আজকে আমরা কথা বলেছি কবি আতাউর রহমানের সাথে। তিনি কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার দীর্ঘভূমি গ্রামে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২ সনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, মাতা মৃত ফাতেমা বেগম। তিনি চার ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তৃতীয়। কবির সাথে এই সাক্ষাৎকারে কবি ও কবিতার বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলাপচারিতা হয়েছে। সুখ-দুঃখ, প্রেম-অপ্রেম, সমাজ-সংস্কৃতির এবং ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়াও অনেক অজানা বিষয় উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে।
কাজী আলমগীর: আতাউর ভাই, কেমন আছেন ?
আতাউর রহমান: সৌজন্য কারণে তো ভালো আছি বলতেই হয়। তবে প্রকৃত অর্থে ভালো থাকার মতো এমন কিছু ঘটছে না যা দেখে আশাবাদী হতে পারি। চারপাশে শুধু দুঃসময়ের মুখাবয়ব চোখে পড়ে । ভালো থাকার অভিনয়টাই এখন বেঁচে থাকার শক্তি।
কাজী আলমগীর: আপনার কবিতা পড়েছি। জেগে ওঠা অসংখ্য কবির ভিড়ে আপনার কবিতা ব্যতিক্রম। আচ্ছা, কবিতা লেখার শুরুর দিকের কথা বলুন- শুনি।
আতাউর রহমান: প্রথমেই আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে আপনি আমার কবিতা পড়েন। সেই ছেলেবেলা: আমি তখন মাধ্যমিকে পড়ি, এরই মধ্যে মা গত হলেন। পারিবারিক পরিস্থিতি সময়ের প্রতিকূলে ছিল, কারণ, মায়ের মৃত্যুর পর আমার বাবা নতুন মা ( সৎ মা) ঘরে এনেছেন। ছোট ছোট ভাই বোনদের নিয়ে তখন একটা দুঃসমরের মধ্যদিয়ে যাচ্ছিলাম। বিপরীত সময় ও শোক থেকে নিজেকে পৃথক করতে বইয়ে আসক্ত হায়ে পড়ি এবং সে সময় গল্প, উপন্যাস বা অন্যান্য বইয়ের চেয়ে কবিতার বই বেশি পড়েছি। এরপর একসময় কবিতা লেখার সাধ জাগে। প্রথম লেখটা কি ছিল ঠিক মনে নেই, তবে সেই থেকেই কবিতার পথে যাত্রা শুরু, এখনও অব্দি এ পথেই হাঁটছি।
কাজী আলমগীর: কবিতার নির্মাণ সম্পর্কে নিজের বোধের কথা বলুনঃ
আতাউর রহমান: আপনি তো জানেন, সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা হছে কবিতা। চর্যাপদ থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলা সাহিত্যে পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলা কবিতা। ছন্দ, শব্দসজ্জা এবং সুরেলা বাক্যগতি কবিতার শরীর। ক্ষুদ্র জ্ঞানে বলি, সাধারণ ভাবনার ঊর্ধ্বে গিয়ে পাওয়া ভাবনার যে ফসল এরই নাম কবিতা। এই ভাবনার মধ্যে বোধের এক চমৎকার উপস্থিতি থাকে। সীমিত শব্দের মধ্যদিয়ে গভীর অনুভূতির প্রকাশই কবিতা। বোধই আমাকে প্রবল ঘোরের মধ্যে রাখে, আর এরপরই আমার মনন থেকে যা প্রসবিত হয় এটাই সৃষ্টি বা কবিতা। আমি বিশেষ কিছু অবলোকন করি, আর এই দেখার দৃশ্যটাকে মগজে ও মননে ভেজে নিয়ে কবিতা নির্মাণ করি।
কাজী আলমগীর: কবিতা নির্মাণ হয় না কি এলহামের মতো কোনো ব্যাপার আছে ?
আতাউর রহমান: একজন চিত্রকর যেরকমভাবে চিত্রকল্প তৈরি করেন, তেমনই একজন কবিও মনের মাধুরী মিশিয়ে কবিতা নির্মাণ করেন। ভাষা, ছন্দ, অলংকারের সংমিশ্রণে বোধের শক্তি দিয়ে একজন কবি একটি কবিতার শরীর নির্মাণ করেন পরম ভালোবাসা দিয়ে। কবির কাছে তার লেখা কবিতা ঠিক সন্তান সমতুল্য। এলহামের একটা বিষয় তো আছেই, কোনো কোনা সময় একটি পঙ্ক্তি বা একটি শব্দ, অথবা একটি ঘটনা বা দৃশ্য কবিকে আকৃষ্ট করে। কবিকে অনুপ্রাণিত করে, তখন কবি এই এলহাম বা সংকেতকে কাজে লাগিয়ে একটি পরিপূর্ণ কবিতা নির্মাণ করেন।
কাজী আলমগীর: কবিতায় কোন ম্যাসেজ (সংবেদ) দিতে চান?
আতাউর রহমান: দিন দিন কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কবিতার বিরুদ্ধে কিছু কিছু পাঠকের অভিযোগ, কবিতা দুর্বোধ্য। শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই এই আঙ্গুল উঠছে। এখানে ভাবতে হবে, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সময়ের পাঠক আর সাম্প্রতিক সময়ের পাঠকদের মধ্যে কী ভিন্নতা নেই? অবশ্যই সময়ের পরিক্রমায় পাঠকদের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। আমি আমার কবিতার মাধমে পাঠকদের প্রতি এই ম্যাসেজ পৌঁছাতে চাই, কবিতা বোঝার মন নিয়ে কবিতা পড়ুন। কবিতাই সাহিত্যের প্রধান এবং প্রধান অংশ। কবিতা বা পদ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যের পথচলা শুরু হয়ে়ছিল।
কাজী আলমগীর: কোন্ কবির কবিতা ভালো লাগে ? কেনো ?
আতাউর রহমান: এই লিস্টে অনেক কবির নামই রয়েছে, তবে বিশেষ ভালো লাগার কথা যদি বলি তবে বলব কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। তাঁর কবিতা আমাকে আলোড়িত করে, আমাকে অনেকদূর নিয়ে যায়। তাঁর কবিতার ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে আমি কবিতায় ডুবে যাই। এ কারণেই কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাাহ্ আমার প্রিয় কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রিয় একজন কবি। এজন্যই তাঁর প্রতি আমার আলাদা একটা ভালোবাসা ও ভালোলাগা জন্মেছে।
কাজী আলমগীর: কবিতার জন্য কার কাছে ঋণী ? কার অনুপ্রেরণার কারণে আপনি কবিতায়..?
আতাউর রহমান: কবিতা লেখার চেষ্টাটা আগে থেকেই ছিল। তখন আমি কিশোর, মাধ্যমিকে পড়ি। আমার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আইয়ুব আলী মোল্লা স্যার আমাকে প্রেরণা ও বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে কৃতার্থ করেছেন। কীভাবে কবিতা লিখতে হয় তা হাতেকলমে শিখিয়েছেন। অন্যজন আমার প্রিয় বন্ধুবর সাংবাদিক ইসমাইল নয়ন। তিনি আমাকে সবসময় প্রেরণা দিয়ে আসছেন। আপনার মাধ্যমে আমি আমার পাঠকসহ এই দুই ব্যক্তির প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
কাজী আলমগীর: কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যাপারে আপনার চিন্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলুন।
আতাউর রহমান: চিত্রকল্পই একজন কবির হাতিয়ার। কবির কল্পনা শক্তি, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর গভীর উপলব্ধি, ভাবানুভূতি ও শব্দ বিন্যাসের সংমিশ্রণেই কবিতায় চিত্রকল্প স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই চিত্রকল্পই কবিতার সৌন্দর্য ও প্রাণ।
কাজী আলমগীর: কবিতার পাশাপাশি সাহিত্যের অন্য কোনো শাখার প্রতি আগ্রহ রয়েছে ?
আতাউর রহমান: আমি মূলত কবিতার প্রতিই দুর্বল। কবিতা লেখা ও পড়ার মধ্যেই সময় কাটাতে পছন্দ করি, তবে ছোট গল্পের প্রতি কিছুটা টান রয়েছে। সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে পড়িও। তবে ঘুরেফিরে আমি কবিতারই একজন। কবিতার মধ্যেই যেন আমি আমার প্রকৃত আমাকে খুঁজে পাই।কখনও সাহিত্যের অন্য শাখায় কলম ধরিনি। ভবিষ্যতের বিষয়ে এখনও কিছু বলতে পারছি না।
কাজী আলমগীর: কোন ছন্দে নিজেকে সাবলীল মনে করেন ? কবিতা লিখার সময় পরিপূর্ণভাবে ছন্দ মেনে চলা সম্ভব হয় কি না ?
আতাউর রহমান: অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ও গদ্য ছন্দেই আমি লিখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। কখনও কখনও ছন্দ মেনে চলা সম্ভব হয় না, তবে এটা অস্বীকার করায় সুযোগ নেই, ছন্দই হচ্ছে কবিতার আচ্ছাদন। ছন্দ ছাড়া কবিতার কথা ভাবা অসম্ভব। ছন্দই কবিতাকে শ্রুতিমধুর করে তোলে।
কাজী আলমগীর: বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে বলুন।
আতাউর রহমান: সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে তরুণ কবিরা ভালো লিখছেন। আবার কেউ কেউ পিছিয়ে আছেন, তবে আমি হতাশ নই। কবিতাবিমুখ এই স্খলিত সময়কে কেউ না কেউ টেনে তুলবেই। আমি আশাবাদী।
কাজী আলমগীর: আমি শুনেছি আপনার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।
আতাউর রহমান: হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ‘শব্দের গেরস্থালী’ নামে আমার একটি কবিতার বই ২০১৭ সালের বই মেলায় বেরিয়েছে। অল্প সংখ্যক কপি বেরিয়েছিল, সেগুলো নিমিষেই ফুরিয়ে গেছে।
কাজী আলমগীর:
"কী বিষাদগ্রস্ত রান্নাঘর আগুনের অনিয়মে
রঙবেরঙের দিনগুলো বিব্রত আজ, এই অবেলায়
বাড়ি ফিরে না বাজারের পথ"
আপনার সদ্য লেখা কবিতার অংশ এটা। এই পঙক্তিগুলো দিয়ে আপনি কি বোঝাতে চেয়েছেন ?
আতাউর রহমান: হ্যাঁ, এটা নতুন লেখা কবিতা। এই কবিতায় বর্তমান সময়ের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের দিনযাপনের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
কাজী আলমগীর: কবিতা মানুষকে কী করে ?
আতাউর রহমান: ভালো কবিতা পাঠককে প্রশান্তি দেয়। এক ঘোরের মধ্যদিয়ে পাঠককে অনেক গভীরে নিয়ে যায়। পাঠক বিভোর হয়ে ওঠে। কবিতা থেকে পাঠক অনুপ্রাণিত হয়, ভালো বাসতে শেখায়। অশোভনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শেখায়। চেতনার ধারক বাহক হতে সাহায্য করে। কবিতাই মানুষকে ভাবতে শেখায়।