
১৯৭৫ সালের ১৫
আগস্ট রাত্রের শেষ প্রহরে যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, তখন হত্যাকারীরা
ভেবেছিল-‘শেখ মুজিবের অধ্যায় শেষ।’ সেদিনের সকালটা অন্যদিনের মতোই ছিল।
‘ভোরের আভায় পাখির কলতানে মুখরিত হওয়ার অপেক্ষায় প্রকৃতি। নতুন দিনের
সূচনায় রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন।
সর্বত্র সাজ সাজ রব।’ কিন্তু না। ঢাকা সেনানিবাস থেকে ট্যাঙক এসেছে
ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। ঘাতকের বুলেটে স্বদেশের মাটিতে
রক্তাক্ত হলো দেশ। বিষাদের কালো ছায়া ধানমণ্ডি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে
ছড়িয়ে পড়ল দেশের সর্বত্র। বেতারে ভেসে এলো-‘আমি মেজর ডালিম বলছি ...’
তার আগের খবর হলো-‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট ছিল শুক্রবার। অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ও
বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর পদার্পণের খবরটি প্রতিটি পত্রিকায় লিড নিউজ
হিসেবে ছাপা হয়। প্রতিটি পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুরো
পৃষ্ঠাব্যাপী প্রকাশ করে ক্রোড়পত্র। ক্রোড়পত্রটির মাঝখানে ছিল বঙ্গবন্ধুর
চশমা পরা ছবি। ছবির ওপারে জাতির জনক কথাটি লেখা ছিল। যার শিরোনাম
ছিল-‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঃ মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের শুভাগমন
উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র।’

১৫ আগস্ট দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠায় বাঁ
পাশের দুই কলামের প্রধান খবর, ‘বঙ্গবন্ধু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন
করবেন।’ খবরের সঙ্গে আরেকটি খবর ছিল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণের সাড়া’
শিরোনামে শেষ পাতায় বঙ্গবন্ধুর একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়ে ফিচার ছিল
‘বঙ্গবন্ধুকে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাগত জানাবে।’
আমরা এখন পর্যন্ত
জানি-বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ায় দেশে কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি। জানা যায় ঐ
সময় দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, ডেইলি অবজারভার ও দি টাইমস প্রকাশিত
হয়েছিল। কারফিউ, পত্রিকা সরবরাহে খুনিদের নিষেধাজ্ঞা এবং চারটি পত্রিকার
সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করে সরিয়ে ফেলার কারণে জনগণের কাছে তা পৌঁছেনি। তবে
সাংবাদিক বোরহান বিশ্বাসের ভাষ্য অনুযায়ী ‘বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কিছু সহকর্মী ও
সাংবাদিকদের বদৌলতে ঐদিনের কাগজ সংরক্ষিত হয়।’ তবে ‘অবৈধ রাষ্ট্রপতি জিয়ার
আমল পর্যন্ত এসব জানা যায়নি।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সেনাবাহিনীর অবৈধ ক্ষমতা দখলের মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পত্রিকাগুলোর শিরোনামও রাতারাতি পাল্টে যায়।
১. ১৬ আগস্ট দৈনিক বাংলা আট কলাম জুড়ে শীর্ষ খবর ছিল- ‘খন্দকার মোশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি’।
উপশিরোনাম ছিল-‘শেখ মুজিব নিহত’। সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ।’
প্রকাশিত খবরেও প্রথম অনুচ্ছেদে লিখা ছিল-
‘শুক্রবার
সকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সাবেক রাষ্ট্রপতি
শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে প্রেসিডেণ্ট খন্দকার মোশতাক আহমদের
নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। সশস্ত্র বাহিনীর এই ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাবেক
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে নিহত হন বলে ঘোষণা করা হয়।’
উল্লেখ্য-
খবরে বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় সাবেক ‘রাষ্ট্রপতি’ শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে
খন্দকার মোশতাক আহমদের নামের আগে ‘প্রেসিডেণ্ট’ শব্দ উল্লেখ করা হয়।
শীর্ষ
খবরের বাঁ পাশে ছিল অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির কাছে মোশতাকের শপথ নেয়ার
ছবি। নীচে পাঁচ কলামে ছিল-‘দুর্নীতির সঙ্গে আপস নেই’ শিরোনামে মোশতাকের
বেতার ভাষণ।
২. দৈনিক ইত্তেফাকের মূল শিরোনাম ছিল-
‘খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ।’
উপশিরোনাম ছিল-
‘দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ, সুবিচার ও মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা।’
শীর্ষ খবর ছিল-
‘রাষ্ট্রপতি
খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জাতির বৃহত্তর
স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে
ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন। শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।’
অন্যান্য খবরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
ক. জাতির বৃহত্তর স্বার্থে-দায়িত্বভার গ্রহণ,
খ. জনসাধারণের স্বস্তির নি:শ্বাস,
গ. মোশতাক সরকারের প্রতি পাকিস্তানের স্বীকৃতি,
ঘ. নয়া সরকারের জন্য জুমার নামাজ শেষে বিশেষ মোনাজাত (ছবিসহ),
ঙ. যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গ,
চ. বিদেশি দূতাবাসের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার আশ্বাস,
ছ. গাজী গোলাম মোস্তফাকে অপসারণ করে বি এ সিদ্দিকীকে রেডক্রসের চেয়ারম্যান নিয়োগ,
জ. নির্দেশাবলী
ঝ. লণ্ডন হাইকমিশন ভবনে বিক্ষোভ ও সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলাসহ কয়েকটি খবর।
৩. দ্য বাংলাদেশ টাইমস-এর শিরোনাম ছিল-
ক. গটঝঐঞঅছটঊ অঝঝটগঊঝ চজঊঝওউঊঘঈণ.
খ. উপশিরোনাম ছিল-
গ. গধৎঃরধষ খধি চৎড়পষধরসবফ রহ ঞযব ঈড়ঁহঃৎু : গঁলরন করষষবফ.
অন্যান্য খবর দৈনিক বাংলা ও ইত্তেফাক পত্রিকার মতোই ছিল।
৪. দ্য বাংলাদেশ অবজারভার-এর শিরোনাম ছিল-
ক. গঁংযঃধয়ঁব নবপড়সবং চৎবংরফবহঃ.
শোল্ডারে ছিল-
খ. অৎসবফ ঋড়ৎপবং ঞধশব ড়াবৎ : গধৎঃরধষ খধি চৎড়পষধরসবফ : ঈঁৎভবি রসঢ়ড়ংবফ.
টিকারে ছিল-
গ. গঁলরন করষষবফ : ঝরঃঁধঃরড়হ ৎবসধরহং ঈধষস.
অন্যান্য খবর-
ঘ. গঁংযঃধয়ঁব ঈধষষং ভড়ৎ ঈড়ড়ঢ়বৎধঃরড়হ.
ঝঢ়বপরধষ চৎধুবৎং.
ঔঁংঃরপব সঁংঃ নব বংঃধনষরংযবফ.
চৎবংরফবহঃ-ড়িৎশ যধৎফ ঃড় রসঢ়ৎড়াব পড়হফরঃরড়হ য়ঁরপশষু.
চধশরংঃধহ ধপপড়ৎফং ৎবপড়মহরঃরড়হ.
স্পষ্টই বুঝা যায়-প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর ওপর সেনাছাউনি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
পত্রিকাগুলোর সম্পাদকীয়গুলোর শিরোনাম ছিল-
১. দৈনিক বাংলা- ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।’
২. দৈনিক ইত্তেফাক- ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা।’
৩. বাংলাদেশ অবজারভার- ‘ঐরংঃড়ৎরপধষ হবপবংংরঃু’.
৪. বাংলাদেশ টাইমস- ‘ড়হ ঞযব ঞযৎবংযড়ষফ ড়ভ হবি বৎধ’.
সে
সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। কর্ণেল এরশাদ (পরবর্তীতে সেনাপ্রধান ও
প্রেসিডেণ্ট) দিল্লিতে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের (এনডিসি) প্রশিক্ষণ
নিচ্ছিলেন। হাইকমিশনে তৃতীয় সচিবের দায়িত্বে ছিলেন মোঃ কামালউদ্দিন। তাঁর
ভাষ্যমতে-
‘১৫ আগস্ট ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। ...
মিশনে ফিরে এসে দেখি কর্ণেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
ওদের কলেজ আমাদের দূতাবাসের পায়ে হাঁটা দূরত্বে।
তখন আমি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তিনি আমাকে বললেন-
- আপনি কি হাইকমিশনের লোক?
- হ্যাঁ, আমি থার্ড সেক্রেটারি।
- এই ছবিটা কেন এখানে আছে?
- কোন ছবিটা?
- ওই যে, ওই যে, শেখ মুজিবের ছবি। ওইটা নামান।
- আপনার কথায় তো এটা নামানো সম্ভব না? আমাদের কাছে যদি নির্দেশ আসে, তাহলে নামাব।
- বাহ আপনি তো একটু অন্যভাবে কথা বলেন?’
এসব ঘটনা আমাদেরকে, জাতিকে সত্যিকার অর্থেই পীড়া দেয়।
বঙ্গবন্ধুর
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তো শুরু হয় ১৯৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে। ঐদিন মওলানা
ভাসানীকে সভাপতি করে একটি ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। পরিষদের
১৫-দফা দাবির মধ্যে সরকারের পদত্যাগ, গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি ও সর্বদলীয়
জাতীয় সরকার গঠন ছিল মুখ্য।
১৯৭৩ সাল শুরু হয়েছিল একটি দুঃখজনক ঘটনার
মধ্য দিয়ে। সেদিন মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সামনে পুলিশের গুলিতে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র মতিউল ইসলাম এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র
মির্জা কাদিরুল ইসলাম নামে দু’জন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী নিহত হয়। তখন ছাত্র
ইউনিয়নের মিছিল থেকে স্লোগান হয়-
নিক্সন-মুজিব ভাই ভাই-এক রশিতে ফাঁসি চাই।
খুনি শাহি-মুজিবশাহি ধ্বংস হোক।
বাংলার মীর জাফর শেখ মুজিব ইত্যাদি।
মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন-
‘পয়লা
জানুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের পেছনে ছাত্র ইউনিয়নের উসকানি ছিল। মিছিল
থেকে ককটেল ছোড়া হতে পারে এই আশঙ্কায় পুলিশ মারমুখী হয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের
সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে দলের উর্ধ্বতন নেতাদের
জ্ঞাতসারেই ইউএসআইএস ভবন সংলগ্ন ন্যাপ অফিসের ছাদে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা
বোমা তৈরি করেছিল।’
২ জানুয়ারি ১৯৭৩ পল্টনে এক জমায়েতে ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঘোষণা দেন-
১.
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর
রহমানকে যে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করা হলো।
২.
শেখ মুজিবকে জাতির পিতা আখ্যা দেয়া হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে
ছাত্রের রক্তে তার হাত কলঙ্কিত করায় ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে ঘোষণায় বলা
হয়-আজ থেকে কেউ আর জাতির পিতা বলবেন না।
৩. শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয়েছিল, আজ থেকে তা বাতিল করা হলো।
উল্লেখ্য,
‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ডাকসু দেয়নি, দিয়েছে ছাত্রলীগের উদ্যোগে কেন্দ্রীয়
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ছাত্রলীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধুকে
সর্বপ্রথম ‘জাতির পিতা’ সম্বোধন করা হয়।
জাসদ জন্মলগ্ন থেকেই সরকার
উৎখাতের ঘোষণা দিয়েছিল। এজন্য তারা ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’ তৈরি করেছিল। এক
পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা।’
জাসদ, ইউপিপি এবং জাগমুই ১৫ আগস্টের পর একটি বিবৃতি দিয়েছিল-
‘বাকশাল
ছিল একব্যক্তির নিষ্ঠুর ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা, যার অবসান আমাদের কাম্য ছিল।
কিন্তু মোশতাকের নেতৃত্বাধীন সামরিক শাসনও কাম্য নয়।’
১৮ আগস্ট সাম্যবাদী দলের বিবৃতিতে বলা হয়-
‘বিগত
১৫ আগস্ট সেনাবাহিনী রুশ-ভারতের নিয়ন্ত্রিত খুনি দুর্নীতিবাজ মুজিব
সরকারকে উৎখাত করেছে। দেশবাসী তাতে আনন্দিত। আমরাও সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক
অংশকে স্বাগত জানাই।’
আতাউর রহমান খান বাকশালে যোগদান করেও ১৫ আগস্টকে ‘নাজাত দিবস’ হিসেবে আখ্যা দেন।
আবদুল
মালেক উকিল সে সময় স্পিকার হিসেবে কমনওয়েলথ পার্লামেণ্টারি সম্মেলনে যোগ
দিতে লণ্ডন গিয়েছিলেন। তিনি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মন্তব্য
করেছিলেন-‘জাতি ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে।’
সরকারি ঘোষণায় বলা
হয়-সংবিধান বহাল থাকবে। ৩০ আগস্ট জারি হয় ‘রাজনৈতিক দল (নিষিদ্ধকরণ)
অধ্যাদেশ। ‘১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর
‘বাকশাল পদ্ধতি’ বাতিল করা হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেণ্ট খন্দকার মোশতাক
আহমদ ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ অগাস্ট অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক
পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িতদের আইনি সুরক্ষা দেন। এই আদেশে বলা হয়েছিল, ১৫ আগস্ট
অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত কারও বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো ধরনের আইনি
ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
একটি বিষয় উল্লেখ করে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন-
‘খন্দকার
মোশতাক একটা কালো টুপি পরতেন। শেখ মুজিব একবার বলেছিলেন, ‘তোরা জানিস না,
ওর কত বুদ্ধি। এই টুপি দিয়েই ঢেকে রাখে।’ এই রামপুরি টুপিকে মোশতাক জাতীয়
পোশাকের অংশ বানালেন। দিল্লি হাইকমিশনের কর্মকর্তা কামালউদ্দিন এ প্রসঙ্গে
বলেন, ‘আমাদের কাছে বার্তা পাঠালেন, পাঁচশো টুপি ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে
পাঠাও।’ উনি জানতেন দিল্লিতে এটা জোগাড় করা সম্ভব।’
এত কিছুর পরও আমি
হিসেব কষে রাজনীতির সরলীকরণ কৌশলের কোনো হদিশ খুঁজে পাই না। শুধু প্রশ্নই
করতে পারি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
তাঁর মন্ত্রিসভায় জাসদের আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু, ওয়াকার্স পার্টির
রাশেদ খান মেনন, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়াকে কেন সদস্য করলেন? আমি জবাব
চাই না, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চেষ্টা করি মাত্র।
১৯৭৫ সালের ১৫
আগস্টের পর ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি উচ্চারণ করা যেত না রাষ্ট্রীয় কোনো
গণমাধ্যমে। সেদিন বাংলার যে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা
পড়েছিল দীর্ঘ ২১ বছর, ১৯৯৬ সালে তা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হলো। তারপরের কাহিনি
একটু স্মরণ করতে চাই।
জিয়া আমলে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে
আসতে বাধা দেয়া হয়েছিল। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাঁকে সভাপতি
করার পর অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে নিঃস্তব্ধ জনগণ যখন জেগে উঠতে শুরু
করে, স্বদেশের মাটিতে শেখ হাসিনা এলেন। ৩২ নম্বর বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি
জিয়া-সরকার। বাড়ির বাইরে সিঁড়িতে বসে মিলাদ-দোয়া-মোনাজাত করেছিলেন। এরশাদের
সময় গণভবনের সকল নথিপত্র পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। সেখানে ছিল শ্রুতি-লেখক
মাহবুব তালুকদারের (মাননীয় নির্বাচন কমিশনার) ৩/৪ শত পৃষ্ঠার বঙ্গবন্ধুর
আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি। শোনা যায়-৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাটিও
নষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু-প্রেমীদের সুকৌশল
ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেক বিপদকে এড়িয়ে রক্ষা করতে সমর্থ হন
তাঁরা। যত চেষ্টাই করা হোক না কেন ২১ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে সকল ক্ষমতা প্রয়োগ
করে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার উদ্যোগ-প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে, যা
ইতিহাসেরই চিরন্তন পাঠক্রম।
মজার বিষয় ছিল ৪ এপ্রিল ১৯৭৯ বাংলাদেশের
দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে একটি
শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। শেখ মুজিব সম্পর্কে বলা হয়, ‘১৯৭৫ সালের ১৫
আগস্ট এক রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে তিনি মৃত্যুমুখে পাতিত হন।’
এখন প্রশ্ন- কেন বঙ্গবন্ধুর নামটি বিস্মৃত করা গেলো না?
ঐ যে বললাম-এটা ইতিহাসের সহজ পাঠক্রম।
‘একটি
জাতির অগ্রগতির অন্যতম প্রধান সোপান হচ্ছে জাতীয় ঐক্য, অভ্যন্তরীণ শান্তি,
শৃঙ্খলা ও সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এ চারটি বিষয় হচ্ছে যে কোনো জাতির
অগ্রগতির প্রধান নিয়ামক। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত দেশকে সঠিক
নেতৃত্বের বলে এক পতাকায় জড়ো করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শক্ত ভিতের ওপর
দাঁড় করাতে পেরেছিলেন গরিবের সন্তান একসময়ের কাঠুরিয়া আব্রাহিম লিংকন।
ভলশোভিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত রাশিয়াকে নতুনভাবে সংগঠিত করে মহাশক্তিধর
রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন মহামতি লেনিন। আফিমের ঘোরে ক্লান্ত-শ্রান্ত
চীনাদের সুসংগঠিত করে মহান চীনকে বৈপ্লবিক উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়েছিলেন মাও
সেতুং। ভারতকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করতে অসাধারণ নেতৃত্বের অধিকারী
ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তুরস্ককে নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ করে মোস্তফা কামাল পাশা
হয়েছিলেন আতাতুর্ক, তুর্কিদের পিতা। জীবনভর সংগ্রাম করে বাংলাদেশকে
পাকিস্তানিদের দুঃশাসন থেকে মুক্ত করে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে দেশ
গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।’
আজ উত্তরটি খুঁজে পেতে হবে
যে, যে স্বপ্ন নিয়ে সারাটা জীবন সংগ্রাম করে জীবনের সোনালি দিনগুলো জেলের
ভেতর নিভৃত কক্ষে মৃত্যুদণ্ডকে মাথায় নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন, সে স্বপ্ন
বাস্তবায়ন করতে কি পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু? সে সুযোগ কি তাঁকে দেয়া হয়েছিল?
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে
উঠেছিল। কিন্তু দুর্বৃত্তেরা ক্ষমতার অন্ধ গলিতে হাঁটে, তা দেখতে পায় না।
তারা জানে না-
‘সাবাশ বাংলাদেশ
পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,
জ্বলে পুড়ে মরে ছাড়খার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
আজ
বঙ্গবন্ধু দৃশ্যত নেই। তাঁর মৃত্যুর ৪৫ বছর পর প্রমাণিত হয়েছে এই নামের
মধ্যে রয়েছে এক অজেয় স্বর্গীয় শক্তি। যে শক্তি আজ বাংলা ও বাঙালির চেতনাকে
আরো শাণিত করে তুলেছে। বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তি দিয়ে লেখাটির সমাপ্তি টানছি-
‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি।
একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত
তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস
ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি
এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’
আজ
প্রমাণিত-হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান-প্রথমে বন্ধু, তারপর বঙ্গবন্ধু এবং পরিশেষে বিশ্ববন্ধু। তিনি সমগ্র
বিশ্বের মানবজাতির শান্তির দূত, উজ্জ্বল প্রতিনিধি।
বঙ্গবন্ধু অকুতোভয়
বীর সেনানী। বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা, তিনি মিশে আছেন বাঙালি জাতির
নিশ্বাসে-বিশ্বাসে। তিনি আমাদের গৌরব, তাঁকে সম্মানিত করলে আমরা হই
সম্মানিত। তিনি বিশ্বের এক কিংবদন্তি পুরুষ, মহামানব।