
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ ||
অনেক দোদুল্যমানতার পর বন্দিত্বমুক্তি ঘটল এ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর। এরই মধ্যে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। শুরু হয়েছে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত নীতিতে ক্লাস নেওয়া। যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকরাও সতর্ক থাকছেন। শুরুতে দেশের কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের কারও কারও মধ্যে করোনা সংক্রমণের কথা শোনা গিয়েছিল। এতে কিছুটা আতঙ্কও ছড়িয়েছিল। পরে প্রমাণ পাওয়া যায়নি স্কুলে এসে তারা সংক্রমিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ দিন কেটে গেছে। সারাদেশেই স্কুল-কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এ পর্যন্ত আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু শোনা যায়নি।
বিশ^বিদ্যালয় খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছিল না। এর পেছনে বড় কারণ ছিল আবাসিক হল প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোর হল ব্যবস্থাপনার অরাজকতা কাটেনি। কক্ষগুলোতে ধারণক্ষমতার বেশি শিক্ষার্থীদের থাকতে হয়। আর আছে গণরুম। এক রকম গাদাগাদি করেই সেখানে বাস করতে হয় ছাত্রছাত্রীদের। এই বাস্তবতায় শারীরিক দূরত্ব মানা প্রায় অসম্ভব। এ কারণেই সম্ভবত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সহসা সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। কিন্তু শিক্ষাজীবন প্রায় পৌনে দুবছর পিছিয়ে যাওয়ায় ক্রমে অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে থাকে শিক্ষার্থীরা। এর পরই বিশেষ মনোযোগ দেয় সরকার পক্ষ। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশ^বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের টিকা দেওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। যদিও এখনো টিকা দেওয়ার পাট চুকে যায়নি। তবুও কিছুটা গুছিয়ে নেওয়ার কারণে এবং সংক্রমণের হার শতকরা পাঁচের নিচে নেমে আসায় মন্ত্রণালয় সবুজ সংকেত দিয়েছে। এর আলোকেই বিশ^বিদ্যালয়গুলো যার যার সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে হল খোলা ও ক্লাস শুরুর তারিখ ঘোষণা করেছে।
সিদ্ধান্তের সূত্রে হল প্রশাসন ও বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন ইতোমধ্যে হল ও ক্লাস রুমের প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজও শেষ হয়েছে এর মধ্যে। তারিখমতো শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করছে হলে। অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন করে যেন জীবন ফিরে পাচ্ছে বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যেই যে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার স্বস্তি কাজ করছে তা নয়, প্রত্যেকটি বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘিরেই অনেকগুলো পরিবার বেঁচে থাকে। খাবারের দোকান, চায়ের দোকান ইত্যাদি নানা ধরনের ছোটখাটো ব্যবসা সাজিয়ে বসেন অনেকে। এভাবে অনেকগুলো পরিবার বেঁচে থাকে প্রধানত ছাত্রছাত্রীদের ওপর ভর করে। এমনিতে বড় ভ্যাকেশন হলে দুশ্চিন্তায় কাটে এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পরিবারগুলোর। কিন্তু কোভিড সব হিসাব ওলটপালট করে ফেলেছে। দীর্ঘ বন্ধে অনেকে জীবিকা হারিয়ে পথে নেমেছে। বিশ^বিদ্যালয় খোলার খবরেও এদের কেউ কেউ আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব তারা।
বিশ^বিদ্যালয় খোলার পরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ সবার সামনে। প্রায় দুবছরের শিক্ষা ঘাটতি কী করে মেটানো যাবে। অনলাইন ক্লাসে কিছুটা ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষা নেওয়া নিয়ে ইউজিসির গাইডলাইন এগিয়ে চলার গতি কিছুটা শ্লথ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে তেমন খবরদারি না থাকায় সেখানে অনলাইনে নেওয়া ক্লাস ও পরীক্ষা যথাসময়েই হয়ে আসছে। তবে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের হল না থাকার পরও সশরীরে ক্লাস নেওয়ার ঘোষণা কেন দিতে পারছে না এ এক বিস্ময়! মনে রাখতে হবে অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা একটি আপৎকালীন ব্যবস্থা মাত্র। সরাসরি ক্লাসের প্রকৃত বিকল্প নয়। এভাবে শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত না করে বিশ^বিদ্যালয়কে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাই। এ ব্যাপারে ইউজিসির তৎপরতাও আমরা দেখতে চাই।
আমি হলে ফেরা-ক্যাম্পাসে ফেরা শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ জানাব তারা যেন সতর্কতার সঙ্গে নতুনভাবে তাদের ক্যাম্পাসে ও হলে জীবন চালনা করে। কোভিড কালটিতে আমি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি অনেক ছাত্রছাত্রী স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সতর্ক থাকেনি। অন্তত অনেকের মধ্যে মাস্ক পরায় অনীহা দেখেছি। অনেকের মধ্যে এমন বিবেচনা কাজ করছে- যেহেতু টিকা দিয়েছি এবং সংক্রমণের হার অনেকটা নেমে গেছে তাই আমরা সব নিরাপদ হয়ে পড়েছি। কিন্তু মানতে হবে, সংক্রামক ব্যাধিকে যদি সুযোগ করে দিই আবার সে জেগে উঠতে পারে। এই বৈশি^ক বিপদে কারও এমন বিবেচনা করা উচিত নয় যে, স্বাস্থ্যবিধি মান্য করা না করা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কারণ ব্যক্তি আক্রান্ত হলে তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। সে তার বন্ধু ও পরিবারকে আক্রান্ত করবে। এভাবে সংকটে পড়বে পরিবার, সমাজ ও দেশ। শিক্ষার্থী এবং ক্যাম্পাসবাসীদের অসহযোগিতায় আবার ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাক এমন দুর্ভাগ্য আমরা বরণ করতে চাই না।
হল প্রশাসনেরও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। হলের পরিবেশ যাতে স্বাস্থ্যানুকূল হয় সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এই সত্যটি বিবেচনায় রাখতে হবে যে, দীর্ঘ কোভিডকালের কারণে ছাত্রছাত্রী অনেকের মনে ও শরীরে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এতে আচরণেও তৈরি হতে পারে সংকট। তাই সহানুভূতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষকদের শিক্ষা ও কারিকুলাম নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো শিক্ষক নিয়মমতো ক্লাস নেন না। অমন অশিক্ষকসুলভ আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি একটি ইয়ারের পরীক্ষা কমিটির সভাপতি। আমাকে ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন করতে হবে। তাই ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ ছাত্রীটিকে বললাম, কোন ক্লাস কতটা বাকি আমাকে জানাও। ও জানাল, প্রায় ক্লাসই শেষ হয়ে গেছে। শুধু দুটো কোর্সের অধিকাংশ ক্লাসই বাকি। অনলাইনে এতদিন ঘরে বসেই ক্লাস নেওয়ার সুযোগ ছিল তার পরও শিক্ষক অধিকাংশ ক্লাসই নিতে পারেননি। এমন দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা থেকে বেরোতে হবে। আমরা আশা করব এ ধারার শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে সতর্ক হবেন।
ক্যাম্পাসে একটি বড় উপদ্রব রাজনৈতিক অস্থিরতা। ক্ষমতাসীন সরকার সমর্থক ছাত্ররা ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় দাপিয়ে বেড়াতে পারেনি। এখন আবার স্বমূর্তি ধারণ করলে ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিঘ্নিত হবে। এ ব্যাপারে ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে অনুরোধ থাকবে যে, তারা যেন নিকট-অতীতকে মনে রাখে। প্রায় পৌনে দুবছর কোভিড কী ভয়ঙ্করভাবে আমাদের ওপর চড়ে বসেছিল। এখনো সে আমাদের সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে যায়নি। আমরা কত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব হারিয়েছি। নতুন করে আর সংকট বাড়াতে চাই না। অসুবিধা কী, যদি ভাবতে পারি কোভিডকে অতিক্রম করে আমরা একটি নতুন সময়ে পা রেখেছি। এবার তো আমরা শুদ্ধতার শপথ নিতে পারি। এবার না হয় ছাত্রের গৌরব ও সৌন্দর্যকেই প্রতিষ্ঠা করার পথে হাঁটি! তবে আমরা জানি ওরা একা শুদ্ধতার পথে হাঁটতে পারবে না। কেন্দ্রীয় নেতা ও মূল দলের নেতানেত্রীদেরও অভিন্নভাবে ভাবতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের আচরণ কেমন হতে হবে সে বিষয়ে নির্দেশনা দিতে হবে কেন্দ্র থেকেই।
বিশ^বিদ্যালয়ের আরেক অস্বাস্থ্যকর দিক হচ্ছে শিক্ষক রাজনীতি। সামনে ডিসেম্বরে প্রায় বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হবে। ছোটাছুটি বাড়বে শিক্ষকদের একাংশের। আশা করছি শিক্ষকরা সতর্ক থাকবেন। দীর্ঘ বিরতির পর বিশ^বিদ্যালয় খুলেছে। ছাত্রছাত্রীরা অনেক আশা ও হতাশার মধ্যে রয়েছে। ক্লাস-পরীক্ষার কোনো ধরনের শৈথিল্য ওদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। আশা করি শিক্ষার্থীরা হতাশ হবে না।
পাকিস্তান আমল থেকে এবং বাংলাদেশ আমলের অনেকটা সময় পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ অর্থাৎ ডাকসু, রাকসু, জাকসু এবং হল সংসদগুলো বহাল ছিল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নিজেদের নেতৃত্ব তৈরি করত। এতে যেমন ছাত্রদের মধ্যে সুস্থ রাজনীতি চর্চা হতো তেমন ছাত্র কল্যাণের পক্ষে নানা দাবি নিয়ে লড়াই করার পথ উন্মুক্ত থাকত। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আমরা অনেককাল পরে হলেও ডাকসুর যাত্রা শুরু হতে দেখেছি। তবে এর করুণ পরিণতি দেখতেও সময় লাগেনি। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বজায় রাখার জন্য এসব দলের অঙ্গ তথা সহযোগী সংগঠনগুলো উন্মত্ততা ছড়ায়। গণতান্ত্রিক কাঠামো বহাল থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধাপগুলোয় এখনো শিক্ষকদের ভোটাধিকারের সুযোগ রয়েছে। ভোটের মাধ্যমে ডিন নির্বাচিত হয়, শিক্ষক সমিতির নির্বাহী পর্ষদ গঠিত হয়; সিনেট, সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকটি সদস্য পদ নির্বাচিত হয় আর সবশেষে সিনেটরদের ভোটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচিত হয়। দুর্ভাগ্য এই, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত গণতান্ত্রিক কাঠামোটি ঠিক থাকলেও এর প্রায়োগিক শক্তিটি চলে গেছে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের হাতে। তাদের ম্যাকানিজমে ভোট নিয়ন্ত্রণের নানা উপায় কার্যকর থাকে।
প্রত্যাশা করব কোভিড-ঝড়ের পর আমাদের শুভ আত্মচৈতন্যে ফিরে আসব। সুস্থ-স্বাভাবিক ক্যাম্পাস উপহার দেওয়ার জন্য মনে মনে শপথ নেব ক্যাম্পাসসংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মানসিক বৈকল্য থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সরব করতে হবে। এজন্য পৃষ্ঠপোষকতার হাত বাড়াতে হবে প্রশাসনকে।
একটি বড় দুর্যোগের পর নতুনভাবে সেজে ওঠে পৃথিবী। আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও অতীতের সব জরামুক্তির পর এবার নতুন সূর্যোদয় ঘটুক। আমাদের সবার প্রত্যাশা থাকবে সরকার, বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই এই নতুন প্রভাতকে স্বাগত জানাবে। একটি সুন্দর ক্যাম্পাস গড়ে তোলার দায় ও দায়িত্ব সবারই।
লেখক:অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়