পূর্বে প্রকাশের পর
তিনি সম্পাদককে চিঠি লিখেন ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’ নামে জাতীয় মহাকবিকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটি লিখেছেন।
তিনি লিখেন-
বন্ধুবর গাজী আব্বাস বিট্কেল সমীপেষু -
“ওরে ভাই গাজীরে
কোথা তুই আজিরে
কোথা তোর রসময়ী জ¦ালাময়ী কবিতা!
কোথা গিয়ে নিরিবিলি
ঝোপেঝাড়ে ডুব দিলি
তুই যে রে কাব্যের গগণের সবিতা।
দাবানল বীণা আর
জহরের বাঁশীতে
শান্ত এ দেশে ঝড় একলাই তুললি,
পুষ্পক দোলা দিয়া
মজালি যে কত হিয়া
ব্যাথার দানেতে কত হৃদি দ্বার খুললি”
‘বিদ্রোহী’
নয় আরো অন্যান্য রচনা নিয়েও বিদ্রুপ অব্যাহত ছিলো। উপরে উল্লিখিত কবিতার
‘অগ্নি-বীণা’ কে দাবানল বীণা এবং বিষের বাঁশী কে জহরের বাাঁশী বলে উল্লেখ
করা হয়েছে।
১৩৩১ বঙ্গাব্দের আশি^ন সংখ্যায় (৪ঠা অক্টোবর ১৯২৪) সজনীকান্ত
দাস, যোগানন্দ দাস এবং অশোক চট্টোপাধ্যায় যৌথভাবে বিদ্রোহীর প্যারোডি রচনা
করেন তা প্রকাশিত হয়। এ প্যারোডি’র রচিয়তা হিসেবে যে নামটি ব্যবহার করা হয়
তাহলো শ্রী অবলানলিনী কান্ত হাঁ এম জেড। বিচিত্র এ নামে বুঝাই যায় এটি
ছদ্মনাম। শনিবারের চিঠি’র দায়িত্ব হয়ে পড়েছিলে যেন নজরুলকে নাস্তানাবুদ
করা। তাই দেখা যায় শুধু বিদ্রোহী নয় নজরুলের অন্যান্য গান গজল নিয়েও ব্যঙ্গ
কৌতুকপূর্ণ প্যারোডি রচনা করেছে। উল্লিখিত তিনজন যৌথভাবে যে প্যারোডি রচনা
করেন তার অংশ বিশেষ নিচে উদ্ধৃত করা হলো। -
“আমি বীর। আমি দুর্জয়, দুধর্ষ, রুদ্র, দীপ্ত উচ্চশির।
আমি বীর।
দুচোখে আমার দাবানল জ¦লে জ¦ল্ জ¦ল্ জ¦ল্
স্তব্ধ বিশ^ ইঙ্গিতে ভ্রুকটির
আমি বীর! আমি বীর!!
ভাবী শ^শুরের হিসাব খতিয়া
তরুণ-বাঙ্গালী সাগর মথিয়া
উঠেছি যে আমি নিছক শুদ্ধ ক্ষীর
আমি বীর! আমি বীর!!
আমি ভাঙি বেঞ্চি ও চেয়ার
আমি করিনা কারেও কেয়ার
হৃদি নিয়ে আমি ছিনিমিনি খেলি
লাখ লাখ তরুণীর
আমি বীর!
দুচোখ আমার প্রলয় জ¦লিছে
স্তব্ধ বিশ^ ইঙ্গিতে ভ্রুকুটির
আমি বীর!!”
শিল্পশৈলী
বা কাব্যমান এ লেখাগুলোর বিষয় নয় বিষয় হচ্ছে নজরুল। যেভাবে হোক যে
অস্ত্রেই হোক তাদের উদ্দেশ্য হলো নজরুলকে ঘায়েল করা। তাই দেখা যায়
‘শনিবারের চিঠি’ এর ১৩৩১ বঙ্গাব্দের আশি^ন সংখ্যায় (৪ অক্টোবর ১৯২৪)
প্রকাশিত হয় বিদ্রোহী’র সবচেয়ে আলোচিত প্যারোডি ‘ব্যাঙ’ এটি রচনা করেন
সজনীকান্ত দাস, দীর্ঘ এ প্যারোডি থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো।
“আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং,
ভৈরব রভসে বরষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং।
আমি ব্যাঙ,
আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ;
শ্রাবণ-নিশায় পরশে আমার সাহসিকা অভিসারিকা
ডেকে ওঠে বাপ বাপ।
আমি ডোবায় কানায় কাদায় ধূলায়
খাটিয়ার তলে - কিম্বা ব্যবহারহীন চুলায়
কদলী-বৃক্ষের কোলেও কখনও রহি;
ব্যাঙাচি রূপেতে বাঁদরের মত”
পুরো কবিতাটির মধ্যেই ‘বিদ্রোহী’ কে ব্যঙ্গ করা নানা উদাহরণ ব্যবহার করা হয়েছে। এ কবিতার অন্যত্র লিখেছেন-
“আমি সাপেরে করিনে কেয়ার,
দাঁড়াওলা যত কাঁকড়ারা মোর এয়ার।
আমি ব্যাঙ, আমি বিদ্রোহী ব্যাঙ
আমি উল্লাসে কভু নেচে উঠি
ড্যাং ড্যাং
আমি ব্যাঙ
দুইটা মাত্র ঠ্যং।
আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়ে খাই,
আমি বুক দিয়া হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।
আমি ভীম ভুজঙ্গ ফণিনী দলিত ফণা,”
শনিবারে
চিঠি ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ থেকে মাসিকে রূপান্তরিত হয়। তখন মাসিক পত্রিকার ৬টি
সংখ্যায় সজনীকান্ত দাস শ্রী কেবলারাম বাজনাদার’ এ ছদ্মনামে ‘কচি ও কাঁচা’
নামে একটি নাটক রচনা করে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করেনে। সেখানে নজরুলের
চরিত্র অংকন করেছেন অত্যন্ত হাস্যকরভাবে। ‘শনিবারের চিঠি’ যেন পণ করেই
নেমেছিলো নজরুলের বিরুদ্ধে তাদের লাগাতার আক্রমণ। আর এ ব্যাপারে সজনীকান্ত
দাস ছিলেন অগ্রণী। বিদ্রোহী প্রকাশের অনেক বছর পর পর্যন্ত তাদের এ আক্রমণের
ধারা চলতে থাকে কবির নানা কবিতা, গান, গজল নিয়ে নজরুল যা লিখেন তার
বিরুদ্ধে লিখতেই হবে এ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর এসব লেখার মধ্যে অত্যন্ত
কুরচিপূর্ণ উদাহরণ লক্ষণীয়। শনিবারের চিঠি ১৩৪১ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায়
এত বছর পরেও নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার একটি প্যারোডি প্রকাশিত হয়।
কবিতাটির নাম ‘কবি বিদ্রোহী’ রচয়িতা চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কবিতাটির অংশ
বিশেষ-
“আমি ভৈরব হাতে বিষাণ
আমি বিষ্ণুর হাতে চক্র
আমি মহাসিন্ধুর নক্র
আমি দুষ্টের মুন্ডিত শিরে
ষষ্ঠী ঘোষের চক্র
আমি অগ্নি আমি অগ্নি
আমি যাহারে বিবাহ করিয়াছি তাহারি ভগ্নি
আমি দিনরাত করি খয়রাত;
করি কারবার লগ্নি।
আমি দেলখোস, আমি দেলওয়ার
আমার হাতে ঘূর্ণিত নিতি হত্যার রাঙা তলোয়ার
আমি ফেরোয়ার, ধূমকেতু মম ‘ফলোয়ার’; ”
‘শনিবারের
চিঠি’ তে সজনীকান্ত দাস নজরুলের অন্যান্য রচনা নিয়ে আরো ১০টি প্যারোডি
রচনা করেছেন। নজরুলের বিদ্রোহী সহ অন্যান্য রচনা নিয়ে ব্যঙ্গ কবিতা রচনা
করেছেন তিনি হলেন মোহিতলাল মজুমদার। মোহিতলাল মজুমদারের ছদ্মনাম ছিলো শ্রী
সত্যসুন্দর দাস, সজনীকান্ত দাসের ছদ্মনামগুলো হলো ভবকুমার প্রধান, শ্রী
অবলানলিনী কান্ত হাঁ, এস, এ, জেড, গাজী আব্বাস বিটকেল, শ্রী সনাতন দেব
শর্মা, শ্রী মধুকর কুমার কাঞ্জিলাল, শ্রী কেবলারাম বাজনাদার, শ্রী বটকুলাল
ভট্টাচার্য্য।
‘শনিবারের চিঠি’ নজরুল ছাড়াও আরো অনেক লেখকের রচনা নিয়েও
কমেডি রচনা করেছে। এছাড়া আরেকজন নজরুলের বিপ্লবী চেতনায় মোটেও উৎসাহ পাননি
এবং তিনি ছিলেন পুরোপুরি নজরুল বিরোধী। ‘বলাহক নন্দী’ ছদ্মনামে লিখতেন তিনি
নীরদ সি চৌধুরী। নজরুলকে নিয়ে সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন সময়। সুতরাং
‘বিদ্রোহী কবিতা তার মধ্যে কোনো প্রভাব তো ফেলতে পারেনি বরং তিনি এর তীব্র
সমালোচনা করেছেন।
‘শনিবারের চিঠি’তে ছয়জন কবি ও লেখককে নিয়ে সমালোচনা
করেছে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগও তুলে ধরেছে। এইসব লেখকরা হলেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮),
বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), অচিন্ত্যকুমার
সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬) এবং কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। ‘শনিবারের চিঠি’
ভাদ্র ১৩৩৪ সংখ্যায় (পৃ. ৮৬) প্রকাশিত শ্রী মধুকর কুমার নামে ‘বিদ্রোহী’
কবিকে উদ্দেশ্য করে লিখেন “তোমাদের প্রতি’ শিরোনামে একটি কবিতা তাতে রয়েছে-
“ওগো বীর
ফেলে দিয়ে কাঁথা আর খাটিয়া তাকিয়া
ওঠো, জাগ, গা ঝাড়িয়া, চক্ষু রগড়িয়া,”
‘শনিবারের
চিঠি’ দীর্ঘদিনের বৈরীতায় নজরুলের বিরুদ্ধে তাঁকে হেয় করে লিখেই গেছে।
অন্যদিকে ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার ছিলো দ্বৈত ভূমিকা। একদিকে নজরুলের কবিতা,
গান, প্রবন্ধ ও বেশকিছু রুবাহ ছাপা হয়। অন্যদিকে নজরুলের চরম বিরোধী লেখা
প্রকাশ করে। ‘মোহাম্মদী’তে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। মোহাম্মদী’র বিভিন্ন
লেখায় ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ধূমকেতু’র সূত্র ধরে বিভিন্নজন তাদের লেখায় নজরুলকে
শয়তান, অনাচারী, নরাধম, খোদাদ্রোহী, ধর্মজ্ঞান শূন্য, বুনো, বর্বর,
ধর্মদ্রোহী, কুলাঙ্গার ফেরাউন নমরুদ, আজাজীল এধরনের বিশেষণে আখ্যা দেয়া
হয়েছিল। এই মোহাম্মদী গোষ্ঠিই নজরুলকে কাফের আখ্যা দেয়। নাজির আহমদ চৌধুরী
মোহাম্মদী’র ১৩৩৫ কার্তিক সংখ্যায় লিখেন “ইসলাম ও নজরুল ইসলাম” নামে একটি
প্রবন্ধ লিখেন সেখানে তিনি নজরুলের বিরুদ্ধে খোদাদ্রোহীতার অভিযোগ তোলেন।
তিনি লিখেন-
যে কবিতা গুলির মধ্য দিয়া তাঁহার কবি প্রতিভা স্ফূরণ লাভ
করিয়াছে বলিয়া বলা হয়- সেখানে তাঁহার প্রধান কৃতিত্ব হইতেছে খোদাকে
অস্বীকার করিয়া, অমান্য করিয়া অপমান করিয়া।
খোদা তা’আলার প্রতি অতি
জঘন্য ভাষায় বিদ্রোহ ঘোষণা করাই তাহার এই পুস্তকের প্রধান বিশেষত্ব। কবি
সেখানে নিজের বিদ্রোহীরূপের পরিচয় দিতে দিতে মোছলেম বাঙলার সম্মুখে যে
আদর্শ উপস্থিত করিয়াছেন কোন আজজীলই আজ পর্যন্ত ততটা করিতে সাহস হয় নাই।
উল্লিখিত
নাজির আহমদ চৌধুরী সহ অন্যদের এসব অভিযোগের প্রতিবাদ করে অনেকে বক্তব্য
দিয়েছেন সওগাত পত্রিকার ৩০ কার্তিক ও ১৪ অগ্রাহায়ন ১৩৬৫ সংখ্যায় তাঁরা হলেন
কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, এ হাদী বিএ। তাঁরা
নজরুলের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ ও এর আসাড়তা প্রমাণ করেছেন। আবার পৌষ
সংখ্যায় এম. আজীজার রহমান মাসিক মোহাম্মদীতে ‘ইসলাম ও নজরুল কাব্য সাহিত্য’
নামে লেখায় নজরুলের বিরুদ্ধে ইসলাম, কোরান, নবী বিরোধী বলে অভিযোগ তোলেন।
সাপ্তাহিক
মোহাম্মদীর ১০ ভাদ্র ১৩৩৩ সংখ্যায় (২৭ আগস্ট ১৯২৬) ‘কাজী সাহেবের সুমতি’
শীর্ষক রচনায় নজরুলকে মোছলমানের কবি’ হিসেবে ফিরে আসা এবং ‘ভোলানাথ শিব
শঙ্কর’ এর পরিবর্তে ‘আল্লাহো আকবর’ ধ্বনির মাধ্যমে কবিতা লেখার আহ্বান
জানানো হয়।
কবি নজরুল ও বিভিন্ন সময় তাঁর কবিতা গান ও অন্যান্য
রচনায় তাঁর নিজের কথা বলেছেন। কখনো কখনো এসব অভিযোগের তীব্র জবাব দিয়েছেন।
বিশেষ করে অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ কে লেখা চিঠিতে তিনি তাঁর মনের কথাগুলো
বলেছেন। অভিযোগের উত্তরে তাঁর ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তিসঙ্গত উত্তর দেয়ার
চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন-
প্রথম গালাগালির ঝড়টা আমার ঘরের দিক
অর্থাৎ মুসলমানদের দিক থেকেই এসেছিল- এটা অস্বীকার করিনে; কিন্তু তাই বলে
মুসলমানেরা যে আমায় কদর করেননি, এটাও ঠিক নয়। যাঁরা দেশের সত্যিকার প্রাণ,
সেই তরুণ মুসলিম বন্ধুরা আমায় যে ভালোবাসা, যে প্রীতি দিয়ে অভিনন্দিত
করেছেন, তাতে নিন্দার কাঁটা বহু নীচে ঢাকা পড়ে গেছে। প্রবীণদের
আশীর্বাদ-মাথার মনি হয়ত পাইনি, কিন্তু তরুণদের ভালোবাসা, বুকের মালা আমি
পেয়েছি। আমার ক্ষতির ক্ষেতে ফুলের ফসল ফলেছে।
তবে নজরুল আঘাত পেয়েছেন,
মানসিক ভাবে তিনি বেদনা জর্জর হয়েছেন তারপরও তিনি থেমে থাকেন নি। নজরুল
এগিয়ে গেছেন সৃষ্টির ফসল ফলিয়েছেন অবিরত। তাঁর চিন্তাকে, তাঁর বিপ্লবী
চেতনাকে তিনি প্রকাশ করে গেছেন নির্দ্বিধায়। তাঁরা আশ্চর্য প্রাণশক্তি ও
তীব্র আবেগ মানবতার মহান আহ্বান তাঁকে আরো বেশি প্রিয় করে তুলেছে সাধারণ
মানুষের কাছে। আবেগের স্ফূরণ ঘটেছে চতুর্দিক ব্যাপে। রবীন্দ্রনাথের পর এত
জনপ্রিয়তা আর কোনো কবির পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। কবির এ বিপুল
জনপ্রিয়তা তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের সকল প্রচেষ্টা স্লান হয়ে গেছে। স্তিমিত হয়
শক্তি-উল্লাস, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নজরুলকে তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ
করেন তখন অনেকেই দমে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে কবি হিসেবেই সম্বোধন
করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজের পরিবার ও নিজস্ব পরিমন্ডলের বাইরে কাউকেই গ্রন্থ
উৎসর্গ করেন নি। নজরুলকে উৎসর্গ করা ছিলো ব্যতিক্রম একটা ব্যাপার। সেসময় এ
বিষয়টিও সাহিত্যমোদী ও সুধীমহলের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।
কবি
মোহিতলাল মজুমদার কবি নজরুলের সাথে প্রথমে সখ্য সম্পর্ক ছিলো। তিনি নজরুলকে
তাঁর শিষ্য বলেও দাবি করতেন। তিনি নজরুলের কাব্য প্রতিভার গুণগ্রাহী
ছিলেন। ফলে তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্কও বিরাজমান ছিলো। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’
প্রকাশের পর মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ প্রকাশ করেন।
তিনি সবচেয়ে বড় অভিযোগটি করেন তাহলো চুরির অভিযোগ। তিনি অভিযোগ করেন তাঁর
‘আমি’ প্রবন্ধের ভাব সম্পদ চুরি করে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করেছে।
মোহিতলাল মজুমদারের এ অভিযোগ তখন বিশেষ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। দেখা যায়
মোহিতলার মজুমদারের ‘আমি’ একটি প্রবন্ধ আর বিদ্রোহী একটি কবিতা। কিছু
সাদৃশ্য অবশ্যই আছে তবে ‘আমি’ কে আত্মসাৎ করা হয়েছে এমন কথা বলা যায় না।
কারণ দুটি লেখার ভাব ভাষা অঙ্গশৈলী সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাদৃশ্য আর চুরি এক কথা
নয়। বিদ্রোহী কবিতার যে ব্যাপ্তী যে প্রকাশ ভঙ্গি, বলিষ্ঠ শব্দ চয়ন ও গতি
তা ‘আমি’ তে নেই। যার ফলে মোহিতলাল মজুমদারের অভিযোগ শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে
পারেনি। ১৩২১ এর পৌষ সংখ্যায় ‘মানসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় মোহিতলাল
মজুমদারের ‘আমি’ প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধের শুরুতে আছে-
আমি বিরাট। আমি
ভূধরের ন্যায় উচ্চ, সাগরের ন্যায় গভীর। নভো-নীলিমার ন্যায় সর্ব্বব্যাপী।
চন্দ্র আমারই মৌলীশোভা, ছায়াপথ আমার ললাটিকা, অরুণিমা আমার দিগন্ত
সীমান্তের সিন্ধুচ্ছটা, সূর্য আমার তৃতীয় নয়ন এবং সন্ধ্যারাগ আমার
ললাট-চন্দন। বায়ু আমার শ^াস আলোক আমার হাস্য জ্যোতি। আমারই অশ্রুধারায়
পৃথিবী শ্যামলীকৃত। অগ্নি আমার বুভুক্ষা-শক্তি, মৃত্তিকা আমার হৃৎপিন্ড কাল
আমার মন, জীব আমার ইন্দ্রিয়। আমি মেরুতারকার মত অচপল।
মোহিতলাল
মজুমদারের ‘আমি’ এর শেষাংশ টুকু এরকম- ‘আমি’ ক্ষুদ্র, আমি বিরাটকে ধারণা
করতে পারি। আমি মরণশীল, কিন্তু অমৃত আমাকে প্রলুদ্ধ করিতেছে। আমি দুর্বল,
কিন্তু আমার চিন্তা-শক্তি ধরণীকে নব কলেবর প্রদান করে। আমি অন্ধ, কিন্তু
ঊর্দ্ধ হইতে আমার মুখে যে আলোক আসিয়া পড়ে তাহাতে ত্রিভূবন আলোকিত হইয়া যায়।
কে বলিবে, আমি কে? এ সমস্যার কে সমাধান করিবে।
বিদ্রোহী কবিতায়
আমরা যে সুর ও বাণী, যে প্রকম্পন ও বলিষ্ঠতা, যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দেখা
যায় তা কিছুতেই এক নয়। বিদ্রোহীতে কবি প্রকাশ্য আত্মপরিচয় ঘোষণা করেছেন।
তার সাথে তাঁর লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন নজরুল বলেছেন- ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন
রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত।’
সুতরাং
মোহিতলাল মজুমদারের যে কথা, যে লক্ষ্য, যে বাণী তার সাথে নজরুলের
প্রকাশভঙ্গি ও বক্তব্য বিস্তর পার্থক্য তো রয়েছেই রয়েছে পার্থক্য সর্বত্র।
তবে কিছু কিছু মিলতো আছেই তবে তা দিয়ে চুরির অভিযোগ করা যায় না। বিদ্রোহী’র
উপমা উদাহরণ চিত্রকল্প অদ্ভুত এবং অপূর্ব যা কল্পনা করা যায় না। তাই
মোহিতলাল মজুমদারের অভিযোগ আলোচনার বিষয় হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর সুধী মহলে
স্থান পায়নি। ‘শনিবারের চিঠি’তে ছদ্মনামে সজনীকান্ত দাস ‘ব্যাঙ্গ’ কমেডি
প্রকাশ করেন, কিন্তু নজরুল এ কবিতাটি মোহিতলাল মজুমদারের রচনা বলে মনে
করেছেন যার ফলে ক্ষুব্ধ নজরুল লিখেন ‘সর্বনাশের ঘন্টা’। ১৩৩১ বঙ্গাব্দের
কার্তিক সংখ্যা ‘কল্লোলে’ এটি প্রকাশিত হয়। সর্বনাশের ঘন্টা’র একটু অংশ-
“রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা।
রুধির-নদীর পার হতে ঐ ডাকে বিপ্লব হ্রেষা।
হে দ্রোণাচার্য! আজি এই সব জয়যাত্রার আগে
দ্বেষ-পঙ্কিল হিয়া হতে তব শে^ত পঙ্কজ মাগে
শিষ্য তোমার, দাও গুরু দাও তব রূপ-মসী ছানি’
অঞ্জলি ভরি’ শুধু কুৎসিত কদর্যতার গ্লানি।
তোমার নীচতা ভীরুতা তোমার, মনের কালি
উদ্গার গুরু শিষ্যের শিরে, তব বুক হোক খালি।
বন্ধু গো! গুরু! দূষিত দৃষ্টি দূর কর, চাহ ফিরে,
শয়তানে আজ পেয়েছে তোমায়, সে যে পাঁক ঢালে শিরে।”
এ কবিতার পর মোহিতলাল মজুমদার ‘দ্রোণ-গুরু’ রচনা করেন। ‘শনিবারের চিঠি’র ১৩৩১ কার্তিক সংখ্যায় কবিতাটি প্রকাশিত তার কিছু অংশ-
“কি বলিস তুই অশ^ত্থামা। আমি মরে যাই লাজে।
আমি ব্রাহ্মণ, তবু বলিব না - ক্ষত্রিয়কুল-মাঝে
হেন কাপুরুষ আছে কোন ঠাঁই - ভীরু, আত্মম্ভরি-
মিথ্যা দম্ভ গর্বের ভরে আপনারে বড় করি’
আপনার পূজা ষোড়ষোপচার। মাগে যে গুরুর কাছে!
অনুষ্ঠানের ত্রুটি পাছে হয়, সদা সেই ভয় আছে!
তাহারি লাগিয়া আক্রোশ করি শিষ্য হইয়া বীর
বন্যবরাহ হনন করা সে ঘৃণ্য ব্যাধের তীর
চিৎকার সহ নিক্ষেপ করে বাতাসের সনে রণ -
বলে পান্ডব - কৌরব গুরু আমার সে প্রিয়জন
পান্ডব সেকি ? কোন পান্ডব ? কে বা সে ছন্নমতি?
আমার নিকটে অস্ত্রশিক্ষা! হায় একি দুর্গতি!’’
এ
দুটি কবিতার মধ্যেই পারস্পরিক আক্রমণের চিত্র ফুটে ওঠেছে। বাংলা সাহিত্যে এ
ছিলো এক অপ্রত্যাশিত বিবাদঅধ্যায় যা সকল কবি সাহিত্যিক তথা
সাহিত্যানুরাগীদের জন্য ছিলো খুব অস্বস্তিকর। যদি কেউ কেউ তা উপভোগও
করেছেন। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় কথা হলো মোহিতলাল মজুমদারের অভিযোগ সুধীমহলে
গ্রহণযোগ্য হয়নি যে নজরুল তাঁর ‘আমি’ প্রবন্ধের ভাববিষয় চুরি করে বিদ্রোহী
রচনা করেছেন। নজরুলের সাথে মোহিতলাল মজুমদারের যে দূরত্ব তখন সৃষ্টি হয়
পরবর্তীকালে সে দূরত্ব আর কাটেনি। এ দিকে কোনো কোনো সমালোচক আবার বিশ^
সাহিত্যের বিখ্যাত কবিতা হুইটম্যান রচিত ‘সং অব মাইসেল্ফ”-এর মিল খুঁজেছেন
তার কিছু সাদৃশ্য থাকলেও এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে বিস্তর। তাই, বিদ্রোহী
নিয়ে যত অভিযোগ কোনোটাই জনসমক্ষে কিংবা সুধী মহলে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
‘শনিবারের চিঠি’র দীর্ঘদিন প্রচেষ্টার পরও নজরুলের গতিকে কিংবা বিদ্রোহী’র
স্বরকে নিম্নগামী করতে পারেনি, থামাতে পারেনি, এগিয়ে গেছে বিস্তৃত হয়েছে।
ব্যাপকতা লাভ করেছে বিপুল জনগোষ্ঠির মধ্যে আজ এ কবিতা ভাষা থেকে ভাষান্তর
হয়েছে বহু দেশে। পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ নজরুলের নাম জানে ‘বিদ্রোহী’
কবিতার মধ্য দিয়ে।
মুসলিম সমাজের আক্রমণ ও নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে
অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁকে লেখা চিঠিতে নজরুল নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন
তিনি লিখেছেন এভাবে-
আবার বলি, যাঁরা মনে করেন- আমি ইসলামের বিরুদ্ধবাদী
বা তাঁর সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছি, তাঁরা অনর্থক এ-ভুল করেন। ইসলামের
নামে যে কুসংস্কার মিথ্যা আবর্জনা স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছে- তাকে ইসলাম বলে না-
মানা কি ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান? এ ভুল যারা করেন, তারা যেন আমার
লেখাগুলো মন দিয়ে পড়েন দয়া করে...
আমার ‘বিদ্রোহী’ পড়ে যাঁরা আমার উপর
বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন, তাঁরা যে হাফেজ রুমীকে শ্রদ্ধা করেন- এ-ও আমার মনে হয়
না। আমি ত আমার চেয়েও বিদ্রোহী মনে করি তাঁদেরে। এঁরা কি মনে করেন, হিন্দ
দেব দেবীর নাম নিলেই সে কাফের হয়ে যাবে? তাহলে মুসলমান কবি দিয়ে বাঙলা
সাহিত্য সৃষ্টি কোন কালেই সম্ভব হবে না।- জৈগুণ বিবির পুঁথি ছাড়া।
[পত্র নং-৩০, ন-র(৪) পৃ. ৪০০]
একই
চিঠিতে নজরুল নিজের মনের কথা গুলো বলেছেন নির্দি¦ধায়। তিনি বিভিন্ন ধারায়
আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। বেদনাকে হজম করেছেন, কারণ তিনি জানেন তিনি কি
লিখেছেন। তাই কবি শত আক্রমণেও নিজে অবিচল থেকেছেন আপনার বাণী ব্যঞ্জনা ও
দৃঢ় কঠিন মনোবলের উচ্চকিত করেছেন আপন ভাবনায়। তিনি আত্মস্থ ছিলেন তাই পরে
তিনি নিজেকে ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। নিজে স্পষ্ট করেছেন। এখানে আমরা নজরুল
মানসকে খুঁজে পাই। তাঁর বিরুদ্ধে হিন্দুত্বের অভিযোগ ও তিনি খন্ডন করেছেন-
বাঙলা-সাহিত্য
সংস্কৃতির দুহিতা না হলেও পালিতা কন্যা। কাজেই তাতে হিন্দুর ভাবধারা এমন
ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, ও বাদ দিলে বাঙলা ভাষার অর্ধেক ফোর্স নষ্ট হয়ে যাবে।
ইংরেজি সাহিত্য হতে গ্রিক পুরানের ভাব বাদ দেওয়ার কথা কেউ ভাবতে পারেনা।
বাঙলা সাহিত্য হিন্দু মুসলমানের উভয়েরই সাহিত্য। এতে হিন্দু দেব-দেবীর নাম
দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায় হিন্দুরও তেমনি মুসলমানদের দৈনন্দিন
জীবন যাপনের মধ্যে নিত্য-প্রচলিত মুসলমানি শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্য দেখে
ভুরু কোঁচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ^াসী। তাই
তাদের এ-সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু
দেব দেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্যে অনেক জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্য হানি
হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি। [ন-র(৪) পৃ. ৪০০]
নজরুল ভেতরে
বেদনা জর্জরিত হয়েছেন আবার নিজেই ওঠে দাঁড়িয়েছেন। সৃষ্টির নব নব ধারা, নব
নব উম্মোচন কবিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে সামনের দিকে। ‘বিদ্রোহী’ যেমন বাংলা
সাহিত্যে একটি বিস্ফোরণের মতো তেমনি এর প্রকম্পন আলোড়িত করেছে দেশের জনগণ
তথা বিশে^র বহু দেশের সাহিত্যামোদী মানুষকে। সুতরাং বিদ্রোহী বাংলা
সাহিত্যের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। আবার ‘বিদ্রোহী’ নিয়ে এত আলোচনা,
সমালোচনা, এর বিরুদ্ধে এত বিষোদগার এত বিরোধিতা আর কোনো কবিতাকে নিয়ে হয়নি।
তাই নজরুল আলোচিত হয়েছেন, আলোড়িত হয়েছেন তুমুলভাবে। তারপরও ‘বিদ্রোহীর’
জয়যাত্রা বিদ্রোহীর জনপ্রিয়তা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে। অনেক সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানে ‘বিদ্রোহী’র দেখা যায় বাচিক শিল্পিদের কণ্ঠে। ফলে বিদ্রোহী’র
আবেদনের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। জনপ্রিয়তার নিরিখে বলা যায় বাংলা
সাহিত্যে ‘বিদ্রোহী’র চাইতে জনপ্রিয় কবিতা আজো সৃষ্টি হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা
হলো ‘বিদ্রোহী’র জনপ্রিয়তা একই ভাবে আজো বিস্তার লাভ করছে। নতুন নতুন
প্রজন্মে নব নব আবেদন সৃষ্টি করছে। দেশ থেকে দেশে নজরুল বিশ^ময় হয়ে উঠছেন।
আজ এ একুশ শতকে দেশে দেশে নজরুল প্রাসঙ্গিক। ‘বিদ্রোহী’ও হয়ে আছে
প্রাসঙ্গিক।