৬ই মার্চ ২০২৩ইং,
সোমবার দুপুরে সিডি প্যাথ এন্ড হসপিটালের দ্বিতীয় তলায় বসে বিভিন্ন
পরীক্ষার সঠিকতা অবলোকন করতে প্রবেশ করলাম। ঠিক সেই মূহুর্তে হঠাৎ মোবাইল
বেজে উঠল। ডাঃ রেজা ফোন করে বলল, ইমরান খান মনে হয় নাই। ফোন বন্ধ করে এমপি
সীমা খানকে টেলিফোন করব এরই মধ্যে আরেকটি টেলিফোন বেজে উঠল। একই সংবাদ
ঐফোনে। তাই আর দেরি না করে ঠাকুরপাড়ার ইমরানের বাসায় রওনা হলাম। পৌঁছে
ফোনের খবরের সত্যতা পেলাম।

এডভোকেট গোলাম ফারুক, এডভোকেট মিঠু, সীমা
খান এম.পি, শাহীনুর ইসলাম শাহীন, কাউন্সিলর রহমান, আরমানসহ অনেকজন খবরের
সত্যতা জিজ্ঞেস করে জানলাম রাত্রিতে আহার সম্পন্ন করে ঘুমতে যান। সকালে
নাস্তা দিতে গিয়ে দেখেন ডাকের জবাব দিচ্ছেন না। তখন সবাই মুন হাসপাতালে
নিয়ে যান এবং সেখানে চিকিৎসক ইমরান খানকে মৃত ঘোষণা করেন। অনেকক্ষণ আমিও
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। তারপর গোলাম ফারুক ভাই ও জনাব হৃদয়ের সঙ্গে
আলাপচারিতায় কি করতে হবে এ নিয়ে আলাপ করছিলাম। তারা বললেন, লাশ ধোয়ার
দায়িত্ব কাউন্সিলর রহমানকে দিয়ে দিন। অনেক প্রস্তাবের পর রাত ৯ ঘটিকায়
জানাজার সময় নির্ধারণ করা হয়, যাহাতে এম.পি সীমা খান সম্মতি দিয়ে মাইকিং এর
জন্য নির্দেশনা দেয়। জনাব হৃদয় মাইকিং এর ড্রাফটির রচনা করে দেন এবং এরপর
আমরা ঠাকুরপাড়ার বাসা থেকে বিদায় নিলাম জানাজার প্রস্তুতির জন্য। নীচতলায়
নেমে দেখলাম নগরীর সকল শ্রেণি পেশার মানুষ এসেছে। সকলের মাঝে শোকের ছায়া।
দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ছুটে এসেছে তাদের প্রিয় মুখটা দেখার
জন্য। শত শত মোটর সাইকেল রাস্তায় ফেলে জড়ো হয়েছেন লাশবাহী গাড়ীর চতুর্দিকে।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন অনেক নেতা-কর্মী, যুবক-যুবতী।
মাসুদ খান পারভেজ
ইমরান তথা ইমরান খান মাত্র ৪৯ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন। কুমিল্লার বরেণ্য
মরহুম রাজনীতিবীদ অধ্যক্ষ আফজাল খান এডভোকেট ছিলেন তাঁহার পিতা এবং মর্ডান
হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক নার্গিস সুলতানা ছিলেন তাঁহার মাতা।
তিনি স্ত্রী, দুইছেলে, মা, দুইভাই ও এক বোনসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন,
নেতাকর্মী ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। কুমিল্লার সংরক্ষিত মহিলা আসনের এম.পি
আঞ্জুম সুলতানা সীমা খান তার একমাত্র বোন। ৬ই মার্চ ২০২৩ইং, সোমবার রাত্র
৯ঘটিকায় কুমিল্লা টাউনহল মাঠে প্রথম এবং নগরীর চান্দ খাঁ জামে মসজিদে রাত
দশটায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে ঠাকুরপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের
পাশে দাফন কার্য সম্পন্ন করা হয়। প্রথম জানাজায় কুমিল্লা টাউন হল মাঠ ছিল
পরিপূর্ণ। অনেকে মাঠে প্রবেশ করতে না পেরে রাস্তায় জানাজা আদায় করেন।
মাননীয় এমপি হাসেম খান, প্রাক্তন প্রশাসক জেলা পরিষদ আলহাজ্জ ওমর ফারুক,
প্রাক্তন এম.পি হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াসীন, কুমিল্লার সম্মানিত জেলা প্রশাসক,
কুমিল্লার সম্মানিত পুলিশ সুপারসহ কুমিল্লার আপামর জনতা বৃহত্তর জানাজায়
অংশগ্রহন করেন। কান্দিরপাড় মসজিদের ইমাম ক্বারী মোহাম্মদ ইব্রাহিম জানাজায়
ইমামতি করেন। জানাজার পূর্বক্ষণে অনেকেই বক্তব্য রাখেন। তবে তার পরিবারের
পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন মরহুমের ছোট ভাই ডাঃ আজম খান নোমান। নোমান তাঁর
বক্তবে স্পষ্ট ভাষায় বলেন- ইমরান খান তাকে কিছু সামাজিক, পারিবারিক ও
রাজনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন। নোমান সেই দায়িত্বগুলি অক্ষরে অক্ষরে পালন
করার শপথ কুমিল্লার জনতাকে ব্যক্ত করেন।
সাবেক রেলমন্ত্রী, কুমিল্লা
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুল হক মুজিব বলেছেন, “সে
রাজনীতি করলেও তার ভেতরে সারল্যছিল। সর্বসময় হাসিমুখে থাকত। ইমরানের বাবা
প্রয়াত আফজল খান ছিলেন আমার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। তাই ইমরানকে আমি কাছ থেকে
দেখেছি। শুধু রাজনৈতিক নেতাই না, একজন মানুষ হিসেবেও ইমরান অনেক সমৃদ্ধ
ছিল। তার এই অকাল মৃত্যুর ঘটনায় কুমিল্লার ভবিষ্যৎ রাজনীতির একটা অপূরণীয়
ক্ষতি হয়ে গেল। আমি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত
পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।”
দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াছিন বলেছেন, “কুমিল্লার গণমানুষের নেতা ছিলেন এডভোকেট আফজল খান।
আমরা
তাঁর সাথে রাজনীতি করেছি। তিনি প্রয়াত হয়েছেন। আফজল খান সাহেবের
ছেলেমেয়েরাও শৈশব থেকে দেখেছেন বাবা কিভাবে চলাফেরা করেন। কিভাবে মানুষের
সেবা করেন। পরিবার থেকেই সেই শিক্ষাটা পেয়েছিল ইমরান খান। ছেলে বাবার
পদাঙ্ক অনুসরণ করা ইমরান ছিল গণমুখী মানুষ। সবার সাথেই তার একটা ভাল
সম্পর্ক ছিল। মৃত্যু হবে সবার। তবে বড্ড অসময়ে চলে গেল ইমরান।” দেশের
জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী আসিফ আকবর ফেইসবুকে বলেছেন, “এই এক তারিখেই একসাথে
আড্ডা দিলাম। মাসুদ আলীর মৃত্যুর পর আমরা আড্ডায় বন্ধুরা এক সাথেই ছিলাম।
একসাথে পিকনিকে গেলাম। আজ সন্ধ্যায় তাঁর সাথে আমার ঢাকায় মিটিং ছিল।
কুমিল্লা জিলাস্কুলের ৯০ ব্যাচের স্নেহভাজন আদরের ছোট ভাই বন্ধু মাসুদ
পারভেজ খান ইমরান আজ ঘুমের মধ্যেই মারা গেছে।”
শোকসন্তপ্ত পরিবারের
প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এমপি,
এফবিসিসিআই এর সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, মোঃ আমিন হেলালি,
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক আফতাব উল ইসলাম মঞ্জু, বাংলাদেশ তরিকত
ফেডারেশনের কেন্দ্রিয় কমিটির সংগঠনিক সম্পাদক আলহাজ্জ শাহ্ মোহাম্মদ আলী
হোসাইন ও আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। ফুলেল শুভেচ্ছা জানান প্রায়
কুমিল্লার সকল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বিশিষ্টজন।
দেশ বরেণ্য
আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খান ১ বৎসর কয়েক মাস পূর্বে ইন্তেকাল করেন অনেকদিন
অসুস্থ থাকার পর। অসুস্থ অবস্থায় ইমরান খান তার বোন সীমা খান এমপির সঙ্গে
বোঝাপড়ার পর ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার এনে বাবাকে ঢাকার হাসপাতালে স্থানান্তরিত
করেন এবং মৃত্যুর পর কুমিল্লা টাউন হলে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ শোকসভা সংগঠিত
করেন। সকল দলের সকল শ্রেণিপেশার সাথে ইমরান খান সহযোগিতা, সহমর্মিতা
রেখেছেন। যার প্রমাণ তার মৃত্যুর পর টাউন হলে বৃহৎ জানাজার নামাজ।
পরবর্তীতে রাজনীতির হাল ধরার জন্য নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিলেন। একজন
উত্তম ?ীড়া ব্যক্তিত্ব হিসাবেও সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কুমিল্লা
জেলা ?িকেট দলের একজন সফল সংগঠক। আফজাল খানের স্মৃতিকে সমাজে ও ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য গড়ে তুলেছে আফজল খান ফাউন্ডেশন। কুমিল্লার
অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
হওয়ার পথে যাচ্ছিল আফজল খানের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ। ইমরান খান আফজল
খান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সেই সকল প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলী সুনিপুণভাবে জাতীয়
প্রতিষ্ঠানের পর্যায়ে সম্পন্ন করেছেন। আওয়ামী রাজনীতিতে জেলা পর্যায়ের
গন্ডি পেরিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটির সদস্য
নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তিনি ২০১৪ সনে কুমিল্লা সদর আসন থেকে স্বতন্ত্র
প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ব্যবসা বাণিজ্যের
উন্নত ধারা বজায় রেখে সিআইপি খেতাবটি অর্জন করেছিলেন। মেধা ও নেতৃত্বের
যোগ্যতায় তিনি কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি পদবি অর্জন করেছেন এবং
পরবর্তীতে এফবিসিসিআই এর পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হয়ে জাতীয় বাণিজ্য টিমের
সদস্য হয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গীও হয়েছেন। ইমরানের
অনুপস্থিতে ইমরানের সকল ভাল কাজের নেতৃতে গড়ে উঠুক তার ছোট ভাই নোমান সেটাই
সকলের প্রত্যাশা। বোন আঞ্জুম সুলতানা সীমা সংরক্ষিত আসনের এমপি ও আপামর
জনতার নেতৃত্বে যে বলিষ্ঠভাবে চালাচ্ছে তা বজায় রাখুক, গরীব দুঃখী মানুষের
ভরসার আশ্রয়স্থল হিসাবে গড়ে উঠুক এটাই আশা করে কুমিল্লার আমজনতা। সর্বশেষে
পরিবারের পক্ষ থেকে কুমিল্লার সবার নিকট সীমা খানের দোয়া চাওয়া সবাইকে
আবেগাপ্লুত করে এবং আফজল খান পরিবার রাজনীতিতে প্রগতির ধারক হয়ে গড়ে উঠুক
এটাই কামনা করে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ