কুমিল্লায় হত্যা মামলায় আওয়ামীলীগ নেতা সেকান্দর চেয়ারম্যানসহ ১৪ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
|
কুমিল্লার কাগজ রিপোর্ট।। কুমিল্লায় পারভেজ (৩০) নামে এক ছাত্রদল নেতাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আদর্শ সদর উপজেলার কালির বাজার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও কালির বাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সেকান্দর আলী, কালিরবাজার ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলামসহ ১৪ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন কুমিল্লার অতিরিক্ত দায়রা জজ ২য় আদালত। সোমবার (২২ এপ্রিল) বিকালে কুমিল্লার অতিরিক্ত দায়রা জজ নাসরিন জাহান এ রায় প্রদান করেন। আসামীদের মধ্যে তিন জন পলাতক থাকলেও সেকান্দর আলী চেয়ারম্যানসহ ১১ জনের উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করা হয় এবং রায় ঘোষণা শেষে তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়। সাজাপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের সমর্থক নেতাকর্মী। উল্লেখ্য, নিহত পারভেজ কালির বাজার ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেও তাকে ছিনতাইকারী হিসেবে উল্লেখ করে প্রথমে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করা হয়েছিল। এদিকে এ রায় ঘোষণা পর আদালত পাড়ায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয় এবং অনেকে মনে করেন এই রায় ঘোষণার ফলে আইন ও আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা সুদৃঢ় হবে। এ ঘটনার মামলায় কুমিল্লার অতিরিক্ত দায়রা জজ ২য় আদালত হত্যায় জড়িতদের দোষী সাব্যস্ত করে ১৪ জনকে প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন। জরিমানা অনাদায়ে আরো ৫ মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবি মোঃ শরিফুল ইসলাম। মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী মোঃ শরিফুল ইসলাম বলেন, মামলায় ৩১ জন স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য গ্রহণ শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাদের প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন। বাদী পক্ষের আইনজীবী আরো বলেন, ১৪ জন আসামীর মধ্যে মোঃ কাওছার, মোঃ রিয়াজ ও বিল্লাল ছাড়া ১১ জন হাজির ছিল, এ ৩ জন পলাতক রয়েছেন। আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন ক্যান্টনমেন্ট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক শেখ মাহমুদুল হাসান রুবেল। তিনি ঘটনার সময়ের সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করেন এবং অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তিনি পিসিপিআর যাচাই করে দেখেন নিহত পারভেজের নামে থানায় মামলার রেকর্ড রয়েছে। তদন্তকালীন সময়ে নিহতের মা গোলাপী বেগম বাদি হয়ে আদালতে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে আর অজ্ঞাত ৯/১০ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দাখিল করলে আদালত তা সিআর হিসেবে মামলা আমলে নেন। একই ঘটনায় এক মামলায় পুলিশ মামলাটি তদন্ত করতে থাকায় আইন অনুযায়ী সিআর মামলা চলমান থাকতে পারে না বলে আদালত সিআর মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে তদন্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ প্রদান করেন । ২০২০ সালের ২৮ জুলাই মামলাটির তদন্তভার সিআইডি ঢাকা গ্রহণ করে এবং কুমিল্লা সিআইডির এসআই হুমায়ূন কবির তদন্তের দায়িত্ব পান। তিনি একটি মোবাইলের মেমোরি কার্ড জব্দ করে ঘটনার সময়ে ভিডিও চিত্র সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে যাচাই করেন এবং আসামীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার প্রমাণ হিসেবে মোবাইল নম্বরের সিডিআর যাচাই করেন এবং ঘটনাস্থলে তাদের উপস্থিতির প্রমাণ পান। পরে ২১ সালের ২৪ এপ্রিল মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান ঢাকা সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগেরর উপ পুলিশ পরিদর্শক মো: সিরাজ উদ্দিন। তিনি তদন্তকালের আসামী কামাল হোসেনকে কোতয়ালী মেেডল থানার একটি মাদক মামলায় গ্রেপ্তারের জন্য আদালতে আবেদন করেন এবং গ্রেপ্তারের পর বিজ্ঞ আদালত দুই দিন করে ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। কামাল হোসেনকে রিমাণ্ডে আনা হলে সে ঘটনা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবান বন্দি প্রদান করে। পরে হোসেনপুরের হারুনুর রশিদের ছেলে আবদুল কাদের (৪৪), রায়চৌঁর মৃত আবদুল ওহেদের ছেরে মোঃ ইব্রাহীম খলিল (৪৫) ও সৈয়দপুরের আবদুস সাত্তারের ছেলে মোঃ সাদ্দাম হোসেন (৩২) কে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারাও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন। তদন্ত চলাকালে ধনুয়াখোলা তালতলা ফাজিল মাদ্রাসার পাশের আবদুল লতিফের ছেলে মোঃ শাহিন আলম(৩৯) বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকায় হজরত শাহজালাল বিমান বন্দরে গ্রেপ্তার হন এবং ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ঠতার করা স্বীকার করেন। আদালতে দাখিলকৃত চার্জসীট থেকে জানা যায়, নিহত পারভেজ পেশায় একজন ড্রাইভার ছিল। এছাড়া তার ২টি মারতি গাড়ি ও ৩টি অটোরিকশা ভাড়ায় দেওয়া হতো। তার তিন জন সন্তান রয়েছে। ১নং কালির বাজার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সেকান্দর আলী ২৩ বছর ধরে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। দীর্ঘ দিন চেয়ারম্যান থাকার কারণে এলাকায় তার বেশ প্রভাব আছে। নিহত পারভেজ ও সেকান্দার ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত উভয়ে বিএনপি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল এবং পরস্পরের মধ্যে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। রাজনেতিক পট পরিবর্তনের পর সেকান্দার বর্তমান ক্ষমতাশীন দলের সমর্থক হিসেবে যোগদান করে এবং সরকারি দলের লোক হিসাবে তার ক্ষমতার দাপট দেখাতে থাকে। পক্ষান্তরে ভিকটিম পারভেজ খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত তার পূর্বের রাজনৈতিক মতাদর্শে অনড় ছিল এবং বিভিন্ন অপকর্মেও জড়িত ছিল। তবুও সেকান্দার আলী চেয়ারম্যানের অনৈতিক বিভিন্ন কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে নিহত পারভেজ শোচ্চার ও প্রতিবাদী ছিল। এ কারণে চেয়ারম্যান সেকান্দার আলী নিহত পারভেজ এর প্রতি চরম ক্ষোভ ও প্রতিশোধ পরায়ণ ছিল। চার্জসীটে বলা হয়, মোঃ শাহিন, মোঃ সাদ্দাম হোসেন, মফিজ @ মফিজ ভাণ্ডারী, মোঃ সাইফুল ইসলাম, মোঃ কাওছার, বিল্লাল, মোঃ রিয়াজ @ রিয়াদ চেয়ারম্যানের লোক হিসেবে চলাফেরা করত। আনুমানিক ২/৩ বছর আগে চেয়ারম্যান সেকান্দার আলীর ঘনিষ্ঠ সহচর শাহিনকে কে বা কারা গুলি করে। গুলি শাহিনের গায়ে লাগে। চেয়ারম্যান ও শাহিন ধারণা করে, পারভেজ শাহিনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। এর জের ধরে পারভেজ এর সাথে চেয়ারম্যানের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। সেকান্দার আলী চেয়ারম্যানও পারভেজকে চাপে রাখার জন্য শাহিনকে গুলি করার ঘটনাটি পারভেজই ঘটিয়েছে মর্মে শাহিনসহ তার ঘনিষ্ট জনদের বুঝায়। যাতে শাহিন'সহ অন্যান্যদের দিয়ে পারভেজকে একটি উচিৎ শিক্ষা দেয়া যায়। ঘটনার দিন আসরের নামাজের পর অনুমান পৌণে ৬টার সময় ভিকটিম পারভেজ তার বাচ্চাদের জন্য লিচু কিনতে তার বাড়ি হতে বেড় হয়ে সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের গেইটের সামনে সাক্ষী মোঃ মনির হোসেন এর দোকানের সামনে গিয়ে লিচুর দাম জিজ্ঞাসা করে। পূর্ব পরিকল্পনামতে ঐ সময় ঘাতক মোঃ শাহিন (৩৯), ২। মোঃ সাদ্দাম হোসেন (৩২), মোঃ সাইফুল ইসলাম (২১), মোঃ কাওছার (৩২), বিল্লাল (৩৪), মোঃ রিয়াজ @ রিয়াদ, মোঃ ইব্রাহিম খলিল (৪৫), আনোয়ার (৫০), রুবেল (৩৫), জয়নাল আবেদীন @ ল্যাংড়া জয়নাল (৩১), আব্দুল কাদের(৪৩)রা হাতে চাপাতি, লোহার রড, হকিস্ট্রিকসহ দেশীয় অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিহত পারভেজকে ঘেরাও করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সেকান্দার আলী চেয়ারম্যানের নির্দেশে পারভেজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর পূর্বক প্রথমে একটি মোটর সাইকেলে উঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে রাস্তায় চলমান একটি মারতি গাড়ী থামিয়ে তাতে ভিকটিম পারভেজকে উঠিয়ে মারধর করতে করতে কমলাপুর বাজারে আসামী কামালের 'স'মিলে নিয়ে আসামী কামাল, মফিজ @ মফিজ ভান্ডারিসহ অন্যান্য আসামীরা তাদের হাতে থাকা লোহার রড, হকিস্ট্রিক দিয়ে এলোপাথারীভাবে পারভেজকে পেটাতে থাকে। তখন আসামী কামালের বড় তাই সেলিম (বর্তমানে মৃত) 'স'মিল থেকে আসামীদেরকে চিল্লাচিল্লি করে বের করে দিলে আসামীগণ ভিকটিম পারভেজকে নিয়ে 'স'মিল হতে অনুমান ২০০ গজ পূর্ব দিকে মোকশদ আলীর কাঠের বাগানের ভিতর নিয়ে ভিকটিমের হাটু ও কনুইতে পেরেক ঢুকিয়ে হাত পা থেতলে ও হাড় ভেঙ্গে মুমুর্ষ অবস্থায় ফেলে রাখে। নিহত পারভেজের বোন জামাই সাক্ষী সোহেল ভূঁইয়াকে পারভেজ এর মামা সাক্ষী চাঁন মিয়া ফোন করে বলে, 'পারভেজকে সেকান্দার চেয়ারম্যান এবং তার গুন্ডা বাহিনী সৈয়দপুর স্কুল গেট থেকে উঠাইয়া নিয়ে গেছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ি নিহত পারভেজকে পুলিশের কাছে ছিনতাইকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং স্বাক্ষীরা সেকান্দর চেয়ারম্যানের ভয়ে পুলিশকে প্রকৃত ঘটনা বলে নি। পুলিশের এসআই মাহবুবুর রহমান বাদি হয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনার বিবরণ দিয়ে ১০০/১৫০ জনের বিরুদ্ধে৩০২/৩৪ ধারায় মামলা দায়ের করেন। |