শিক্ষার্থীদের
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা,
ধ্বংসাত্মক ঘটনা প্রতিরোধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় ব্যর্থতা সামনে চলে
এসেছে। খোদ দলের ভেতর থেকেই এ অভিযোগ উঠেছে।
আর এই ব্যর্থতার দায়ে দলের বিভিন্ন স্তরের কমিটি ভেঙে দেওয়া ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে সাংগঠনিক শুদ্ধি অভিযান চালানোর চিন্তা-ভাবনা চলছে।
কোটা
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ঢাকাসহ সারা দেশে যে ব্যাপক সন্ত্রাস,
সহিংসতা, সংঘাত, ধ্বংসযজ্ঞসহ হতাহতের ঘটনা ঘটে তা প্রতিরোধে আওয়ামী লীগের
নেতাকর্মীদের ভূমিকার মূল্যায়ন শুরু করেছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। এ
সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে দলের নেতাকর্মীরা রাস্তায় নামলে এ ধরণের ঘটনা
প্রতিরোধ করা যেত বলে তারা মনে করছেন। তবে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সেই
ধরণের ভূমিকা বা প্রতিরোধমূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। এ জন্য দলের
বিভিন্ন স্তরের কমিটির দায়িত্বশীল নেতাদের দায়ী করা হচ্ছে।
কোটা
আন্দোলনের এক পর্যায়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে থাকলে আওয়ামী লীগের
পক্ষ থেকে বলা হয়- ‘আন্দোলন এখন শিক্ষার্থীদের হাতের নেই’। এই আন্দোলন
সরকার বিরোধীদের হাতে চলে গেছে এবং সরকার উৎখাতের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
গত
১৭ জুলাই দলের এক যৌথ সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দলের নেতাকর্মীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান
জানিয়ে বলেন, আপনারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রস্তুত হয়ে যান। নেত্রীর পক্ষ থেকে
নির্দেশ দিচ্ছি সারা দেশে শক্ত অবস্থান নিয়ে এই অশুভ অপশক্তিকে প্রতিহত
করতে হবে। এখন কোটা নিয়ে আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নেই। এখানে
সরাসরি বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রদল-ছাত্র শিবির এই আন্দোলনকে সরকার উৎখাতের
আন্দোলনে পরিণত করতে চাচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা আমাদের করতেই হবে।
আওয়ামী
লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই দিনের পর
পরিস্থিতি যখন আরও অবনতি ও অস্থিতিশীল হয়ে উঠে তখনও দলের কেন্দ্র থেকে
দায়িত্বশীল নেতাদের বার বার নির্দেশ দেওয়া হয় বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে
তুলতে, নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে অবস্থান নিতে। কিন্তু তারা সারা দেয়নি এবং
অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেতাদের পাওয়া যায়নি। দায়িত্বশীল নেতাদের নীরব
ভূমিকার কারণে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক
প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ওই সব নেতাদের এই অবস্থানকে অনেকেই অনেকভাবে
মূল্যায়ন করছেন।
আওয়ামী লীগের ওই নেতারা আরও জানান, দীর্ঘদিন দল
ক্ষমতায় থাকার কারণে নেতাকর্মীরা ‘রিল্যাক্স মুডে’ থাকতে অভ্যস্ত হয়ে
পড়েছে। আবার গা বাঁচিয়ে চলার প্রবণতাও দেখা দিয়েছে। তবে কে কার চেয়ে বড়,
কার ক্ষমতা বেশি এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। ক্ষমতাকে ব্যবহার
করে কীভাবে অর্থ সম্পদ করা যায় সে মানসিকতা অনেককে পেয়ে বসেছে। আবার নিজের
গ্রুপ ভারি করতে প্রভাবশালী নেতারা অযোগ্যদেরকে বিভিন্ন কমিটিতে ঢুকিয়েছে ও
গুরুত্বপূর্ণ পদেও দিয়েছে।
এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভিন্ন দল থেকে আসা লোকজনও রয়েছে। আওয়ামী
লীগের কমিটিগুলোর পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনগুলোর একই অবস্থা। দলের কিছু
কর্মসূচিতে এরা ব্যানার নিয়ে আসে, প্রত্যেকেই নিজেদের বড় বড় জমায়েত দেখানোর
চেষ্টা করে। সংকটের সময় ওই নেতারা যারা বিভিন্ন কমিটিতে নেতৃত্বে রয়েছে
তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এগিয়ে আসেনি। তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি, গা ঢাকা
দিয়ে থেকেছে। শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা গেলে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব
হতো বলে তারা মনে করেন।
গত ২৫ জুলাই রংপুরে এক মতবিনিময় সভায়
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রংপুরে আওয়ামী লীগের
নেতারা ফেল করেছেন, তারা ঘুরে দাঁড়ালেই দুর্বৃত্তরা নাশকতা করতে পারত না।
আওয়ামী
লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা ফেল করায়
তারা এসব করতে সাহস পেয়েছে এবং করেছে। ঘুরে দাঁড়ালেই আর এসব করতে পারত না।
আমার কষ্ট হয়, আপনাদের পার্টি অফিস যখন ভাঙচুর করল, তখন আপনারা নাই। অথচ,
পার্টি অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ভিডিওতে দেখা গেল মাত্র কয়েকজন এ ঘটনা
ঘটিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে গত কয়েক দিনে ঢাকায় দলের বিভিন্ন স্তরের
নেতাকর্মীদের নিয়ে বেশ কয়েকটি সভা করেছেন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক
পর্যায়ের নেতারা। সেখানে বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বশীল নেতাদের বিরুদ্ধে এই
ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকার অভিযোগ উঠে এসেছে। ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর
উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও দলীয় এমপিদের নিয়ে কয়েকটি সভা
হয়েছে। এ সব সভায় যে সব অভিযোগ এসেছে তার ভিত্তিতে বিভিন্ন কমিটি ভেঙে
দেওয়া ও কমিটি পুনর্গঠনের বিষয়টি নিয়ে ভাবা হচ্ছে।
তাৎক্ষণিকভাবে, গত ২৫ জুলাই এক সভায় ঢাকা মহানগর উত্তরের মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরে বাংলানগর থানার ২৭ ইউনিট কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
এ
বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক উইলিয়াম
প্রলয় সামাদ্দার বাপ্পী বলেন, ২৭ ইউনিট কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে৷
এই সব কমিটির কাউকে আন্দোলন মোকাবিলায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরা দলের কোনো
কর্মসুচিতে আসেনি এ কারণে ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে,
ঢাকা উত্তরের এ কমিটিগুলোর মতো আরও অনেক কমিটির বিষয়ে মূল্যায়ন হবে; এমনকি
ভেঙেও দেওয়া হবে। শুধু ঢাকায় নয় সারা দেশেই এ ধরণের সাংগঠনিক শুদ্ধি অভিযান
চালানো হবে। পরিস্থিতি আরও উন্নতি হলে দলের সাংগঠনিক এ বিষগুলোতে হাত
দেওয়া হবে। তবে এ বিষয় নিয়ে দলের নেতারা এখনই কোনো মন্তব্য করতে বা কোনো
কথা বলতে চাচ্ছেন না।