রোজা
এলেই পথের পাশে বাহারি ইফতারির দোকান চোখে পড়ে। পাড়া-মহল্লা থেকে নগরীর
ব্যস্ততম এলাকা– সবখানে একই চিত্র। বিভিন্ন ধরনের মুখোরোচক ইফতারির পসরা
নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। এসব মুখোরোচক খাবার কিনতে ভাসমান দোকানে মানুষের ভিড়
লক্ষ্য করার মতো। এর মধ্যে বেশিরভাগই স্বল্প আয়ের মানুষ। অস্বাস্থ্যকর
পরিবেশে তৈরি এসব খাবার নগরীর সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
শুক্রবার
(২২ মার্চ) রাজধানীর পল্টন ও গুলিস্তান এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে,
রাস্তার ধুলাবালি, যানবাহনের ধোঁয়া ও নোংরা পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে
ইফতারি। সঙ্গে রয়েছে বিক্রেতাদের অপরিচ্ছন্নতা এবং খাবার সংরক্ষণের অনিয়ম।
জনস্বাস্থ্য
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, অনিরাপদ খাদ্যের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের
নজরদারি বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে নজর দিতে হবে এসব খাবারের মান উন্নয়নের দিকে।
রাস্তার
পাশে বিক্রি করা ইফতারি অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর জেনেও কিনছেন স্বল্প আয়ের
মানুষ। এ বিষয়ে কথা হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী আব্দুর রহমানের
সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাস্তার পাশের ইফতারি স্বাস্থ্যকর না, এটা আমরা জানি।
কিন্তু বাইরে কাজ করার কারণে বাসায় ইফতারি বানানো সম্ভব হয় না। তাই বাধ্য
হয়েই রাস্তার পাশ থেকে কিনতে হয়।’
আরেক ক্রেতা মাহমুদ বলেন, ‘আমরা জানি,
এসব খাবার পরিষ্কার না। কিন্তু কিছু করার নেই। সরকারের উচিত রাস্তার পাশের
অস্বাস্থ্যকর ইফতারি বিক্রি বন্ধ করা।’
রাস্তার পাশের এক দোকান থেকে
ইফতার কিনে খাচ্ছিলেন আবুল হোসেন নামে এক শ্রমিক। এসব খাবার স্বাস্থ্যকর
কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভালো জিনিস খেতে দাম বেশি লাগবে, সেটা পাবো
কই? যা পাওয়া যায় তাই খাই।’
এ দিকে উন্মুক্ত স্থানে ধুলাবালি ও নোংরা
পরিবেশে খাবার তৈরি করতে দেখা যায় বিক্রেতাদের। তৈরির পর সেসব খাবার
পরিবেশনও করা এইভাবে। ঢেকে রাখা কোনও খাবার সেখানে চোখে পড়ে না। উল্টো পাশে
থাকা ময়লার স্তুপ ও ড্রেনের মাছি দেখা যায় খাবারের ওপর। এ বিষয়ে
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বললে তারা নানা অযুহাত দেখান।
গুলিস্তান
স্টেডিয়াম মার্কেটের পাশে ইফতার বিক্রি করেন মমিন মিয়া। তার কোনও খাবারই
ঢাকা ছিল না। কেন ঢেকে রাখেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢেকে রাখলে মানুষ
দেখে না, বিক্রি কম হয়। তাই খোলাই রাখি। খোলা রাখলে খাবারগুলো দেখা যায়,
বিক্রিও বেশি হয়।’ আরেক বিক্রেতা মো. আসলামও জানান একই কথা।
‘ঢেকে রাখলে
গরম খাবার নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য খোলা রাখি। অল্প সময়ের মধ্যে আমার খাবার
বিক্রি হয়ে যায়, বেশি ধুলাবালি পড়ে না।’ বলেন বিক্রেতা আমিনুল।
গুলিস্তানের বিক্রেতা সজিব বলেন, ‘ইফতারের সময় তাড়াহুড়া করে বিক্রি করতে হয়। এ সময় কি ঢেকে কাজ করা যায়? খোলা একটু থাকেই।’
রাস্তার
পাশে বিক্রি হওয়া ইফতারির মান নিয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা.
লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘রাস্তার পাশে যে সব ইফতারি বিক্রি হয়, সেগুলো
বেশিরভাগই থাকে খোলা। বাংলাদেশের বাতাস পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাস। আমাদের
বাতাসে যে দূষণ থাকে, সেগুলো ওই খোলা খাবারের ওপরে পড়ে। এতে খাবারগুলো
দূষিত হয়। ওই খাবার খেলে পাতলা পায়খানা, বমি যেমন হয়, তেমনই পাকস্থলীর
হজমের কাজটিও বিঘিœত হয়। এ সব খাবার তৈরিতে যে পানি ব্যবহার হয়, সেগুলোও
নিরাপদ না। ওই ইফতারি খাওয়াতে পানিবাহিত রোগও হতে পারে। আবার এ খাবারগুলো
অতি ভাজার কারণে খাবারের গুণগত মান যেমন নষ্ট হয়, তেমনই অতি ভাজা খাবার
ক্যানসার তৈরিতে সহায়ক।’
তিনি বলেন, ‘রাস্তার পাশের খাবারগুলো সাধারণত
দামে কম হয়। এই কম দাম রাখার জন্য বিক্রেতারা একই তেল বারবার ব্যবহার করেন।
এতে তেলের গুণ নষ্ট হয়ে ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। যেটি হার্ট
অ্যাটাক, স্ট্রোক ও রক্ত সরবারহকারী ধমনির ভেতরের নলটিকে সরু করে দেয়।
একইসঙ্গে এটিও ক্যানসার তৈরির উপাদান।’
চলার পথে যাদের ইফতার করতে হয়
তারা কী করতে পারেন জানতে চাইলে ডা. লেলিন বলেন, ‘রাস্তার পাশের খাবার
রোজাদারদের পরিহার করাই উত্তম। যারা বাসার ইফতার করতে পারেন না, তারা বাসায়
তৈরি ইফতারি সঙ্গে বহন করতে পারেন। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে
যদি নজরদারি করা হয় এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার যারা তৈরি করেন, যদি তাদের
আইনের আওতায় আনা যায়, তাহলে এসব খাবারের মানও কিছুটা উন্নয়ন করা যাবে।
ওয়াসার পানি যেন নিরাপদ ও সুপেয় হয়, সে দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর
দিতে হবে।’
কীভাবে সচেতনতা বাড়ানো যায়, জানতে চাইলে এই জনস্বাস্থ্য
বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে খাবারের মান নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে
হবে। জনগণকে প্রতিনিয়ত বিক্রেতাদের প্রশ্ন করতে হবে– খাবার খোলা কেন, পানির
উৎস কী। একইসঙ্গে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষকেও
জানাতে হবে। মাঝেমধ্যে কর্তৃপক্ষ যদি খাবার পরীক্ষা করে তাহলে রাস্তার
পাশের খাবারের মান উন্নত হতে পারে।’