আমরা
স্কুলে থাকতেই বীজগণিতে একটা সূত্র শিখেছিলাম—প্লাসে মাইনাসে মাইনাস হয়।
জানিনা অংকের সেই সূত্রের ভিত্তি বা ইতিহাস কি। কিন্তু সেই সূত্র যে সমাজ
বিজ্ঞানেও একইভাবে প্রযোজ্য তা বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি।
পরিণত হয়ে
জেনেছি যে বিপরীতমুখী জীবন যাপনে জীবনের কোন ‘বরকত’ মেলেনা। বরকত শব্দটি
এখানে ‘ভালো ফলাফল’ হিসেবেই ব্যবহার করছি, এর আভিধানিক অর্থ জানিনা। জীবনের
কাজগুলোকে যদি আমরা সরলভাবেও ভালো এবং মন্দ এই দুইভাবে ভাগ করতে চাই তাহলে
ভালোকে প্লাস মন্দকে মাইনাস ধরতে পারি। এবং এটাতো সত্যি আমাদের জীবনটা
অজস্র ভালো মন্দ কাজের মিশেল। বুঝে না-বুঝেও কিন্তু এই মিশ্রণ তৈরী হয়।
কিন্তু সমস্যাটা প্রকট হয় কখন?
সমস্যা প্রকট হয় তখন যখন এই ভালো
মন্দের পরিমান প্রায় অর্ধেক অর্ধেক হয়। তখন কোনটাই আর প্রাধান্য বিস্তার
করেনা বা জয়যুক্ত হয়না। তখন একজন হয়—না ভালো না মন্দ। না ঘারকা না খাটকা।
এই অবস্থায় একটু ভালোও কিন্তু হারিয়ে যায়। প্লাসে মাইনাসে সবটাই মাইনাস হয়ে
পরে। অংকের সেই সূত্র সামাজিক বিজ্ঞানেরও নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়।
আমি এই
বিষয়টার কোন সরল উদাহরণ দিতে চাইনা। এটিও একটি সূত্র যা সবাই সম্পর্কিত
করতে পারেন নিজের সাথে বা অন্যকেও ব্যাখ্যা করবার ক্ষেত্রে। তবু শুধু একটা
উদাহরণ দেব বুঝবার জন্যে।
উদাহরণটা দেব খুব সহজ একটা বিষয়ে যাতে
সবাই সম্পর্কিত করতে পারেন। তা হচ্ছে ‘ওজন কমানো’। দেখবেন অনেকেই অভিযোগ
করেন যে অনেক চেষ্টার পরেও ওজন কমছেনা। আসলেই ওজন কমানো খুব কঠিন একটি কাজ
এবং এটি নিয়ে পৃথিবীর নানা বাণিজ্য খুবই চোখে পরার মতন। আমার পরিচিত শত
মানুষ আছেন যারা ওজন কমাতে নানা পন্থা অবলম্বন করছেন এবং লক্ষ টাকা খরচ করে
ফেলেছেন। কিন্তু ওজন কমছেনা।
কেউ কখনো একথা বলেনা যে ওজন কমানো
একটি সার্বিক ‘প্যাকেজ’! মানে এটি করতে হলে আপনার একইসাথে সমন্বিত এবং
অসাংঘর্ষিক একাধিক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে যার মধ্যে
প্রত্যয়-খাওয়া-ব্যায়াম-ঘুমসহ ইচ্ছাশক্তির এক দীর্ঘ ঋজু ধারাবাহিকতা
প্রয়োজন। আপনি সকালে একটি করবেন আর বিকালে অন্য আচরণ দিয়ে তা নষ্ট
করবেন—এভাবে ওজন কমবে না। আপনার একটু অর্জন এলোমেলো-ধুলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে
অন্য একটি আচরণে আপনি তা জানছেন না। আপনার খন্ডিত ত্যাগের কোন বরকত পাবেন
না। প্লাসে মাইনাসে মাইনাস। আপনিও তখন ‘ওজনতো কমছেনা’ বলে অসংখ্য
অভিযোগকারীর খাতায় নাম লিখাবেন। বা কোন বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পরে আবার টাকা
খোয়াবেন।
মানুষ অভ্যাসের দাস নয়—অভ্যাস আমাদের দাস। একটা জীবনকে
কিছুদিন হলেও একমুখীন স্থিত রাখা খুব প্রয়োজন। বিপরীতমুখী জীবন খুব হন্তারক
হয়। এটি আত্মক্ষয়ী। জীবনে ধৈর্য ধারণ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্থিতি খুব
জরুরি ভূমিকাপালনকারী আমাদের জীবনে। আপনি স্থিত হলে দেখবেন একটা না একটা ফল
মিলবেই। বরকত পাবেন জীবনের। ওজনও কমবে।
একটা পান দোকানদার দেখবেন
কি নিপুন পান বানাচ্ছে। জুতা সেলাইরত মগ্ন মুচি দেখুন। কারিগরের যত্নে
তালার চাবি বানানো দেখেছেন? গনগনে আগুনে কাজ করা কামার দেখবেন। ছোট ছোট
পেশাগুলো লক্ষ্য করুন। এরা একইরকমভাবে ভালো আছে। পরিবার পরিজন নিয়ে সুখী।
এঁদের জীবনের বরকত আছে। সবটাই প্লাস। তাই ঋণগ্রস্থ ভগ্ন স্বাস্থ্যের
অধিকারী সন্তান উচ্ছন্নে যাওয়া রাতারাতি উত্থিত ফাঁপা শিল্পপতির চেয়ে একজন
স্থিত মুচি বা কামার শুধু সুখী নয়—সমাজেও তার অবদান অনেক বেশি।
জীবনটা অনেক বড় প্লাস মাইনাসের জটিল যোগফল না হয়ে অনেক ছোট কিন্তু সুন্দর একটা প্লাস থাকুক। বরকত থাকবে তাতে...