একদিকে
ভয়াবহ বন্যা, মানুষের দুর্ভোগ; অন্যদিকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা-
দুটোই দেখছি আমরা। পানির ধর্ম ওপর থেকে নিচে গড়িয়ে যাওয়া। এটা প্রকৃতির
নিয়ম। রাষ্ট্রীয় সীমানা তৈরি করেছে মানুষ। কিন্তু যখন অতিবৃষ্টি হয় তখন
বন্যা হয়, বন্যার পানি গড়িয়ে নিচের দিকেই নামে। তখন পানি ভারত-বাংলাদেশ
সীমানা, কাঁটাতারের বেড়া- এগুলো মানে না।
কিন্তু একটা বিষয় পানি মানে,
সেটা হলো নদীর অববাহিকা। প্রতিটি নদীর নির্দিষ্ট গতিপথ আছে, এই পথে চলতে
চলতে একাধিক নদীর প্রবাহ মিলিত রূপে আরও ব্যাপক প্রবাহের জন্ম দেয়। কিন্তু
পানির গতিপথ আলাদা থাকার কারণে সাধারণত এক অঞ্চলের নদীর পানি অন্য অঞ্চলের
বন্যাকে বাড়িয়ে তোলে না।কিন্তু যখন পানির ঢল নামে তখন বিষয়টা আর আগের মতো
থাকে না।
কুমিল্লার গোমতীর পানিও ফেনীর অঞ্চলকে প্লাবিত করতে পারে।
পানি প্রবাহের স্বাভাবিকতাকে বিবেচনা না করে যদি নদীর উজানে ড্যাম বা
ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়, তা যেমন পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে
ভাটির অঞ্চলের মানুষের পানি পাওয়াকে কঠিন করে তোলে, তেমনি অতিরিক্ত পানির
চাপ কমাতে পানি ছেড়ে দিয়ে ভাটির মানুষ, ফসল, খেত-খামারকে ডুবিয়েও মারে। এ
নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে কম উত্তেজনা নেই, মানুষের কষ্টের আহাজারি কম নেই।
আর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের এটাও অন্যতম কারণ।
কিন্তু
এবারের আকস্মিক ভয়াল বন্যার কি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা নেই? বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, এবার বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা রাজ্যে যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি ও বন্যা
হলো, প্রাথমিকভাবে তার চারটি কারণ হতে পারে। যেমন- ১. এল-নিনো ২.
মেডেন-জুলিয়ান দোলন বা সংক্ষেপে এমজেও ৩. জেট স্ট্রিম ও ৪. বঙ্গোপসাগরে
সৃষ্ট মৌসুমি লঘুচাপ।
আবহাওয়া-সম্পর্কিত এই চারটির যেকোনো একটি কারণই
ভারী বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য দায়ী। কিন্তু আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে
একই সঙ্গে চারটি বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে একই
সময় সক্রিয় হওয়ায় রেকর্ড পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে
ভারী বৃষ্টি, সাগরের লঘুচাপ এবং সেই সঙ্গে পূর্ণিমার কারণে সাগরের জোয়ার
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল।
সে কারণে বৃষ্টির পানি নামার প্রক্রিয়া
বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে উজানের প্রবল বৃষ্টির কারণে মৌলভীবাজার,
হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, ফেনী,
চট্টগ্রামের নদীবাহিত নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এ ধরনের বন্যা এসব অঞ্চলের
মানুষ অনেক দিন দেখেননি। ফলে তাদের প্রস্তুতি ছিল না, এক দিনের মধ্যেই পানি
বৃদ্ধির তীব্রতা দেখে হতবাক হয়ে গেছেন অনেকেই।
প্রশ্ন হলো, আমাদের
আবহাওয়া বিভাগ কি এটা আগে জানতে পারেনি? আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিজ্ঞানের
তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে নিখুঁতভাবেই ৩ থেকে ১৫ দিন
আগের আবহাওয়া পূর্বাভাস করা যায়। আর তিন দিন আগে শতকরা ৯০ ভাগ নিশ্চয়তাসহ
আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া যায়।
সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা
রাজ্যের ওপর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি, তার পূর্বাভাস কি ১০ দিন আগে দেওয়া
সম্ভব ছিল না? ভারী বৃষ্টির এই পূর্বাভাস কেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর
দিতে ব্যর্থ হলো? এটা কি আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, দক্ষতার অভাব নাকি
দায়িত্বপূর্ণতার অভাব? এর ব্যাখ্যা বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের
আবহাওয়াবিদদের কাছে জানতে চাওয়া উচিত, যাতে এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা এবং
দুর্বলতা সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা থাকে।
ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর
থেকে পাওয়া বৃষ্টিপাতের তথ্য অনুযায়ী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ১৯ আগস্ট সকাল
৯টার পর থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত তিন দিনে মোট ৪৯০
মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও
সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে
শুরু করে ২২ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত কুমিল্লা জেলায় মোট ৪৪৫ মিলিমিটার ও
ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় ৪০৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
আবার ১৯ আগস্ট
সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত দক্ষিণ ত্রিপুরার
বাগাফা নামক স্থানে ৩৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যে জায়গাটি বাংলাদেশের
ফেনী জেলার পাশেই। এসব বৃষ্টিপাতের পানি ফেনী জেলার মুহুরী নদী দিয়ে
প্রবাহিত হয়েছে। একই দিনে ত্রিপুরা রাজ্যের অন্যান্য স্থানে ৩০০
মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সময়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের
চেরাপুঞ্জিতে ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যার পানি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ও
সিলেট জেলার সুরমা নদীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
এখানে একটা কথা
উল্লেখ করা দরকার যে, সাধারণত, আগস্ট মাসে কুমিল্লা জেলায় গড়ে বৃষ্টিপাত
হয়ে থাকে ৩৪৭ মিলিমিটার ও ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় গড়ে বৃষ্টি হয় ৪০৩
মিলিমিটার। অর্থাৎ ১৯ আগস্ট থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে
কুমিল্লা ও ফেনী জেলায় মোট যে বৃষ্টি হয়েছে, তা এই দুই জেলার পুরো আগস্ট
মাসের মোট বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি। এক মাসের সমান বৃষ্টি তিন দিনে হওয়া এই
ভয়াবহ বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ।
কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত
গোমতী ও ফেনী জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত মুহুরী নদীর উজানে ভারতের ত্রিপুরা
রাজ্যে পানি সংরক্ষণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কৃষিকাজের জন্য একাধিক বাঁধ ও
ব্যারাজ নির্মাণ করেছে সে দেশের সরকার। জুন মাস থেকে বর্ষা মৌসুম, তাই ১৮
আগস্টের আগেই এসব ড্যাম ও ব্যারাজ পানিতে পূর্ণ ছিল।
১৯ আগস্ট সকাল
৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ত্রিপুরা
রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের
কারণে সব ড্যাম ও ব্যারাজের পানি ধারণক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। ২০
আগস্ট রাতে হঠাৎ করেই বেশির ভাগ ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেয় ত্রিপুরা
রাজ্য কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ কিংবা ভারত সরকার
ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশকে ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেওয়া বা তাদের
ভাষ্য অনুযায়ী পানির চাপে ব্যারাজের গেট খুলে যাওয়া সম্পর্কে আগে থেকে
কোনো রকম তথ্য দেয়নি। ফলে কোনোরূপ প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই বিপুল পানির তোড়ে
ভেসে গেছে কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
মানুষের
কষ্ট, হাহাকার এবং সম্পদ ধ্বংস হতে দেখে একদিকে যেমন মানবিক আবেদন তৈরি
হয়, অন্যদিকে দেশের নদী ব্যবস্থাপনার ত্রুটি দেখে ক্ষোভের সঞ্চার হয়
মানুষের মনে। বাংলাদেশ তো নদীর দেশ, পানির দেশ, বন্যার সঙ্গে সহাবস্থান
করেই এই ভূখণ্ডে সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তাহলে কেন এতদিনেও একটা
বিজ্ঞানসম্মত পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠছে না?
ভারত থেকে আসা ৫৪টি নদীর
পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরে
যাওয়া পানির ৫৬ শতাংশ ভারতের, ৪৪ শতাংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরের। সমুদ্রের
লোনা পানির প্রবেশ ঠেকাতে এই পানির প্রবাহ বজায় রাখা জরুরি। সে ক্ষেত্রে
ভারতের পানি আগ্রাসন বা পানি কূটনীতি একটা জটিল ব্যাপার বাংলাদেশের জন্য।
কিন্তু
দেশের অভ্যন্তরে নদী দখল, দূষণ এবং নদী হত্যা ঠেকানো যাচ্ছে না কেন? জাতীয়
নদী রক্ষা কমিশন ৩৯ হাজার ৫৫৮ জন নদী দখলদারের একটা তালিকা প্রকাশ করেছিল।
সেই তালিকা অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি দখলদার ছিল কুমিল্লা জেলায়।
অপরিকল্পিত
রাস্তা, স্থাপনা, বাঁধ, ব্যারাজ পানি প্রবাহের পথে যে বাধা তৈরি করেছে তার
খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের। ফলে বন্যার ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়ে
প্রকৃতিবিনাশী পদক্ষেপ থেকে সরে আসতে হবে।
উজানের দেশের সঙ্গে ভাটির
দেশের পানি বণ্টন ও ব্যবহারের যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সেটা মেনে চলতে যেন
বাধ্য করা যায়, এ ব্যাপারে জনমত শক্তিশালী করার বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। এই
দুর্যোগ অনিবার্য নয়, পানি আগ্রাসন রোধ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানসম্মত
করে এই ভয়াবহতা থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)