বাংলাদেশ
পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) এর আয়োজনে ১৩ই
জানুয়ারি ’২৪ এক বিশেষ সম্মিলনী ঢাকার খামার বাড়িতে কৃষিবিদ ইনষ্টিটিউট
বাংলাদেশ মিলনায়তনে “বাংলাদেশে স্থায়িত্বশীল নগরায়ন: সমস্যা ও সমাধান”
বিষয়ক বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বেন এর
প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম। এতে তিনি বলেন, ঢাকা শহর বছরে সাড়ে ৩ শতাংশ
হারে বর্ধিত হচ্ছে। বিশে^র বড় শহরগুলোর মধ্যে এ বৃদ্ধি সর্বোচ্চ। এখানে বড়
বড় ভবন বিশাল বিশাল রাস্তা, মেট্টোরেল ও পাতাল সড়কের মত মেগা প্রকল্প
হচ্ছে। তৈরি পোষাক কারখানার সবচে বড় কেন্দ্র হয়ে উঠছে। গত দু’যুগে এখানকার
জনসংখ্যা ৫ গুন বেড়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের উপরে এখানে বসবাস
করে। ঢাকার এ উন্নতিকে অতিবৃদ্ধি হিসাবে চিহ্নিত করেন নজরুল ইসলাম। তিনি এ
ধরনের বুদ্ধিকে সামাজিক উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্থ করছে বলে মত দেন। কারন তা দেশের
মধ্যে উন্নয়ন বৈষম্য তৈরি করছে। ঢাকায় বিনিয়োগ অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি হচ্ছে
না। শহরের ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। পরিবেশ ধংশ হচ্ছে বলে মন্তব্য করে নজরুল
ইসলাম বলেন আমাদের প্রতিটি জেলা শহরে একটি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে
তুললে উন্নয়ন বৈষম্য কমবে। রেহমান সোবহান বলে, অতিনগরায়নের ফলে ঢাকায় যানজট
বাড়ছে। নগরায়ন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সমন্বয়হীনতার কারনে দ্রুত নগরায়ন
সম্প্রসারিত হচ্ছে। আবাসন কোম্পানিগুলোর চটকদার বিজ্ঞাপনের ফলে দেশের মানুষ
হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ফলে এখানে সেবা খাতের মধ্যে সমন্বয় আনা যাচ্ছে না।
বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন,
বাংলাদেশ এক সময় ছিল গ্রামনির্ভর দেশ। কিন্তু দ্রুত নগরায়নের কারনে তা ধীরে
ধীরে শহরকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির ৬৫ শতাংশ আসে শহর
থেকে। আর ঢাকা থেকে আসছে ৩৬ শতাংশ। এটা দেশের বৈষম্য তৈরির ক্ষেত্রে
অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে। অথচ
শুধু ঢাকা শহরের ৪০ শতাংশ অধিবাসী বস্তিতে থাকে। তাদের জন্য পানি ও
অন্যান্য সেবা সুবিধা কম। যে কারণে এ শহরে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে
বিকেন্দ্রিকরণ বাড়াতে হবে। ছোট ও মাঝারি শহরের পাশাপাশি গ্রামগুলোতে জরুরী
সেবা পৌঁছে দিতে হবে। মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়েছে, নির্বিঘ্নে যাতায়াতের
জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়কের প্রয়োজন হলেও ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ,
তার ৫২ শতাংশই আবার মোটরযান চলাচলের অনুপযোগী। এ কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে
যানজট। সঠিক নগরায়নের উদাহরণ হিসাবে শ্রীলঙ্কায় উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে,
সেখানে ৮০ শতাংশ মানুষকে গ্রামে রেখেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত
হয়েছে। অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর চীনের গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নশীল
ভিলেজ এনটারপ্রাইজ নামে পরিচিত অসংখ্য শিল্পকারখানা স্থাপন করা হয়েছিল।
তাতে ১০ কোটির বেশি মানুষের সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছিল। বাপা সহসভাপতি
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকার নগরায়নকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশষ অঞ্চল
পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্য
আছে। যেমন সেখানে বলা আছে, ঢাকায় বছরে পাঁচ লাখ মানুষ বাড়ছে। কিন্তু
বাস্তবে তা সাড়ে ছয় লাখের মত। বেশি জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শহরের জলাভূমি ও
কৃষিজমি দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জলাধার সংরক্ষণ আইন শক্তভাবে বাস্তবায়নের
মাধ্যমে নগরায়নের নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সুরক্ষা অত্যন্ত সহজ। ২ বাংলাদেশ
পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রাজউকের
চেয়ারম্যান আইনের বলে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে নিতে পারেন। কিšদ আমলে তা
পারা যায় না। মূলত: তিনি ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনের অনুমতি দিতে পারেন।
কিন্তু রাজউক জলাশয়ের কিভাবে ভূমি দেখাবে? ইকো সিস্টেমস বদলাতে পারে না।
রাজউকের চেয়ারম্যানের এ ক্ষমতা রহিত করা দরকার। এ পরিবেশবাদী আইনজীবী বলে,
ঢাকা শহরের কোন ভিশন নাই। এখানে আর আইনের দরকার নাই। এখন সব সংস্থার
সমন্বয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার। রাজউকের ১৯৫৩ সালের আইন দিয়ে ২০২৪ সালকে
মোকাবিলা করা যাবে না। তাদের আইনে জলাশয়, পরিবেশ শব্দ নাই। এগুলো যুক্ত
করতে হবে রাজউকের বোর্ডেও পরিবর্তন আনার কথা বলেন তিনি। এছাড়া বলেন,
সরকারের ভূমির খতিয়ানকে অনলাইনে আনতে হবে। যেন সবাই তা দেখতে পায় এবং
স্বচ্ছতা থাকে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাসযোগ্য
শহর গড়া খরচের ব্যাপার নয়, সুশাসনের ব্যাপার, শহরকে বাসযোগ্য করতে স্বল্প
খরচে যে সব সমস্যার সমাধান করা যায়, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় না। তিনি
বলেন, শহর বাসযোগ্য করা, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা খরচের বিষয় নয়, সুশাসনের
ব্যাপার। এতবড় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বানাচ্ছি হাজার কোটি টাকা দিয়ে,
কিন্তু যে কোন অন্য বড় শহরে ঢাকার মত গণপরিবহন যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী
উঠানামা করে না, এটা তো কোন খরচের ব্যাপার না। এটা সুশাসনের ব্যাপার।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, নদী দখলমুক্ত, পরিবেশকে সুরক্ষা ও সুশৃঙ্খল
গণপরিবহনের মাধ্যমে পুরো দেশকে বাসযোগ্য করা ঐসব এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের
চাইতে অনেক বেশি জরুরী ছিল। স্বল্প খরচের সমাধান যেগুলো শুধু সুশাসনের বিষয়
সেগুলোতে অগ্রাধিকার না দিয়ে অনেক বড় বড় প্রকল্প হয়। এগুলোর দরকার আছে,
কিন্তু সেগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকার থাকতে হবে। খরচের সাশ্রয় করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব ও বাসযোগ্য শহর প্রসঙ্গে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশের শহরগুলোতে
যেন বাসযোগ্যতার সূচক করা হয়। তাহলে জবাবদিহি তৈরি হবে। স্থানীয়
কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা গড়ে উঠবে। শহর টেকসই ও পরিবেশবান্ধব
হচ্ছে কিনা সেটাও জানা যাবে। সামগ্রিক আলোচনার সারমর্ম খুজলে পাওয়া যায়,
পরিকল্পিত নগরায়নের জন্য শহরে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনতে
হবে। নিউইয়র্ক শহরে সড়ক থেকে শুরু করে আবাসন ও সবধরনের সেবা সিটি
কর্পোরেশনের আওতায়। আমাদের রাজধানী ঢাকায় দুটি সিটি কর্পোরেশন থাকলেও
শহরের বেশির ভাগ সেবা ও গুরুত্বপূর্ণ খাত সিটি করর্পোরেশনের আওতায় নেই। যে
কারনে নগরায়নের ক্ষেত্রে সিটি করপোর্রেশনগুলো তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না।
তাই বিশে^র উন্নত শহরগুলোর মধ্যে নগর ব্যবস্থাপনায় একক কর্তৃপক্ষের আওতায়
সবকিছু চলতে হবে। এ সম্মেলন থেকে আশা সুপারিশ ও প্রস্তাবনা নীতি
নির্ধারকদের দিয়ে পাশ করিয়ে তাহা বাস্তবায়ন করে মহানগর ঢাকাকে বাসযোগ্য
করতে হবে।
লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ