হেমন্তের
এক শান্ত দুপুরে রাওয়ার (রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার
অ্যাসোসিয়েশন) বিশাল হেলমেট কনভেনশন হলটি সেজে আছে যেন বিয়ের অনুষ্ঠানের
মতোই। চমৎকারভাবে সাজানো হলটিতে বেলা আড়াইটায় ‘শিক্ষা এবং নৈতিকতার’ ওপর
একটি সেমিনার শুরু হয়েছে। এটি হেলমেট হলের প্রায় বিরল ঘটনা। মানহীন শিক্ষা ও
নৈতিকতাহীন শিক্ষিত মানুষের অদ্ভুত অভয়ারণ্যে আগামীর সমাজে গভীর অন্ধকার
যেন না আসে এমন ঝলমল পরিবেশে সেমিনার আয়োজন হয়তো তারই প্রতীকী উদ্যোগ।
গত
২৭ নভেম্বর রাওয়ার থিঙ্কট্যাঙ্ক বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাওয়া রিসার্চ
অ্যান্ড স্টাডি ফোরামের (আরআরএসএফ) আয়োজনে হেলমেট কনভেনশন হলে এ সেমিনার
অনুষ্ঠিত হয়। স্বাগত বক্তব্যে রাওয়া চেয়ারম্যান ও অনুষ্ঠানের সভাপতি মেজর
জেনারেল আলাউদ্দিন মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ, বীরপ্রতীক (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন,
‘শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধ গুরুত্ব দিলে সমাজ এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু
শিক্ষা ও চরিত্র গঠন সমান দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং তিনি নৈতিক মূল্যবোধের ওপর
গুরুত্ব দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজকের প্রতিপাদ্য বিষয় শিক্ষা ও
নৈতিকতা। এ বিষয়টি আমাদের দেশ ও জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত
বিধায় রাওয়া মনে করে যে, এটি সরাসরি রাষ্ট্রীয় সামগ্রিক নিরাপত্তার সঙ্গেও
জড়িত। বিষয়টির গুরুত্ব ও গভীরতা একই ভার বহন করে।’
সেমিনারে প্রধান
অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন অধ্যাপক
ড. দিল আফরোজা বেগম, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়
মঞ্জুরি কমিশন। রাওয়ার ভাইস চেয়ারম্যান (আর্মি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ
কামরুজ্জামানের (অব.) সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, সমাজ বিশ্লেষক ও ঢাবির
বাংলা বিভাগের ‘আহমদ শরীফ চেয়ার’ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, বিশিষ্ট
শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ও বিউপির সাবেক উপাচার্য লে.
জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান। সেমিনারে আলোচক ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও খুলনা বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ অধ্যাপক ড. খুরশীদা বেগম।
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, ছাত্র,
অভিভাবক, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট
নাগরিক। সেমিনারের প্রথম বক্তা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি
‘প্রাথমিক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষার’ ওপর বক্তব্য
দেন। অধ্যাপক বলেন, ‘নানা ধারা-উপধারায় বিভক্ত হওয়ার কারণে আমাদের
শিক্ষাব্যবস্থা জটিল হয়ে উঠেছে। এর থেকে বের হতে রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট লক্ষ্য
এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক কর্মনীতি দরকার। পাশাপাশি স্কুলসহ
উচ্চশিক্ষার সব স্তরেও নীতিবিদ্যাকে স্থান দিতে হবে।’ ‘আমাদের দেশে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে নৈতিক শিক্ষাকে আলাদা কোনো
স্থান দেওয়া যায়নি’ বলে মনে করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। সম্মানিত এই
অধ্যাপক আরও বলেন, ‘আগে ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও
আন্তর্জাতিকতাবাদ এমন অনেক মাধ্যমে নৈতিকতা চর্চা শেখার সুযোগ ছিল। এখন
গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আর আস্থা নেই। সমাজতন্ত্রের প্রতিও মানুষ আগ্রহ
হারিয়েছে। যখন রাষ্ট্রে অপসংস্কৃতি প্রবল এবং সংস্কৃতি নির্জীব,’
অপসংস্কৃতিকেই যখন রাষ্ট্রে সংস্কৃতি আখ্যা দেওয়া হচ্ছে তখন সে পরিস্থিতিতে
স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে নীতিবিদ্যা ও নীতিশিক্ষাকে স্থান দেওয়া কঠিন। আমাদের
জীবনধারায় উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আমরা যথাসম্ভব গ্রহণ করব। আমাদের
কল্যাণে আমরা সেগুলোকে ব্যবহার করব, কিন্তু সেগুলো দ্বারা আমরা পরিচালিত হব
না। প্রযুক্তিকে কর্তার আসন দেওয়া যাবে না। প্রযুক্তির দাস হয়ে পড়লে
মারাত্মক ভুল হয়ে যাবে। এ সেমিনারে দ্বিতীয় বক্তা অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল
ইসলাম বলেন, (নীতিশাস্ত্র ও শিক্ষা) ‘নীতিশাস্ত্রের সফল বিকাশ ঘটাতে পারে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যদি এর সঙ্গে পরিবার সংযুক্ত থাকে তাহলে বিকাশটি
আশানুরূপ হয়। কিন্তু আমাদের সমাজের বাস্তবতা পাল্টেছে, পরিবারের ভিতর
সুনীতির চর্চা কমেছে। কোনো কোনো পরিবারে সুনীতির জায়গা নিয়ে নিয়েছে
দুর্নীতি। তার পরও অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের মূল্যবোধ চর্চায় আকৃষ্ট
করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘরের বাইরের জগতে নৈতিকতার ঙ্খলন ও অভাব থাকলে
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নীতিচর্চাকে উৎসাহিত না করলে পরিবারগুলোর উদ্যোগে শুধু
একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত সন্তানদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব।’ তিনি আরও বলেন,
‘আমাদের দেশে যে পরীক্ষানির্ভর, সনদমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত, তাতে
বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর প্রকৃত মেধার পরিচয় পাওয়া যায় না, বিকাশ ঘটা তো
দূরের কথা। এ শিক্ষা, নৈতিকতার বিকাশে সহায়ক নয়। এজন্য পরীক্ষানির্ভর ও
সনদমুখী শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।’
সেমিনারে
লে. জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান বলেন, (বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের
শিক্ষা) ‘আমরা বিভিন্ন সময় অযোগ্য ব্যক্তিকে সম্মানিত করা কিংবা যোগ্য
ব্যক্তিকে অসম্মানিত করতে দেখি বা শুনি। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের সামনে আমরা
যোগ্য কোনো রোল মডেল তুলে ধরতে পারছি না। এ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে
পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু সমাজের দুর্বলতা দেখলে হবে না। এ থেকে উত্তরণে নিজ
নিজ জায়গা থেকে আমরা কী করছি তা-ও দেখতে হবে। আমরা কজন পরিবারের সদস্যদের
সঙ্গে একসঙ্গে রাতের খাবার খাই? কজন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সন্তানদের
সঙ্গে নিয়ে যাই? আমরা অনেকেই নানা কথা বলি, কিন্তু বাস্তবে নিজেরাই তা
অনুসরণ করি না। পরিবর্তনটা নিজের জায়গা থেকে, পরিবার থেকে শুরু করতে হবে।’
বাংলাদেশ
সেনাবাহিনী ও আর্মড ফোর্সেস পরিচালিত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোয়
নৈতিক শিক্ষাচর্চার সংস্কৃতি বেশ ভালো উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এ
প্রতিষ্ঠানগুলোয় নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা এসব বিষয়কে খুবই
গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। আমাদের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকালে শিক্ষা
কার্যক্রম শুরুই হয় নীতি-নৈতিকতা আলোচনার মধ্য দিয়ে, যেন আমাদের
ছেলেমেয়েদের মনে সেটা গেঁথে যায়।’ এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী,
নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী অর্থাৎ আমাদের সশস্ত্র বাহিনী তাদের মূল দায়িত্ব
পালনের পাশাপাশি জাতীয় শিক্ষা ক্ষেত্রেও অসাধারণ অবদান রাখছে।
বক্তাদের
উপস্থাপনা নিয়ে ক্রিটিক হিসেবে আলোচনা করেন অধ্যাপক ড. খুরশীদা বেগম। তিনি
বলেন, ‘আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়কে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি এক ধরনের
হুমকি বলা যায়। নীতি হচ্ছে ন্যায়বান ব্যক্তি। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে
নীতি-নৈতিকতা খুব জরুরি। রাজনৈতিক ব্যক্তি যিনি তিনিও নৈতিক ব্যক্তি হবেন।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ব্যক্তিক প্রেক্ষাপটে
নীতি-নৈতিকতা কোনো দাবি নয়; এটি বাংলাদেশের দুর্বহ সময়ে পথের দিশা খোঁজার
ঐকান্তিক প্রয়াস। নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি আমাদের অপ্রথাগত নিরাপত্তার সঙ্গে
জড়িত। আমাদের রাষ্ট্রের প্রগতি ও অগ্রগতির জন্য বিষয়টি জড়িত।’
তাঁর
আবেগঘন বক্তব্যে উঠে আসে তাঁর দেখা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার হতাশাজনক
চালচিত্র, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আশ্চর্য অবক্ষয়, শিক্ষা জগতে অশুভ অন্ধকার
নামার সম্ভাবনা, একই সঙ্গে একদল শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীর অব্যাহত মহৎ
সংগ্রাম...। ড. খুরশীদা বেগমের উপস্থাপনায় রয়ে যায় তাঁর লেখা ৭০০ পৃষ্ঠার
অসাধারণ এক গ্রন্থের আলোকোজ্জ্বল ছোঁয়া। (ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে-একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ)।
সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দিল
আফরোজা বেগম। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়
পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের নৈতিক অধঃপতন ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে নৈতিক শিক্ষার
বিষয়টি যুক্ত করা জরুরি। পাশাপাশি বিভাগের সহশিক্ষা কার্যক্রমে
শিক্ষার্থীদের আচরণের বিভিন্ন দিক মূল্যায়নে কোর্স শিক্ষকরা নম্বর বরাদ্দের
ব্যবস্থা করতে পারেন।’
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা.
দীপু মনি, এমপি। তাঁর প্রাঞ্জল ও আকর্ষণীয় বক্তব্যে বলেন, ‘ক. নৈতিকতা বোধ
না শিখে আমরা যদি অনেক বেশি শিক্ষিত হয়ে যাই, দক্ষ হই তা হলেও সেই শিক্ষার
কোনো মূল্য নেই। এজন্য সঠিক শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের
নৈতিক মূল্যবোধও শেখাতে হবে। খ. পরিবার থেকেই সন্তানদের কৃষক, শ্রমিকসহ
সর্বস্তরের মানুষকে সম্মান দেওয়া শেখাতে হবে। গ. যোগ্য হলে যে বয়সেই হোক
সবাই যাতে উচ্চশিক্ষা নিতে পারে সেই ব্যবস্থাও থাকা দরকার। আমাদের দেশের
উচ্চশিক্ষায় নানামুখী দেয়াল রয়েছে। শিক্ষা যদি জীবনব্যাপী হয় তাহলে
উচ্চশিক্ষায় বয়সের দেয়ালগুলো ভেঙে দিতে হবে। ঘ. সঠিক শিক্ষা গ্রহণের
পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিকতা, সহমর্মিতা ও
পরমতসহিষ্ণুতা শেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্ব অনেক বড়। ঙ.
একইভাবে শিক্ষকদেরও আগের সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে। চ. কেবল
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, এর বাইরে পরিবার ও সমাজেও নৈতিকতার চর্চাকে উৎসাহিত
করতে হবে। ছ. নতুন শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রকার অপপ্রচার চালানো
হচ্ছে। আমরা পাঠক্রম থেকে ধর্মকে বাদ দিইনি।’
সেমিনারটি শেষ হলো
প্রশ্নোত্তর পর্ব দিয়ে। আরও একটু সময় পেলে এটি হয়তো আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠত।
এ সেমিনারে উঠে আসে শিক্ষা ও নৈতিকতা বিষয়ক উন্নয়নের নানাবিধ বুদ্ধিদীপ্ত
সুপারিশমালা। এ বিষয়গুলো হয়তো ভবিষ্যতের দিনগুলোয় নতুন পথের সন্ধান দেবে।
আলোচনার একপর্যায়ে রাওয়া কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার
প্রসঙ্গও আসে।
গত ৫১ বছরে বিশেষ করে শেষ ১৪-১৫ বছরে বাংলাদেশে শিক্ষার
ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। অবকাঠামো ও পরিমাণগত দিক থেকে শিক্ষার ব্যাপ্তি
অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ১৯৭২ সালে আমাদের শিক্ষার হার ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।
বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের
সংখ্যা ১৫০-এর অধিক। অথচ ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র
ছয়টি। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষার মান নিয়ে, শিক্ষার ব্যবস্থাপনা,
শিক্ষক ও ছাত্রদের নৈতিকতা নিয়ে।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান জানতেন যে দুঃখজনকভাবে দুর্নীতির ধারক-বাহক হলো শিক্ষিত
সমাজ। সাধারণ মানুষকে দুর্নীতিতে জিম্মি করে রেখেছে দুর্নীতিবাজ শিক্ষিত
সমাজ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর দুর্নীতির ঊর্ধ্বগতিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যথিত
চিত্তের পরিচয় পাই তাঁর বিভিন্ন ভাষণে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে
তিনি বলেছিলেন, ‘করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা
শিক্ষিত সমাজ... আজ আত্মসমালোচনার দিন এসেছে। এসব চলতে পারে না।’ ১৯৭৫
সালের স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
‘শিক্ষিতদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন- আমি এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, তা
কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায়
কারা? ব্ল্যাক মার্কেটিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা
চালান দেয়। হোর্ড করে কারা? এই আমরা যারা শতকরা পাঁচজন শিক্ষিত। এই আমাদের
মধ্যেই রয়েছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে,
আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’ বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাত্রদের নৈতিকভাবে গড়ে তুললে
ভবিষ্যতে দুর্নীতিহীন, সুন্দর ও মানবিক সমাজ গড়া সম্ভব।
শিক্ষার মানের
অধোগতি আজকাল ব্যাপকভাবেই সমালোচিত। এই সঙ্গে শিক্ষক ও ছাত্রদের নৈতিকতার
অবক্ষয়ও ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সম্মানিত উপাচার্য ও শিক্ষকদের নৈতিকতাহীন দুঃখজনক
কর্মকান্ড সমাজে লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষকদের নেতিবাচক কর্মকান্ড নিয়ে স্বয়ং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আক্ষেপ
করেছেন। মানহীন শিক্ষা ও নৈতিকতাহীন সমাজ ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মারাত্মক
পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অন্ধকার নামার আগেই তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে
হবে।
সেমিনার আয়োজনে আমার সামান্য কিছু সংশ্লিষ্টতা ছিল। সেদিন সম্মানিত
অধ্যাপকদের বক্তৃতা চলাকালে একটি বিষয় দৃষ্টি আর্কষণ করে। হলে উপস্থিত ৫
শতাধিক সম্মানিত অতিথি, শ্রোতৃমন্ডলীর অধিকাংশই আশ্চর্যরকম অভিনিবেশ,
মুগ্ধতাচিত্তে বক্তৃতা শুনছিলেন। তাদের মাঝে ছিল না মোবাইল মগ্নতা। ছিল না
পার্শ্ববর্তী বা পার্শ্ববর্তিনীদের সঙ্গে মধুর সংলাপ। বিষয়টা অবাক করার
মতোই। এর কারণ কী? একজন অতিথি এ বিষয়ে আমাকে পরে বলেন, ‘সমাজের অনেক মানুষ
এখনো ভালো কথা শুনতে চায়। তবে তা হতে হবে ভালো মানুষ থেকে, খাঁটি মানুষ
থেকে, শুদ্ধ মানুষ থেকে।’
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। আর তাই অগ্রসরমান
বর্তমান বাংলাদেশকে আরও দূরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের অবশ্যই শিক্ষার
ক্ষেত্রে নৈতিকতাবিষয়ক দুর্বলতা, ঘাটতিগুলো দূর করতে হবে। রাষ্ট্র বা
সরকারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অংশীজন, পরিবার ও
ব্যক্তির রয়েছে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব। শুধু সমালোচনা করলেই চলবে না, জাতির এ
মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নাগরিকদের দায়িত্ব নিয়ে কাজও করতে হবে। এ বিষয়টি
সব সময় আলোচনায় রাখতে হবে।
এসব ক্ষেত্রে এককভাবে একজন শিক্ষকের অবদান
সবচেয়ে বেশি। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে আকর্ষণীয় করতেই হবে। সামাজিক মর্যাদার
সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক প্রণোদনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্কেল, গ্রেড এসবের
ঊর্ধ্বে গিয়ে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের
দাবি। এটি না করলে অন্য সব ব্যবস্থা ব্যর্থ হতে পারে। এ সেমিনারের ফলাফল
কী? প্রয়াত বিখ্যাত কূটনীতিক ও লেখক ফারুক চৌধুরীর একটি কথা মনে পড়ল,
‘গালভরা সব কথা সেমিনারের ধর্ম। আর জনমনে এ উপলব্ধি নিশ্চয়ই থাকে যে,
সেমিনারের কথা সেমিনারেই রয়ে যায়। সেমিনার কক্ষের চার দেয়ালের বাইরে
সেমিনারের ওয়াজ-নসিহতের প্রভাব কমই পড়ে।’ এ সেমিনারের প্রভাব এবং ফলাফলও
হয়তো আহামরি তেমন কিছু নয়।
সেমিনার আয়োজন করে রাওয়া কর্তৃপক্ষ ক্ষুদ্র
হলেও কিছুটা সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছে। সেমিনারটি হয়তো বিরল কোনো
দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে না। কিন্তু শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়া
নীতিহীনতা ও অবক্ষয়ের ক্ষেত্রে এটি ছোঁয়া রাখলেও মন্দ কী? আমাদের সর্বজনীন
সম্মিলিত প্রয়াসই পারে শিক্ষা ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের অনুমিত অন্ধকার দূর করে
আলো ছড়াতে। সব নাগরিকের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাক আমাদের প্রাণের
বাংলাদেশ।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক