বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ-এ (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি লেখার পূর্বকথন হিসেবে এককালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান প্রধান অধ্যাপক বিজ্ঞানী ড. সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে এক চিঠিতে কবি লিখেছেন-
‘শ্রীমান প্রমথনাথ সেনগুপ্ত এম.এসসি তোমারই ভূতপূর্ব ছাত্র। তিনি শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান- অধ্যাপক। বইখানি লেখার ভার প্রথমে তাঁর উপরেই দিয়েছিলেম। ক্রমশ সরে সরে ভারটা অনেকটা আমার উপরেই এসে পড়ল। তিনি না শুরু করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না। এছাড়া অনভ্যস্ত পথে শেষ পর্যন্ত অব্যবসায়ীর সাহস কুলোত না। তাঁর কাছ থেকে ভরসাও পেয়েছি, সাহায্যও পেয়েছি।’
শান্তিনিকেতন থেকে ২ আশ্বিন ১৩৪৪ (শনিবার ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭) তারিখে পত্রাকারে ভূমিকায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে জানালেন-
‘আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না।’
রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত ‘বিশ্বপরিচয়’ পাণ্ডুলিপির ১ থেকে ১৪৭ পৃষ্ঠা আলোচ্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। পরবর্তী অংশে আছে গ্রন্থ সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্র। উক্ত ১৪৭ পৃষ্ঠার মধ্যে ৬২ পৃষ্ঠা রবীন্দ্রহস্তাক্ষরের, ৬৭ পৃষ্ঠা ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের মুদ্রিত পৃষ্ঠা হলেও রবীন্দ্র হস্তাক্ষরে সংশোধিত বা পরিমার্জিত এবং বাকি ১৮০ পৃষ্ঠা ভিন্ন হস্তাক্ষরে লিখিত কিন্তু রবীন্দ্রহস্তাক্ষরে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত, অনুমান করা যায় উক্ত পৃষ্ঠাগুলো সম্ভবত প্রমথনাথ লিখিত। পাণ্ডুলিপিটি যে প্রাথমিক খসড়া নয় সেকথা বলাই বাহুল্য, কারণ পূর্ব প্রকাশিত ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের পূর্ব সংস্করণের মুদ্রিত পৃষ্ঠা সংকলিত।
প্রমথনাথ যে গ্রন্থটি লিখতে চেয়েছেন তার নাম ‘বিশ্বরচনা’। তা-ই পরে ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে প্রকাশিত। উল্লেখ্য বিজ্ঞান বিষয়ে লিখতে আদিষ্ট হয়ে প্রথমে প্রমথনাথ সেনগুপ্ত লিখা শুরু করলেও পরবর্তীতে তার নাম পরিবর্তিত হয়ে যায়।
একটি তথ্যে জানা যায়- প্রমথনাথ লিখেছেন-
‘সেই দিন সন্ধ্যার পর গুরুদেব ডেকে পাঠালেন উত্তরায়ণে।।---
বললেন, ‘তোমার উপর একটা ভার দিতে চাই, বৈজ্ঞানিক বিষয়ে ‘লোকশিক্ষা পাঠ্যগ্রন্থ প্রণয়নের কাজ।’ সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলাম, তারপর ধীরে ধীরে শুরু হল বই লেখার কাজ।
‘বিশ্বরচনা’ বইয়ের প্রথম অধ্যায় ‘পরমাণুলোক’ লেখা শেষ হয়েছে। গুরুদেব সাগ্রহে গ্রহণ করলেন লেখাটা। বললেন যে, এরই প্রতীক্ষা করছিলেন।’ তার পরদিন গুরুদেবের কাছে যেতেই বললেন, ‘তোমার রচনা পড়েছি।’
এদিকে প্রমথনাথ ‘বিশ্বরচনা’ লিখে প্রায় শেষ করেছেন। গুরুদেব ১৬ বৈশাখ ১৩৪৪ (২৯ এপ্রিল ১৯৩৭) আলমোড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। প্রমথনাথ লিখেছেন-
‘গুরুদেব আলমোড়া যাবার আগের দিন অপরাহ্নে বিশ্বপরিচয়- এর সমগ্র পাণ্ডুলিপি তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে হবে এই ছিল তাঁর নির্দেশ।... খুবই আগ্রহের সঙ্গে গুরুদেব পাণ্ডুলিপিটা গ্রহণ করলেন, বললেন যে আলমোড়ার নিভৃতে বসে ভাষার দিকটা আরও মাজাঘষা করার সময় পাবেন।’
আলমোড়ায় অবস্থানকালে ২৬ বৈশাখ ১৩৪৪ (৯ মে ১৯৩৭) কিশোরীমোহন সাঁতরাকে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখলেন-
‘বিশ্বপরিচয় বইখানা আজো নাড়াচাড়া মাজাঘষা করচি। বশীকে (কৃষিবিজ্ঞানী বশীশ্বর সেন) দেখিয়েছি সে অত্যন্ত খুশি হয়েছে- বইখানা ভালোই হবে।’
অন্য পত্রে লিখলেন-
‘বিশ্বপরিচয় লেখাটা শেষ হয়েছে- সবটাই আমাকে নতুন করে লিখতে হলো বলে দেরি হলো।’
তারিখহীন ভাবে প্রমথনাথ লিখেছেন-
‘জুন মাসে (যতদূর মনে পড়ে) আলমোড়া থেকে গুরুদেবের লেখা কার্ড পেলাম, ‘বিশ্ব-পরিচয় থেকে আমার কলম এখনও ছুটি পায়নি।’ এর কয়েকদিন পরেই শুনলাম খবরের কাগজে নাকি বের হয়েছে- আলমোড়ার সংবাদদাতা জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব-পরিচয় নামে একখানা বিজ্ঞানের বই লিখেছেন, বিশ্বকবি হাত দিয়ে এখানাই প্রথম বিজ্ঞানের গ্রন্থ রচনা’।
আলমোড়া থেকে কলকাতা হয়ে ১৯ আষাঢ় ১৩৪৪ (৩ জুলাই ১৯৩৭) তারিখে সম্ভবত শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ। প্রমথনাথ লিখেছেন-
‘গ্রীষ্মের ছুটির পর গুরুদেব আলমোড়া থেকে ফিরে একদিন সন্ধ্যের সময় ডেকে পাঠালেন...
তারপর বললেন- ‘দেখো, বিশ্ব-পরিচয় লিখতে লিখতে দেখলুম এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না।’- এই তো গেল বিশ্ব-পরিচয় গ্রন্থ রচনার ইতিবৃত্ত।’
প্রস্তুতিপর্ব শেষে বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় থেকে কিশোরীমোহন সাঁতরা কর্তৃক ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বিশ্বপরিচয়’।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গীকৃত ‘বিশ্বপরিচয়’- এর ভূমিকার তারিখ উল্লেখ করে রবীন্দ্রজীবনীচার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (৪র্থ খণ্ড, পৃ-১০৮) লিখেছেন-
‘ছাপার কাজ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ২ আশ্বিন (১৩৪৪) কবি ভূমিকা লিখিয়া দিলে উহা প্রকাশিত হইল।’
সম্ভবত নভেম্বর ১৯৩৭ প্রমথনাথ শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে ঢাকা যান। উল্লেখ্য,
চৎধসধঃযহধঃয ঝবহমঁঢ়ঃধ, যিড় ংবৎাবফ ঃযব ওহংঃরঃঁঃরড়হ ভড়ৎ ঃযব ষধংঃ ভড়ঁৎ ুবধৎং ধং ধফযুধঢ়ধশধধ ড়ভ চযুংরপং রহ ঃযব ঝরশংযধ ইযধাধহধ ষবভঃ ঁং বধৎষু ষধংঃ সড়হঃয ঃড় লড়রহ ঃযব উধপপধ ওহঃবৎসবফরধঃব ঈড়ষষবমব.
১১ ডিসেম্বর ১৯৩৭ নির্মলাকুমারীকে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন-
‘সেই বিশ্বপরিচয়ের সংস্কার করতে বসেছি, সত্যেন্দ্রকে যে চিঠি লিখেছিলুম, সাড়া পাইনে, বোধ হচ্ছে গাণিতিক সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে- লজ্জা হয় ওকে ইস্কুল মাষ্টারি সংশোধনের কথা বলতে।’
২০ জানুয়ারি ১৯৩৮ এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ কিশোরীমোহনকে লিখেছেন-
‘বিশ্বপরিচয়ের এত অত্যধিক খ্যতির দেখে বিস্মিত হলুম। অবশ্য এ বইটির জন্য যত পরিশ্রম করেছি এমন কোনো বইয়ের জন্য করিনি- পরিশ্রম সার্থক হলো।’
‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ বের হওয়ার পর ১৯ এপ্রিল ১৯৩৮ (মঙ্গলবার ৬ বৈশাখ ১৩৪৫) তারিখে প্রেসিডেন্সী কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ঘোষ রবীন্দ্রনাথকে একটি পত্র লিখেন। পত্রটি সম্ভবত অপ্রকাশিত। জ্যোতির্ময় ঘোষ মহোদয় লিখেছেন-
১৯/৪/১৯৩৮
শ্রীচরণেষু,
আপনার ‘বিশ্ব-পরিচয়’ পড়িলাম। পড়িতে পড়িতে কয়েকটি ত্রুটি চোখে পড়িল, তাহাই লিপিবদ্ধ করিয়া আপনাকে পাঠাইলাম। অবসর মত পড়িয়া দেখিবেন।
নমস্কার জানিবেন। ইতি
বিনীত শ্রী জ্যোতির্ময় ঘোষ।
বিশ্ব-পরিচয়
(পৃ: ১১)
ওহফরমড়-কে অতিনীল বলা হইয়াছে। ৪৪ পৃষ্ঠায় আছে- “ঘন নীলরঙের আলোর...।” এস্থলে ঘন নীল কি ওহফরমড়? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে এস্থলেও অতিনীল বলা উচিত।
(পৃ: ১৩)
“বর্ণলিপি” ও “বর্ণচ্ছটা” বোধ হয় একই অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। যদি তাহা হইয়া তাকে, তাহা হইলে দুইটি শব্দ ব্যবহার না করিয়া একটি শব্দ ব্যবহার করাই যুক্তিসঙ্গত। এই ক্ষুদ্র পুস্তকে এত বেশি নূতন কথা আছে, যে একার্থবোধক একাধিক শব্দ ব্যবহার না করাই সমীচীন।
(পৃ: ১৯)
‘তর্জমা’ কথাটা বাদ দিয়া ‘অনুবাদ’ বলিলেই ভাল হয়।
পজিটিভ= হাঁ-ধর্মী, নেগেটিভ= না-ধর্মী। কিন্তু ২১ পৃষ্টায় বলা হইতেছে ‘পজিটিভধর্মী’ এবং ‘নেগেটিভধর্মী’। ভাষাগত সামঞ্জস্য আবশ্যক।
(পৃ: ২২)
“কখনো কখনো দেখা গেছে বিশেষ হইড্রোজেনের...”। হাইড্রোজেন মৌলিক পদার্থ, সুতরাং বিশেষ হাইড্রোজেন কি, একটু বুঝাইয়া বলা আবশ্যক।
ন্যুট্রন=ঘবঁঃৎড়হ. ইংরেজি শব্দটিতে য-ফলা কোনো সংকেত নাই। ‘নিউট্রন’ হইলেই ভাল হয়। কথাটি যদি ঘুঁঃৎড়হ হইত, তাহা হইলে বাংলায় ‘ন্যুট্রন’ লেখা চলিত।
(পৃ: ২৫)
“ইংরেজ বিজ্ঞানী রদরফোর্ড পরমাণুরহস্যকে...। আরেক পণ্ডিত প্রমাণ করলেন যে...। অবশেষে এক গণিত-বিজ্ঞানী প্রমাণ করলেন...।” এস্থলে উক্ত “আরেক পণ্ডিত” এবং “এক গণিত-বিজ্ঞানীর” নাম দেওয়া হইল না কেন? ইহারা উভয়েই প্রসিদ্ধ ব্যক্তি।
(পৃ: ২৮)
“ভিজে হাওয়ার অনুকণার...।” অনুকণা কি?
(পৃ: ২৯)
র্যন্টগন্ রশ্মি। “রেন্ট্গেন” হইলেই ভাল হয়। য-ফলার কোনো ঈঙ্গিত মূলশব্দে নাই। জস্খহঃমবহ শব্দের ্র-এর উচ্চারণ এ-র কাছাকাছি, এবং ব-এর উচ্চারণ স্পষ্ট এ।
(পৃ: ৩৩)
(উপর হইতে দ্বিতীয় লাইন)- ‘চার’ নয় ‘আট’। পৃথিবীর এক মেরু হইতে অন্য মেরুর দূরত্ব কেন্দ্র দিয়া আট এবং বিষুবরেখার উপর দিয়া সাড়ে বারো হাজার মাইল।
(পৃ: ৩৪)
“যন্ত্রশক্তির বল” শ্রুতিকটু। শুধু ‘যন্ত্রের শক্তি’ বলিলেই অর্থ স্পষ্ট হয়।
(পৃ: ৩৫)
কস্মিক রশ্মি। কস্মিক লিখিলেই ভাল হয়, কারণ বাংলায় স্ম-এর উচ্চারণ পৃথক। ‘কস্বা’র কোন অধিবাসীকে পত্র লিখিয়া যদি অকস্মাৎ ঠিকানায় ‘কম্বা’ লেখা হয়, তাহা হইলে কস্মিন্ কালেও তিনি পত্র পাইবেন না। ৩৬ পৃষ্ঠায় ঠিক কস্মিকই লেখা হইয়াছে।
(পৃ: ৩৯)
“মানুষের মান্ধাতার পরমায়ু দরকার হবে”। সর্বাপেক্ষা দূরের গ্রহের সূর্যাবর্ত্তনকাল তিন শ বছরের বেশী নয়। মান্ধাতার পরমায়ু এর চেয়ে অনেক অনেক বেশী।
“নক্ষত্রের ভিড়... ছুটছে।” ভিড় ছুটছে- শ্রুতিকটু।
(পৃ: ৪০)
“... ধুলোর কণা যদি রেখে দেওয়া যায়...”। কণাগুলি একত্র রেখে দিলে তো হবে না। সুতরাং বলা উচিত, “...ধুলোর কণা যদি পরস্পর হতে সমান দূরে রেখে দেওয়া যায়...”
(পৃ: ৪১)
নেব্যুলা-নেব্যুলে। ঘবনঁষধ, ঘবনঁষধব, য-ফলার কোনো সংকেত নাই। ব’য় য-ফলা কেন হইল? ধব- এর উচ্চারণ ‘ঈ’, ‘এ’ নহে। সুতরাং নেবুলা-নেবুলী হইলেই ভাল হয়। যেমন, সীজার, ফরসুলী ইত্যাদি।
ন্যুটন। আবার য-ফলা! ঘবঃিড়হ-এর মধ্য য-ফলার ঈঙ্গিত কোথায়?
পৌঁচচ্ছে। একথাটি হইবে পৌঁছচ্ছে। ক্রিয়াপদটি ‘পৌঁছান-‘পৌঁচান নয়।
প্রতিবেশীর অপভ্রংশরূপে ‘পড়্শী’ হইলেই ভাল হয়।
“অ্যাড্রোপীডা”য় ঈকার কেন?
“এক দূরবীন তার ভিতর খুব বড়ো এক নীহারিকা দেখা গেছে”। ‘তার ভিতর দিয়ে খুব বড়ো...’ এইরূপ হইবে। দূরবীনে ঈকার কেন? দূরবীক্ষণের অপভ্রংশ বলিয়া? তাহা হইলে ‘পড়শী’ কি দোষ করিল?
(পৃ: ৪৪)
“আলোর ঢেউয়ের পরিমাপ...”। পরিমাপের পরিবর্তে দৈর্ঘ্য হইলে ভাল হয়।
(পৃ: ৪৬)
“ঐ পদার্থটির স্থির থাকলে যে পরিমাণ দৈর্ঘ্যরে আলো... পারত কাছে এলে তার চেয়ে বেশি দেয়, দূরে গেলে তার চেয়ে কম দেয়।”
‘কাছে এলে এবং দূরে গেলে’- ইহা ঠিক নয়। কোন পদার্থ কাছে এলে বা দূরে গেলে তাহার আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হয় না। কোনো জ্যোতিস্মান্ পদার্থের দ্রষ্টার অভিমুখে অথবা তা বিপরীত দিকে গতি থাকিলে তৎকর্তৃক বিচ্ছুরিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে পরিবর্তন হয়।
(পৃ: ৪৭)
“একটা চ্যাপটা ঘুরপাক-খাওয়া জগৎ...।” ঘুরপাক-খাওয়া কথাটি বুঝা গেল না।
(পৃ: ৪৮)
‘...সূর্যের গতিবেগ এক সেকেন্ডে দুশো মাইল’। ৫৭ পৃষ্ঠায় আছে, ‘সূর্য দৌড়চ্ছে সেকেন্ডে বারো মাইল বেগে’। এই দুইটি কথার সামঞ্জস্য আবশ্যক।
(পৃ: ৪৯)
মহাটান। কথাটা শ্রুতিকটু। একটি কুমড়া আকারে বড় হইলে তাহাকে মহাকুমড়া বলিলে ভাল শুনাইবে না।
(পৃ: ৪৮)
চড়বিৎ ড়ভ মৎধারঃধঃরড়হ স্থলে ভড়ৎপব ড়ভ মৎধারঃধঃরড়হ হইলে ভাল হয়। গণিতে ভড়ৎপব এবং ঢ়ড়বিৎ একার্থবোধক নহে।
(পৃ: ৫০)
‘কুন্ডলীচক্র পাকানো’ কথাটি একটু বেশী পাকানো হইয়াছে। শুধু ‘কুন্ডলিত’ বলিলেই সম্পূর্ণ অর্থবোধ হয়।
(পৃ: ৫৭)
‘দানব তারা’। অতিকায় তারা বলিলেই ভাল হয়। মরধহঃ ংঃধৎ-এর অনুবাদ ‘দানব তারা’ কতকটা সুবর্ণসুযোগের মত মনে হয়।
‘লাঠিম’ অপেক্ষা ‘লাটিম’ ও ‘লাট্টু’ কথাগুলি অধিক প্রচলিত।
(পৃ: ৫৯)
‘নক্ষত্রেরা পরস্পর... ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে...’। নক্ষত্রের গতি আছে সত্য, কিন্তু তাহাকে ‘ঘুরিয়া বেড়ান’ বলা ঠিক হইবে না। গ্রহ, উপগ্রহ, ধুমকেতু, উল্কা প্রভৃতি সকলেরই গতি আছে। ‘ঘুরিয়া বেড়ান’ কথাটি বরং এইগুলির পক্ষে প্রযোজ্য। নক্ষ্র সম্বন্ধে ওকথা বলিলে সাধারণ পাঠকের মনে ভ্রান্ত ধারণা হইবে। ময়রার দোকানে মাছি ভবন্ ভন্ করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। তাই বলিয়া হাইকোর্টের জজদের সম্বন্ধে বলা ঠিক হইবে না যে তাঁহারা ঘুরিয়া বেড়ান, যদিও তাঁহারাও সচল।
‘গ্রহপরিচয়ওয়ালা নক্ষত্রসৃষ্টি... ব্যাপার’। এই বাক্যের সমস্ত কথাগুলিই সাধু সংস্কৃত কথা। ইহার মধ্যে ‘ওয়ালা’ বড়ই বেমানান হইয়াছে। ‘সমন্বিত’ হইলেই ভাল হয়।
(পৃ: ৫৯-৬০)
‘ব্রহ্মাণ্ডের অন্ত-গোলকসীমা কেঁপে উঠতে উঠতে...।’ অন্তগোলকসীমা কথাটির পরিবর্তে শুধু গোলকসীমা হইলেই ভাল হয়।
(পৃ: ৬৫)
‘সূর্যের যে দাগ...।’ ঝঁহ-ংঢ়ড়ঃ এর বাংলা সৌরকলঙ্ক হইলে দোষ কি?
(পৃ: ৭০)
‘ওর মুণ্ডটা উল্কাপিণ্ড দিয়ে তৈরি।’ উল্কাপিণ্ড কিরূপ বস্তু তৎসম্বন্ধে কিছু না বলিলে তদ্বারা প্রস্তুত দ্রব্যের বিবরণ বুঝা যায় না।
(শেষ লাইন) সধংং-কে ওজন বলা ঠিক হইবে না। ৭৩ পৃষ্ঠায় বস্তুমাত্রা বলা হইয়াছে। ইহা চলিতে পারে, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত-পরিভাষায় প্রদত্ত ‘ভর’ কথাটি ব্যবহার করা যাইতে পারে। সধংং ওজন নহে।
(পৃ: ৭৮)
‘বৃহস্পতি অতিকায় গ্রহ, ..., পৃথিবীর চেয়ে তোরোশো মাইল।’ পৃথিবীর চেয়ে তেরোশো মাইল- একথার অর্থ কি?
(পৃ: ৮৪)
‘তাপমাত্রা হবে ২৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে’। অর্থাৎ ২২৯ ডিগ্রি বা ২২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কিন্তু বক্তব্য তো তা নয়, কারণ পরেই আছে- এতে শীতে অত্যন্ত দুরন্ত গ্যাসও তরল এমন কি নিরেট হয়ে যায়। তাপমাত্রা ২৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে হইলেই এ ব্যাপার সম্ভব নয়। আসল কথাটা এই ‘তাপমাত্রা হবে সেন্টিগ্রেডের শূন্যের ২৩০ ডিগ্র নিচে।’ ভাষাটা একটু অসতর্ক হইয়াছে।
(পৃ: ৯৪)
‘বাতাসকে যৌগিক পদার্থ বলে না।’ যৌগিক কথাটার অর্থ কী? কবিতায় যেমন প্রদোষ বলিলে প্রভাত বুঝায়, তেমনি বিজ্ঞানে কি যৌগিক বলিলে মৌলিক বুঝায়?
(পৃ: ৯৮)
‘শরীরে জ্বরজারি বাতের ব্যথা। ও...।’ জ্বরজারি কথাটা শুনিতে কেমন কেমন হইয়াছে।
(পৃ: ৯৯)
‘অমীবা’। অ্যামিবা হইলেই ভাল হয়। ঈ-কারের প্রয়োজন কী?
সাধারণ বক্তব্য
বিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত জটিল সমস্যাগুলি এত অল্পপরিসরের মধ্যে ব্যক্ত হওয়ায়, বক্তব্য বিবরণীগুলি সহজবোধ্য হয় নাই। পরমাণুলোক এবং নক্ষত্রলোক এই দুইটি অধ্যায়ই সাধারণ পাঠকের নিকট প্রায় অবোধ্য হইয়াছে।
অঃড়স, ঊষবপঃৎড়হ, চৎড়ঃড়হ প্রভৃতি সবই উল্লিখিত হইয়াছে, কিন্তু সড়ষবপঁষব- সম্বন্ধে কোথাও কিছু বলা হয় নাই।
ব্রহ্মাণ্ডের বিবরণ হইতে ছায়াপথ (আকাশপথ) বা গরষশু ডধু একেবারে বাদ পড়াটা অত্যন্ত বিসদৃশ। যে কোনো রাত্রে পরিষ্কাার আকাশের দিকে চাহিলেই সে বিরাট বস্তুটি আমাদের নয়নপথে উদিত হয় এবং যাহাকে অবলম্বন করিয়া ব্রহ্মাণ্ডের আকার, আয়তন প্রভৃতি বিষয়ে বর্তমান যুগের নূতনতম গবেষণাসমূহ অগ্রসর হইয়াছে, তাহার নামোল্লেখ পর্যন্ত নাই!
ঋৎড়হঃরংঢ়রবপব- এর চিত্রটি ব্যতীত মাত্র দুইখানি চিত্র এই পুস্তকে আছে, একখানি শনির এবং অপরটি ধূমকেতুর। আমাদের কুসংস্কারদূরীকরণ এই পুস্তকের অন্যতম উদ্দেশ্য নয় তো!
শ্রীজ্যোতির্ময় ঘোষ
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আলোচ্য বিষয়ে অনেকগুলি অপ্রকাশিত পত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। স্থানাভাবে সবগুলির পূর্ণ বয়ান দেওয়া সম্ভব হলো না।
১৮ বৈশাখ ১৩৪৫ [রবিবার ১ গধু ১৯৩৮] আনন্দবাজার পত্রিকার-র ‘পুস্তক পরিচয়’ অংশে লেখা হয়:
‘বিশ্বপরিচয়ের’ আরও বিশেষত্ব এই যে, এখানি বিজ্ঞানের বই। পরমাণু, নক্ষত্র, সৌরজগৎ প্রভৃতি ইহার আলোচনার বস্তু। এমনি সব বিষয় নিয়েও যে কত সরল ও সহজ ভাষায় রচনা করা চলে তাহা প্রদর্শন করা বোধ হয় একা রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কিন্তু ভাষা লঘু হইলেও রচনার জ্ঞানগৌরব লঘু নহে।
গ্রন্থের সংশোধিত তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় ২৭ ঔঁহ ১৯৩৮ [সোমবার ১২ আষাঢ় ১৩৪৫] কালিস্পঙ থেকে লিখেছেন:
সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার ছাঁচ গড়ে দেবার ইচ্ছা আমার মনে ছিল। আশা ছিল বিষয়বস্তুর ত্রুটিগুলির সংশোধন হতে পারবে বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে।... কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত বিভূতিভূষণ সেন এবং বোম্বাই থেকে শ্রীযুক্ত ইন্দ্রমোহন সোম বিশেষ যত্ন করে ভুলগুলি দেখিয়ে দেওয়াতে সেগুলিই সংশোধন করবার সুযোগ হল।
বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার ছাত্র শশাঙ্ক রায় ২০ আগস্ট ১৯৩৮ (শনিবার ৩ ভাদ্র ১৩৪৫) তারিখক রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি লিখেন। এ চিঠি নানাভাবে চমকপ্রদ। তিনি লিখেছেন-
শ্রদ্ধাস্পদেষু
অতি আগ্রহের সঙ্গে আপনার ‘বিশ্বপরিচয়’ পড়লাম। যখন আরম্ভ করি তখন ভেবেছিলাম যে যাক অবশেষে কবিকে এক জায়গায় কায়দায় পেয়েছি। প্রাণভরে খুঁত ধরব, কসে সমালোচনা করব এই আশায় শুরু করলাম। কিন্তু যত শেষে দিকে যাই ততই হতাশ হই, শেষে অকৃত্রিম বিস্ময়ে বই শেষ করলাম। দুই একটি অতি সামান্য খুঁত এবং একটি মাঝারি ধরনের ছাড়া অনেক চেষ্টা করেও আর কিছুই উল্লেখযোগ্য ত্রুটি পেলাম না।
কাজেই অন্য দিক থেকে সমালোচনা আরম্ভ কর্ত্তে হল। বই আপনার আরও ভাল হল না কেন?
যা ‘নেই তা’ নেই কেন। অবশ্য এ কোনও অভিযোগই নয়-
কিন্তু আপনার বই যখন সকলেই পড়বে (অন্ততঃ এ বই সকলের পড়া উচিৎ), তখন আমাদের দাবী বইটি নিখুঁত, সর্বাঙ্গসুন্দর হোক,...
শ্রীশশাঙ্ক রায়
পুঃ এই চিঠির উত্তরে যদি আপনার স্বহস্ত লিখিত একটা লাইনও পাই, তবে ধন্য মনে করব।
রবীন্দ্রনাথ ২৯ আগস্ট ১৯৩৮ (সোমবার ১২ ভাদ্র ১৩৪৫) উক্ত পত্রের উত্তরে লিখেছেন-
তোমার চিঠিখানি পড়ে খুশি হলুম। শরীরে অস্বাস্থ্য ও জরাজনিত অনবধানতাবশত বিশ্বপরিচয়ে অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। তৃতীয় সংস্করণ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাতে যথাসাধ্য সংশোধন করা হয়েছে- কিন্তু অনভিজ্ঞতার অনিবার্য ত্রুটি ও স্খলন নিশ্চয়ই এখনো রয়েছে।...
আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো।
রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের ভূমিকায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে লিখেছেন-
...‘পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ড্যালহৌসি পাহাড়ে।... তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্ব যাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে বুঝিয়ে দিতেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলুম। -স্যার রবর্ট বল- এর বড়ো বইটা আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দিয়েছে। এই আনন্দের অনুসারী করবার আকাক্সক্ষায় নিউকোম্বস্, ফ্লামরিয়ঁ প্রভৃতি অনেক লেখকের অনেক বই পড়ে গেছি- গলাধঃকরণ করেছি শ্বাসসুদ্ধ, বীজসুদ্ধ।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় প্রকাশিত ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের শেষ তথা পঞ্চম সংস্করণ সম্ভবত প্রমথনাথের সক্রিয় সহযোগিতায় পূর্ণতর হয়ে ওঠে। প্রমথনাথ সেনগুপ্ত ১৯৩৯ সালে পদার্থবিদ্যার অধ্যক্ষ হিসেবে শিক্ষাভবনে পুনরায় যোগদান করে ‘বিশ্বপরিচয়’-এর পূর্ণাঙ্গ সংশোধন করে দিয়েছিলেন। ৯ জানুয়ারি ১৯৪০ সালে শেষ সংস্করণের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
‘এই গ্রন্থে যে সকল ত্রুটি লক্ষ্যগোচর হয়েছে সে সমস্তই অধ্যাপক শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ বিশেষ মনোযোগ করে সংশোধন করেছেন- তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।’
তাই বলা চলে- ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের প্রস্তুতি পর্বের সূচনায় এবং প্রকাশনা পর্বের সমাপ্তিতে সমান সক্রিয় ছিলেন প্রমথনাথ সেনগুপ্ত। তবে প্রশ্ন থেকে যায়- ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থের প্রকৃত লেখক কে?
উল্লেখ্য, প্রতিটি সংস্করণের সংশোধন, পরিমার্জন এবং তথ্য নির্ভর সংযোজন কিন্তু কোনো না কোনো বিজ্ঞান লেখকের সহযোগিতায় পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছে।
[লেখাটি ‘অপ্রকাশিত পত্র: প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপরিচয়- বিজন ঘোষাল, তিনি প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র- গবেষক, তাঁর গবেষণাপত্র থেকে প্রভূত সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে। এই গবেষণা পত্রটি ‘উদ্বোধন’ ১২৪- শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে]