বৃহস্পতিবার ৩ জুলাই ২০২৫
১৯ আষাঢ় ১৪৩২
নারীর সম্ভ্রমহানি এবং আমাদের সামাজিক ব্যাধি
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৪, ১:১৫ এএম |

 নারীর সম্ভ্রমহানি এবং আমাদের সামাজিক ব্যাধি গল্পের অভাবের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাই বলে গল্প কি লেখা হচ্ছে না? পত্রিকার ঈদসংখ্যায় গল্প থাকে, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আগের হারে না হলেও যে ম্যাগাজিন বের হয়, তাতে শিক্ষার্থীরা গল্প লেখে। ঈদসংখ্যার গল্পের মূল্যায়নের প্রয়োজন নেই, কারণ সেগুলো প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রতিষ্ঠা পাবেন- এমন লেখকের লেখা। 
তবে এটা বলতেই হবে যে, অধিকাংশ গল্পেই ঘটনা পাওয়া যায়, কিন্তু দার্শনিকতা অনুপস্থিত থাকে। আর এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, লেখক যদি কেবল ঘটনার বিবরণই দিয়ে যান, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ছাপটা তার গল্পে দিতে না পারেন, তাহলে গল্প সাহিত্য হয় না। গল্পে (এবং সাহিত্যেও) এখন ওই দৃষ্টিভঙ্গিটির বড়ই অভাব। 
কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে না, এ কেমন কথা? দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে দেখাটা কীভাবে ঘটছে? দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই আছে; কিন্তু তাতে অভাব দেখা যাচ্ছে গভীরতার। বয়স যাদের অল্প, তাদের কাছে গভীরতা আশা করা যায় না; পাওয়াও যায় না। ধরা যাক একটি কলেজের বার্ষিকীটির কথা, যেটি কৌতূহলের সঙ্গে পড়লাম, ছেলেমেয়েরা কী ভাবছে সে বিষয়ে নতুন কিছু খবর পাওয়া যাবে এই আশা নিয়ে। তা নিরাশ হয়েছি বলা যাবে না। 
কবিতায় যে ব্যক্তিগত কথা থাকবে, এটা তো অবধারিতই। আমাদের নামকরা কবিদের লেখাতেও এখন দেখি কেবল নিজের কথাই আছে। সেটা অস্বাভাবিক নয়; যেটা বেদনাদায়ক, তা হলো এই ঘটনা যে ওই ‘নিজ’ নিতান্তই ব্যক্তিগত। কবিতা লেখক তার আপনাকে অন্য অনেকের সঙ্গে যুক্ত করছেন না, নিজের দুঃখের (মূলত হতাশার) কথাই বলে যাচ্ছেন। 
কলেজ ম্যাগাজিনে অল্প বয়সীরাও তাদের লেখা কবিতায় ঠিক ওই কাজটিই করেছে; তবে একটু পার্থক্য আছে; একেবারেই নিজের কথা না বলে আপনজনদের কথাই বেশি বেশি বলেছে। কবিতাগুলোর কয়েকটির নাম এই রকমের: কলেজ, আমার কলেজ, বড় ভাই, বাবা, মা, স্মৃতি। 
গদ্যাংশের রচনাগুলোর কয়েকটি শিরোনাম এবং বিষয়বস্তুও ওই একই রকমের। যেমন, প্রিয় কলেজ, গ্রামে শৈশবকাল, বাবা, মা, স্মৃতি, প্রিয় বড় আপু, প্রিয়জন, মা-হারানোর বেদনা, বাবাকে নিয়ে কিছু কথা, আমার দেখা সেরা মানুষটি, বড় বোন, রত্নপুর আমার গ্রাম, স্মৃতির পাতায় স্কুলজীবন, বাবা তোমায় মনে পড়ে, আমার কলেজ আমার অহংকার, শিক্ষাসফর, মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা, ভালোবাসি দাদাভাই তোমাকে, ভাইয়ের শূন্যতা সে-ই বুঝবে যার নেই, কলেজ লাইব্রেরি, হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বাবা, ভাই, মা আমার মা, স্কুলজীবনের স্মৃতি, যখন সময় থমকে দাঁড়ায়, বাবা আমার বাবা, স্মৃতির ঝুলি। 
যারা লিখেছে তাদের প্রায় সবাই ছাত্রী। বার্ষিকীটিতে কলেজের ছেলেরাও লিখেছে, তবে সংখ্যার দিক থেকে তারা নগণ্য। মেয়েরা যে লিখছে তার একটা কারণ হয়তো এই যে তাদের হাতে সময় আছে, ছেলেদের যা নেই; ছেলেদের তো অনেক কর্তব্য; ঘোরাফেরা, আড্ডা দেওয়া, এমনকি মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাও।
কিশোর গ্যাং তাদের ইতোমধ্যেই পেয়েছে কি না জানি না, দু-চারজনকে পেয়েছে শুনলেও চমকে উঠব না। তা ছাড়া আরও একটা বিষয় শুনেছি মফস্বল শহরের ব্যাপারে। সেখানকার কলেজগুলোতে এখন মেয়েদের সংখ্যাধিক্য। যে ছেলেদের কলেজে পড়বার কথা তাদের অনেকেই বিদেশে চলে গেছে। বিদেশ থেকে তারা টাকা পাঠায়, সেই টাকায় ছোট ভাইয়েরা আয়েশ করে; কিন্তু ছোট বোনেরা যায় পড়তে- স্কুলে, কলেজে। 
এ রকম ঘটনা এই কলেজটির ব্যাপারে ঘটাটাও বিচিত্র নয়। তবে মেয়েদের লেখা থেকে এই গল্পটা তো বেরিয়ে আসছেই যে, তারা বিশেষভাবে পিতৃনির্ভর। কারণটা বোঝা যায়। সেটা হলো এই যে, আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। পিতাকে সন্তানদের খুবই প্রয়োজন বিশেষ করে মেয়েদের দিক থেকে, পিতা না থাকলে তারা বিশেষভাবেই অরক্ষিত বোধ করে, ওই লেখিকারা যেমন করেছে। দ্বিতীয় সত্যটা এই যে, মেয়েরা কলেজ পর্যন্ত এসেছে বটে; কিন্তু তাদের জগৎটা মোটেই প্রসারিত হয়নি। 
অথচ আমাদের মেয়েরা তো এখন অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রসর। গত পাঁচ বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, এসএসসি পরীক্ষায় মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেদের সরিয়ে দিয়ে। ওই কলেজবার্ষিকীটিও তো এ খবর জানাচ্ছে আমাদের যে, লেখার ব্যাপারে মেয়েদের আগ্রহটাই বেশি। তবে মেয়েরা এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু একটা ভয় কিছুতেই তাদের পিছু ছাড়ে না। সর্বদাই উপস্থিত থাকে; সুযোগ পেলেই টেনে ধরবে এমন ভাব। ওই ভয়টাই কলেজবার্ষিকীর লেখাগুলোকে একটি শোকসভায় পরিণত করেছে। 
মেয়েদের জন্য পথে-ঘাটে বিপদ ওত পেতে থাকে। সবচেয়ে ভয়ংকর যে ঘটনা সেটা অবশ্য ধর্ষণ। সব খবর কাগজে আসে না; ভুক্তভোগীরা প্রকাশ করতে চায় না, নতুন করে সম্ভ্রমহানি ঘটার ভয়ে; অভিভাবকরাও চান না প্রচার পাক এবং মেয়েকে পাত্রস্থ করার ব্যাপারে বিঘ্ন ঘটুক। এই নিষেধাজ্ঞার ফাঁক দিয়েও রোমহর্ষক সব খবর আসে। 
যেমন- একই দিনে একই পত্রিকায় তিনটি খবর। প্রথমটি ঢাকার: ‘২২ দিন ধরে আটকে রেখে তরুণী ধর্ষণের অভিযোগে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেপ্তার’। দ্বিতীয়টি সিলেটের। ‘ধর্ষণের পরে শিশুটিকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয় ডাস্টবিনে’। তৃতীয়টি একই রকমের যে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় হত্যা মামলা তুলে না নেওয়ায় মেয়েকে ধর্ষণ এবং ছেলেকে ছুরিতে জখম করা হয়েছে। স্বামীকে হত্যা করা হলে স্ত্রী মামলা করেছিলেন তিনজনের বিরুদ্ধে। জামিনে বের হয়ে এসে তারা ওই তাণ্ডব ঘটিয়েছে (ভোরের কাগজ, ৩ এপ্রিল)। 
অন্য পত্রিকা থেকে একটি খবর: বাগেরহাটে বিয়ে উপলক্ষে এক বাড়িতে একজন নৃত্যশিল্পী গিয়েছিলেন; অনুষ্ঠান শেষে স্বামীর সঙ্গে ফিরছিলেন নিজেদের গৃহে। মোটরসাইকেলে চেপে কয়েকজন এসে বলল, তাদের পৌঁছে দেবে। তারা স্বামীকে ওঠাল এক মোটরসাইকেলে, স্ত্রীকে অন্য একটিতে। তারপর স্বামীকে ভুল বুঝিয়ে ভিন্ন পথে নিয়ে গিয়ে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আটকে রাখল; এবং স্ত্রীকে নিয়ে গেল জঙ্গলে। 
সেখানে নৃত্যশিল্পী ওই মহিলাকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করল আটজন যুবক। স্থানীয়রা টের পেয়ে তাদের চারজনকে আটক করেন এবং টহল পুলিশের হাতে তুলে দেন। অন্যদের ধরার চেষ্টা নাকি চলছে (আজকের পত্রিকা, ১৬ এপ্রিল)। একই পত্রিকায় একই দিনে আরেকটি খবর: ‘শরীয়তপুরে স্কুলছাত্রীকে তিন দিন ধরে আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ। চার যুবক গ্রেপ্তার’। 
হতভাগ্য মেয়েটির বাবা নেই; কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। থাকত সে মায়ের সঙ্গে, কখনো আবার বোনের বাড়িতে। ঈদের দিন সন্ধ্যায় নানা বাড়িতে যাওয়ার পথে পরিচিত দুই যুবক মুখ চেপে ধরে তাকে নিয়ে যায় টিনের এক ঘরে এবং সেখানে আটকে রেখে তিন দিন ধরে তাকে ধর্ষণ করে। তৃতীয় দিন তারা আরও তিনজনকে ডেকে আনে। ওই তিনজনও একই কাজ করে। তিন দিন পর মেয়েটিকে তারা একটি অটোরিকশায় তুলে দেয়। 
এই লেখাটি তৈরি করতে করতেই খবর পড়লাম এ রকমের: পাবনায় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ। মেয়েটি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। রাতের বেলায় টয়লেটে যওয়ার জন্য সে বের হয়েছিল। তখনই ওই ঘটনা। সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে ওই কিশোরীর স্বজনরা পরাজিত প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। বিজয়ী প্রার্থীর ইন্ধনে স্থানীয় বখাটেরা ওই নিপীড়নটি ঘটিয়েছে বলে ভুক্তভোগীর পরিবারের দাবি। বিজয়ী এবং পরাজিত উভয় পক্ষই কিন্তু আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মকর্তা (দেশ রূপান্তর, ১৯ মে)।
চরম একটি খবর পাওয়া গেল ওই দিনেরই আরেকটি পত্রিকায়। সেটি এ রকমের যে, ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক, সহযোগিতার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সম্পাদক সাহেবের একজন নারী সহযোগীকেও। 
ধর্ষণের শিকার একজন নয়, কয়েকজন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে জুজুৎসু প্রশিক্ষণের কেন্দ্রের ভেতরেই। ধর্ষক প্রশিক্ষকের কাজ করত। প্রশিক্ষক হিসেবে সে কিশোরী শিক্ষার্থীদের পোশাক পরিবর্তনের কক্ষে ঢুকে পড়ে ধর্ষণের কাজ সারত। মেয়েদের নগ্ন ছবি মোবাইলে ও ভিডিও ক্যামেরায় তুলে তাদের ব্ল্যাকমেল করত বলেও জানা গেছে। 
জুজুৎসু শিক্ষায় কিশোরীদের অভিভাবকরা পাঠান তাদের সন্তানরা আত্মরক্ষায় দক্ষ হয়ে উঠবে এই ভরসায়; সেখানেই যদি অমন ঘটনা ঘটে এবং ঘটায় অন্য কেউ নয় কেন্দ্রের প্রশিক্ষক নিজেই অপরাধী হয় এবং ওই সব কাজে তাকে সাহায্য করে তারই একজন নারী সহযোগী, তাহলে আর বাকি থাকে কি? (আজকের পত্রিকা, ১৯ মে)।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়













সর্বশেষ সংবাদ
এক বছরে সাড়ে ৩ শ ধর্ষণের অভিযোগ কুমিল্লায়
সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পেলে ধারনা করা যাবে নির্বাচন কবে হবে: সিইসি
আজ কুমিল্লায় আসছেন সিইসি
চান্দিনায় মধ্য রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
এক বছরে ৯৬ বেওয়ারিশ লাশ দাফন কুমিল্লায়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা ইকরা মডার্ণ স্কুলের বার্ষিক ফল প্রকাশ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা
জিয়া সাইবার ফোর্স- কুমিল্লা উত্তর জেলা কমিটি অনুমোদন
কুমিল্লায় বিজিবি অভিযানে ৬০ কেজি গাঁজা জব্দ
চান্দিনায় মধ্য রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
‘সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণ নয়’
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২