রোববার ১ জুন ২০২৫
১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লার রসমালাই
জহির শান্ত
প্রকাশ: শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০২৪, ১:১৭ এএম |

শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লার রসমালাই
জিবে জল আনা স্বাদের আদি আসল খাঁটি রসমালাই মানেই কুমিল্লা। দেশের মানুষের কাছে এ পরিচয় নতুন কিছু নয়। তবে পরিচয়টিকে বিশ্বজুড়ে দবাংলাদেশের ‘নিজস্ব’ করে নিতে কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারের রসমালাই ইতোমধ্যে অর্জন করে নিয়েছে জিআই বা ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি কুমিল্লার ঐতিহ্যের পারদে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। শতবর্ষের ঐতিহ্য বহন করা রসমালাই কুমিল্লা ও এর আশপাপাশের অঞ্চলের মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছে আলাদাভাবে। অতিথি আপায়্যন কিংবা ছোট-বড় অনুষ্ঠান আয়োজন- সবকিছুতেই মাতৃ ভান্ডারের রসমালাই থাকে সব সময়। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে এ অঞ্চলের মানুষ রসমালাইকেই বেশি গুরুত্ব দেন। পাশাপাশি থাকে অন্যান্য মিষ্টির সমাহারও। তবে কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডারের রসমালাইয়ের কদরই বেশি।
কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর এলাকায় অবস্থান মাতৃ ভান্ডারের। এখানেই একটি ভিটি-পাকা টিনশেড ঘরে তৈরি ও বিক্রি হয় রসমালাই। এছাড়াও মাতৃ ভান্ডারের দুই পাশে দুটি এবং উল্টো পাশে আছে আরো একটি মিষ্টির দোকান। কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে রাজগঞ্জগামী সড়কের ডান পাশে মনোহরপর এলাকায় পাশাপাশি অবস্থানে আছে তিনটি মিষ্টির দোকান। প্রথমে ভগবতী পেড়া ভান্ডার এরপর মাতৃ ভান্ডার এবং শীতল ভান্ডার। তবে সারাদিনই ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে মাতৃভান্ডারের সামনে। কুমিল্লা নগরী ছাড়াও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি অন্যান্য জেলা থেকেও ক্রেতারা এসে মাতৃ ভান্ডারের রসমালাই কিনে নিয়ে যান। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর এ ভিড় যেনো আরো বেড়েছে। ক্রেতাদের ভিড়ে হিমসিম খেতে হয় মাতৃ ভান্ডারের কর্মচারীদের। তবে হাসিমুখেই ক্রেতাদের ভিড় সামলান তারা।
মাতৃ ভান্ডারে প্রতি কেজি রসমালাই বিক্রি হয় ৩৫০ টাকা দরে। এছাড়াও এখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ৩০০ টাকা কেজি, মালাইকারি ৩২০ টাকা কেজি, ক্ষীর ৫৪০ টাকা কেজি, ছানা মুড়কী ৮০০ টাকা কেজি, স্পেশাল পেড়া ৬০০ টাকা কেজি এবং দধি ২২০ টাকা কেজি। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে ক্রেতাদের কাছে চাহিদার শীর্ষে মাতৃভান্ডারের রসমালাই।
পটুয়াখালী থেকে কুমিল্লায় ঘুরতে এসেছেন ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত নাঈম পাহালন তুর্য। এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে মাতৃ ভান্ডারের রসমালাই কিনতে এসেছেন তিনি। তুর্য বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই শুনেছি কুমিল্লার রসমালাই খুবই বিখ্যাত। আজকে সুযোগ পেলাম একেবারে মাতৃ ভান্ডার থেকে সরাসরি ঐতিহ্যবাহী রসমালাই কিনে নিয়ে যাওয়ার। কুমিল্লায় যেহেতু এসেছি, তাই এখানকার অরিজিনাল রসমালাইটা না খেয়ে যাচ্ছি না। আমার বন্ধুর কাছে এটাই আবদার ছিলো এবং শেষ পর্যন্ত এখানে আসলাম। আশা করছি তৃপ্তি নিয়েই খাবো।
ঢাকা থেকে ব্যক্তিগতকাজে কুমিল্লায় আসা কবির হোসেন বলেন, এর আগে বিভিন্নজনের মাধ্যমে কুমিল্লা থেকে মাতৃ ভান্ডারের রসমালাই নিয়ে খেয়েছিলাম। আজকে যেহেতু কুমিল্লায় এসেছি, তাই ভাবলাম নিজেই কিনে নিয়ে যাই। কারণ রসমালাই বিভিন্ন জায়গা থেকেই কিনে খাওয়া হয়। কিন্তু কুমিল্লার রসমালাইয়ের মতো স্বাদ আর কোথাও পাই না। এটার স্বাদ ও তৃপ্তিই আলাদা।
কুমিল্লা শহরের বাসিন্দা সালমা খাতুন বলেন, কয়েকদিন পরপরই আমি এখান থেকে রসমাইল কিনে নিয়ে যাই। আমার শহরের এমন স্বাদের ও ঐতিহ্যের রসমালা না খেয়ে থাকতে পারি না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লায় রসমালাইয়ের আদি উদ্ভাবক ত্রিপুরা রাজ্যের ঘোষ সম্প্রদায়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা থেকে ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাহিদা অনুযায়ী এ অঞ্চলের লোকদের বাহারি রকমের মিষ্টি সরবরাহ করতেন। পরবর্তী সময়ে দুধ জ¦াল দিয়ে খির বানিয়ে তার মধ্যে শুকনো রসগোল্লা ডুবিয়ে তৈরি করা হয় খিরসহ রসগোল্লা। এর নাম দেওয়া হয় ‘খিরভোগ’। ১৯৩০ সালের দিকে এই রসগোল্লার আকার ছোট করে দুধের খিরের মধ্যে ডুবিয়ে পরিবেশন শুরু হয় এবং একপর্যায়ে এর নামকরণ হয় রসমালাই। ওই সময় থেকেই ক্ষণীন্দ্র সেন কুমিল্লার মিষ্টি ব্যবসায় রসমালাই বানিয়ে পরিচিতি পেতে থাকেন। পরবর্তীতে তাঁর সন্তান শংকর সেনগুপ্তের হাত ধরে এটি কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে বিকশিত হয় এবং রসমালাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশ-বিদেশে। শংকর সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর বর্তমানে মাতৃ ভান্ডারের রসমালাইয়ের ব্যবসা পরিচালনা করছেন তার ছেলে অনির্বাণ সেনগুপ্ত। তার হাত ধরেই এসেছে রসমালাইয়ের জিআই পণ্যের স্বীকৃতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাতৃ ভান্ডারের ম্যানেজার তপন দে বলেন, আমাদের মাতৃ ভান্ডারের ঐতিহ্যবাহী রসমালাই জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের। এ স্বীকৃতির পর আমাদের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেছে। দূর-দূরান্ত থেকে কাস্টমার এসে রসমালাই কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকে দেশের বাইরেও নিয়ে যাচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য আনন্দের ও গর্বের। আমরা রসমালাইয়ের গুণগত মান ও স্বাদ ঠিক রেখে ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমাদের কাছে কিঞ্চিতমাত্র ডুপ্লিকেট কিছু নেই। খাটি দুধ সংগ্রহ করে যে পরিমাণ রসমালাই তৈরি করা সম্ভব হয়, আমরা ততটুকুই বানাই। কাস্টমারের চাহিদা অনেক আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত দুধের যোগানের অভাবে আমরা সেই চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করতে পারছি না। ইদানিং আবার নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে গ্যাসের সংকট। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গ্যাসের চাপ থাকে না। গ্যাস সংকটের কারণেও উৎপাদন কমেছে।

কীভাবে বানানো হয় রসমালাই:
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মাতৃ ভান্ডারের রসমালাই কীভাবে বানানো হয়, তা জানতে চাওয়া হয়েছিলো কারিগর সুশীল চন্দ্র দাসের কাছে। মাতৃ ভান্ডারে দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রসমালাই তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
সুশীল চন্দ্র বলেন, এখানে বিভিন্ন গ্রাম থেকে দেশি গরুর খাটি দুধ আসে। গোয়ালার কাছ থেকে প্রথমে দুধ সংগ্রহ করা হয়। এরপর ওই দুধ চুলার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় জ্বাল দেওয়া হয়। ১মণ দুধের সাথে ১ কেজি পরিমাণ চিনি মিক্সড করা হয়। এরপর দুই / আড়াই ঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর দুধ ঘন হয়ে ছানায় রূপ নেয়। এরপর ছানা কেটে ছোট ছোট দানাদার মিষ্টির মতো বানানো হয়। পরে রসের মধ্যে দিয়ে সেটি রসমালাইতে পরিণত করা হয়। দুধের ঘনত্ব যত বেশি হবে, রসমালাই তত বেশি সুস্বাদু হবে।
তিনি বলেন, প্রাপ্ত দুধের পরিমাণের উপর নির্ভর করে কী পরিমাণ রসমালাই তৈরি করা যাবে। ১মণ দুধ দিয়ে ১০/১২ কেজি রসমালাই তৈরি করা যায়। দেশের নানা প্রাপ্ত থেকে মানুষজন এসে আমাদের তৈরি রসমালাই কিনে নিয়ে যায়, খেয়ে প্রশংসা করে, শুনতে বেশ ভালোই লাগে।












সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লায় ইসলাম, নারী সমাজ ও উম্মাহর করণীয় শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত
দেশের প্রথম মনোরেল নির্মিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রামে, সমঝোতা চুক্তি সই
নারীকে লাথি মেরে বহিষ্কার হওয়া জামায়াতের সেই কর্মী গ্রেপ্তার
বিৎসীমার ৩.৯ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে গোমতীর পানি
কুমিল্লায় ঘুর্ণিঝড় ‘শক্তি’তে লন্ডভন্ড বৈদ্যুতিক লাইন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশসহ ১৪ দেশের জন্য সৌদির ‘ব্লক ওয়ার্ক ভিসা’ স্থগিত
কুমিল্লায় ধান্দাবাজ গুলো মিথ্যা মামলা দিয়ে বাণিজ্য করছে
কুমিল্লায় অস্ত্রসহ যুবলীগ নেতামাসুদ গ্রেপ্তার
৮২ কেজি গাঁজাসহ ছাত্রদলের আহ্বায়ক আটক
কুমিল্লায় ঘুর্ণিঝড় ‘শক্তি’তে লন্ডভন্ড বৈদ্যুতিক লাইন
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২