্দিষ্ট
কর্মবিভাগের আলোচনা আছে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নির্দেশ আছে। কিন্তু এর
বাইরে বৃহত্তর সমাজের প্রতি নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়দায়িত্বের কথা যথেষ্ট
স্পষ্টতার সঙ্গে বলা হয়নি। আজ যখন সমাজের স্তরে স্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে
তখন আমাদের ঐতিহ্যের এই দুবলতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা বিশেষ প্রয়োজন।
সংস্কৃতির যে রূপান্তর আজ অপেক্ষিত তাতে বর্ণভেদ ও সামাজিক অসাম্য এবং
নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের প্রতি উপেক্ষার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আন্দোলন গড়ে
তোলা একান্ত আবশ্যক।
এই যুক্তি মেনে নেওয়ার পরেও মনে রাখতে হবে
রবীন্দ্রনাথের ওই ঘোষণা, “এই কথাটা ধরে রাখিস– মুক্তি তোরে পেতেই হবে।” যে
মুক্তির কথা এখানে বলা হয়েছে তাকে কিন্তু লাভ করা যায় না কেবল নাগরিক
কর্তব্যসাধনের দ্বারা অথবা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিবর্তনের ভিতর
দিয়ে। সেজন্য প্রয়োজন হয় ব্যক্তির অন্তরে প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের সঙ্গে যোগের
আকাক্সক্ষাকে জাগ্রত রাখা। এরই ভিতর দিয়ে আমরা অতিক্রম করে যাই নিতান্ত
অহংকেন্দ্রিক আশা-আকাক্সক্ষাকে অতএব বিদ্বেষকে, সেই সঙ্গে মৃত্যুভয়কেও।
উদ্ধৃত করা যাক রবীন্দ্রনাথের ওই গানেরই শেষ চরণটি :
“সুখের আশা আঁকড়ে লয়ে মরিস নে তুই ভয়ে ভয়ে,
জীবনকে তোর ভ’রে নিতে মরণ-আঘাত খেতেই হবে।”
যুক্তিবাদ
কি আমাদের এইখানে পৌঁছিয়ে দিতে পারে? জানি না। যুক্তিবাদ কি একে অগ্রাহ্য
করতে পারে? মনে হয় না। যে যুক্তিবাদ সুখবাদের অধিক কিছু নয় তাকে যথেষ্ট
বলা যায় না। যুক্তিবাদকে শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠতে হবে মুক্তিবাদ। বহু মৃত্যুকে
অতিক্রম করে জীবনের যে অবিরাম প্রবাহ, তার সৃজনশীল সম্ভাবনায় বিশ্বাস
রক্ষা করাই মনুষ্যত্বের শেষ কথা। কর্মের ভিতর দিয়েই মানুষ তার ইতিহাস রচনা
করে; ব্যক্তির মৃত্যুকে অতিক্রম করে প্রজন্মের পর নতুন প্রজন্মের ভিতর দিয়ে
জীবন প্রবাহিত হয়ে চলে। কর্মবাদেরও নতুন ব্যাখ্যা সম্ভব এই প্রত্যয়কে
আশ্রয় করে। বন্ধন নয়, কর্ম হয়ে উঠতে পারে মুক্তির পথ।