তাঁর শ্রেষ্ঠ
গ্রন্থ তিনি নিজেই : তাঁর মানস। তিনি, অন্তিম বিশ্লেষণে, লিপ্ত নন কোনো
কিছুতে; তিনি, মনিরুজ্জামান, দর্শক, দেখেছেন দু'চোখ ভরে দেখেছেন আবহমান
মানব সমাজ, প্রকৃতি ও সময়ের পটভূমিকায়, দূর থেকে অনবরত, নিঃশব্দে। সেজন্য
তাঁর কবিতায় ফলিত হয়েছে এমন এক বাস্তব, যা লোকজ, দেশজ, অথচ ঐ দুই ছাড়িয়ে;
দেশোত্তর, লোকোত্তর নৈশতা কিংবা রৌদ্র, প্রবল আর ক্লান্ত, উদ্ভাসিত আর
অবগুণ্ঠিত একই সঙ্গে। তাঁর কবিতা আত্ম আবিষ্কার, সমাজের প্রকৃতির সময়ের
আবহমানকালের; তাঁর কবিতা মিলিয়ে এনেছে বাস্তব ও মনোলোকের পারস্পরিক
ব্যবধানগুলি, সেতুবন্ধন রচিত করেছে দুইয়ের মধ্যে, এক যুগ থেকে অন্য যুগে,
আজকের সমাজ ও সব সময়ের সমাজে, স্বকাল ও সকল কালের পরিপ্রেক্ষিতে, এই হচ্ছে
অভিজ্ঞতা, কবি ব্যক্তিত্ব। সেজন্য অভিজ্ঞতা যে-কালে যে-সমাজে কবি রয়েছেন
এবং যে-বিষয়ে যে-সমাজে তিনি ছিলেন না, কিন্তু যে-জিনিসগুলো রয়ে গেছে, আছে,
থাকবে সে-সবই : সেজন্য কবি ব্যক্তিত্ব অনেক অভিজ্ঞতা ও স্বল্প অভিজ্ঞতার
স্তর ভেদ; সেজন্য কবি নয় আর প্রগলভ প্রবক্তা, তিনি এখন মিতবাক দ্রষ্টার
স্থৈর্য ; কবিতা তাই আত্মিক নিবিড়তা ও গাণিতিক শুদ্ধতা : মিলনোৎপন্ন কবিতা
জ্ঞান নয় আর, জীবনও নয় যেন, জীবনের সমান্তরাল কিংবা জীবনকে কোনো আলাদা জগতে
নতুন করে সৃষ্টি।
এভাবেই সারা জীবন ধরে মনিরুজ্জামান অভিজ্ঞতার মধ্যে
নিজেকে সংহত করে নিয়েছেন, অভিজ্ঞতার সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে স্মৃতি স্বপ্ন
অবেচেতন গেঁথে-গেঁথে কখনো তাঁর কবিতায় ভরে দিয়েছেন অজ্ঞেয়তার অনস্তিত্বের
নৈরাশ্য, কখনো বা বিশ্ব বিষয়ের পরিপ্রেক্ষুায় ব্যক্তির বাস্তবতা বিষয়ে নতুন
জিজ্ঞাসা, কবিতা তাঁর কাছে তাই সামঞ্জস্য ভাষার মধ্যে দিয়ে। ভাষা গড়ে তোলে
কবিকেই, তাঁকেই সে এগিয়ে দেয় সম্পূর্ণতার অভিমুখে, ভাষাই অস্তিত্ব,
একমাত্র ভাষাই আছে শেষ পর্যন্ত, জীবনের অনর্গলতাকে এভাবেই মনিরুজ্জামান
ভাষার মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন। ভাষা এবং অভিজ্ঞতা যখন কবিতার অন্বিষ্ট,
আবহমানকাল আর সমকালের অন্যান্য সংযোগ যখন সেই অন্বেষণের অবলম্বন, তখন
অনিবার্যভাবে তাঁকে হয়ে উঠতে হয়েছে প্রজ্ঞার দিকে উনুখ, সুরময়, আভাসযোগ্য :
ভাষা এভাবে অভিজ্ঞতাকে বেঁধে দেয় কাল থেকে কালে। তার সময়চেতনা কিংবা
ইতিহাসচেতনার স্বরূপ হচ্ছে এসবই : তিনি দর্শক স্বকালের আবহমানকালের ; তাঁর
অভিজ্ঞতা প্রাণতপ্ত ও স্তর বহুল ; তাঁর ভাষায় বাস্তব ও মনোলোকে প্রতিফলিত
বাস্তবের সাদৃশ্যের সূত্রজাল ছড়িয়ে পড়ে : জন্ম নেয় উপমা আর চিত্রকল্প, মিশে
যায় বর্ণগন্ধ আর আস্বাদ পরস্পরের মধ্যে।
এ ভাষা তিনি দেখেছেন নরসিংদী
জেলার রায়পুরা উপজেলার আদিয়াবাদের নিসর্গে, শুনেছেন লোক মানুষের বুলিতে,
পড়েছেন বিদেশী সাহিত্যের পাতায়, ঐ দেখা-শোনা-পড়া ছেঁকে ছেনে তিনি গড়েছেন
নিজের ভাষা, যাতে বিচ্ছুরিত নানা স্তর নানা ইঙ্গিত, দেখা শোনা চেনা যেখানে
নির্মিত অন্য এক সাদৃশ্যে ; বাস্তব যেখানে মিশে যায় অ-বাস্তবে, গেঁয়ো বুলি
শালীন শব্দকল্পে, বৈদেশী উপমা নরসিংদীর আদিয়াবাদে, যেন সিঁড়ি একইসঙ্গে
বিভিন্ন সময়ে কিংবা বিভিন্ন দিকে ; এভাবেই তাঁর ভাষা আমাদের সবকিছু দেখায়
শোনায় চেনায়, আমাদের গেঁথে দেয় বিভিন্ন অভিজ্ঞতায়, সব একসঙ্গে অনিবার্যভাবে
; মনিরুজ্জামান এভাবেই বাংলা কবিতা ব্যবহার করেছেন।
মনিরুজ্জামান
ব্যবহার করেছেন একসপ্রেশনিষ্ট টেকনিক, ঐ টেকনিক দৃশ্যমানতা আঁকে ; বিষয়ের
চূর্ণ স্মৃতি ব্যবহার করে, ঐ স্মৃতি রংয়ের মতন আবেগ উত্তোলিত করে তোলে।
সেজন্য নীল কিংবা সবুজ নয়, সবুজ বাতাস, বাতাসের ছবি নয়, বরং রং, কন্টুর,
মুড। তাঁর ইন্দ্রিয়ানুভূতি বিষয় ভেদ করে বেরিয়ে আসে, বিদীর্ণ হয়, বিষয়
কবিতার স্বাদ অবিকল জিভে তুলে ধরে। সু ও কু-র প্রত্যয় রক্ত, অনুভূতি, প্রেম
ঘিরে আছে, সেজন্য তাঁর শিল্প কুশলতা শব্দকে অনবরত সাজায় গুছায়, শব্দ
রক্তমাংসের মতন হয়ে ওঠে। মনিরুজ্জামানের আদি কবিতা বিচ্ছিন্ন এক ব্যক্তির
মনোলগ, ভাষায় ঐ বিচ্ছিন্নতা তিনি গেঁথে দিয়েছেন। মধ্য পর্যায়ের কবিতায় তিনি
নিজেকে প্রসারিত করেছেন, বিভিন্ন ব্যক্তির কণ্ঠ তুলে ধরেছেন, বিভিন্ন
ব্যক্তির বিভিন্ন আচরণ/ব্যবহার/অনুভূতির মধ্যে দিয়ে সু ও কু-র জবাব
খুঁজেছেন, সেজন্য তাঁর টেকনিক বিস্তৃত হয়েছে, আদি কবিতার একঘেয়েমির বদলে
বৈচিত্র জটিল হয়েছে। শেষ পর্যায়ে তাঁর কবিতায় দ্রুততা এসেছে, তার
বিচ্ছিন্নতায় গেঁথে এসেছে সকল রক্তমাংস, মৃত্যু আর জীবন, পূর্বপুরুষ আর
উত্তর পুরুষ আর নিসর্গ। তাঁর শব্দে ঘটে যাচ্ছে বিভিন্ন আভাস, ইঙ্গিত, এমন
কি জ্ঞান। তিনি এভাবেই, একান্তভাবে ব্যক্তিক মনিরুজ্জামান এভাবেই
নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠেছেন, তাঁর সমস্ত সত্তার যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তার
বাইরের সবকিছু তার কল্পনায় আবিষ্কৃত হয়েছে, পূর্ণ সৃষ্টি লাভ করেছে।
সমসাময়িক অভিজ্ঞতায় তিনি গভীরভাবে বাস করেছেন, রক্তমাংসে পরিণত করেছেন;
অনুভূতির পথে কবিতায় সংলগ্ন করেছেন জ্ঞানের বিজ্ঞানের ধর্মের মতাদর্শের
প্রতীকী রীতিকরণ, আধুনিক জীবনের কবিতা-বিরোধী উপাদান তিনি রূপান্তরিত
করেছেন স্বচ্ছ কবিতায়।
২
তিনি শিখিয়েছেন বিভিন্ন বলয়ের মধ্যে
অভিজ্ঞতার সঙ্গতি সাধন। কবিতা আমাদের অভিজ্ঞতার কোনো একটি উপেক্ষিত কিংবা
বিশৃঙ্খল অংশে অভিঘাত হানে ; সময় দেশ ও সন্ততিদের ব্যাপ্তিতে গ্রথিত ও গভীর
কবিতা আমাদের অভিজ্ঞতার অপূর্ণতা, অসুস্থতা, বিশৃঙ্খলায় শৃঙ্খলা তৈরি করে,
আমরা প্রবেশ করি অনেক দূরে, স্তরে, অজানা সাদৃশ্যে; কবিতা ছড়িয়ে যায় অতীত
আর ভবিষ্যতে, বর্তমানকে স্পষ্টতরভাবে গঠন করে; কবিতায় উৎসারিত হয় আরো বেশি
প্রবেশশক্তি ও শান্তি; আমাদের অভিজ্ঞতা বেড়ে যায়। মনিরুজ্জামান তার
কল্পনাপ্রতিভা অনবরত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছেন, কুশলী হাতে ঐ অভিজ্ঞতা
বিশাল সময়ে স্থাপন করেছেন, বর্তমান সমাজের সকল পরিধি অনুধাবন করতে চেয়েছেন,
অতীত সমাজের অন্তঃশীল বিষয় নানা অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে সময়ের বিসারের
মানুষের আরো কাছে নিয়ে এসেছেন ; এভাবেই তিনি তৈরি করেছেন কবিতা, মিলিয়েছেন
নিজের দেশের কবিতার দীর্ঘকালীন ঐতিহ্যের সঙ্গে ইংরেজি ও ফরাসি কবিতার মর্ম,
ব্যবহার করেছেন নিজের সময়ের জন্য নতুন ও নতুনভাবে নির্ণীত পুরনো মূল্য,
এভাবেই তিনি নির্মাণ করেছেন বর্ণতরু, মায়ের বুকে, মোরগ ও ছাড়পত্রের মতন
কবিতা কিংবা সাতটি নক্ষত্র ও একটি নদীর অশ্রুর মতন কবিতা, যেখানে তিনি
ভাষার স্পষ্ট স্বভাবে ব্যক্ত করেছেন আনুষঙ্গিক অনাস্থার অতীত কি বিশেষ
আস্থা রয়েছে তা একজন ব্যক্তির নয় , কবির নিজের ব্যক্তিকতার নয়, সমস্ত
দেশকাল সন্ততিরই পরিচয়, বিশ্বাস বা তার অভাবের পরিমিত প্রসার ও গভীরতা নিয়ে
তৈরি করেছেন শব্দের অন্তর্যাণী আলো, আমাদের হৃদয়ে কবিতা গৃহীত হল, শব্দে
এল সত্যের বিভিন্ন অর্থ ও লক্ষ্যের চলাচল। তিনি যেন বলেন : মানুষের মন ও
হৃদয়ের বিশেষ বদল হয় না, তবু প্রতি যুগেই ঘটনা ও জীবন সমাবেশ আশ্চর্য নতুন,
ঐ সময়ের আলোকে আগের সব যুগ খানিকটা স্বতন্ত্রভাবে প্রতিফলিত হয়ে উপস্থিত
হয়, তিনি ঐ কথাই বলেছেন ঘুরে-ঘুরে বারেবারে মিতভাষণে, ইদানীং বিপন্ন বড়ো,
নদীতে মেঘের ছায়া কাব্যগ্রন্থে বলেছেন, মানুষের সমাজের পরপর নূতনত্বে ও
আলোড়নে হৃদয় ধ্বংস হয়ে যায় না, কবিতা টিকে থাকে মানুষের হৃদয়ের কাছে। কিংবা
বলেছেন : ঐ সব কবিতা মানব বৃত্তান্তের কোনো-এক বিশেষ অধ্যায়, অথবা
বৃত্তান্তের অপর কোনো স্তর, সেজন্য তাঁর কবিতা সময়ের নানা বলয় ঘিরে গড়ে
ওঠে, তাঁর কবিতায় অন্যত্র আহৃত জ্ঞান ও সত্য শব্দে সমর্থন লাভ করে বা
খণ্ডিত হয়, তিনি অনবরত নিজেকে যাচাই করে নিতে থাকেন সনাতনের পরিপ্রেক্ষিতে;
ঐ যাচাইয়ের পথে দেখা দেয় বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আশা-হতাশা, আলোক-অন্ধকার, অথচ
কোনো কিছুই চরম নয়, তার লক্ষ্য বিশুদ্ধ জগৎ সৃষ্টি করবার প্রয়াস। ঐ
দ্বন্দ্ব এবং ঐ লক্ষ্য তাঁর কবিতার চারিত্র।
কবিতায়, কবির মনোক্ষেত্রে,
সমসাময়িকতার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে অতীত সকল ও ভবিষ্যৎ সকলের। তিনি সেজন্য
যাত্রার কথা বলেছেন, বর্তমান থেকে অতীতে, কিংবা ভবিষ্যৎ থেকে অতীত ঘুরে
বর্তমানে, উদ্দেশ্য : ব্যাপকতর অভিজ্ঞতার মধ্যে স্বকাল ও সাম্প্রতিকতা
মুষ্টিবদ্ধ করা। ঐ কারণে তার বিশ্বাস তৈরি হয়েছে অনবরত পরিব্রাজনার মধ্যে
দিয়ে, বিশ্বাস তার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তজাত নয় বরং বিভিন্ন কৌণিক অবস্থান
থেকে একটি বিষয়ের পর্যবেক্ষু, ঘুরে-ঘুরে দেখে-দেখে আস্তে-আস্তে বিষয়ের
কাছে, মর্মে পৌঁছোবার প্রয়াস। হয়তো ঐ কারণে তাঁর কবিতায় ভিন্ন-ভিন্ন
প্রেক্ষিত আছে, চূর্ণদৃশ্যাবলী, বিচিত্র ঘটনার উল্লেখের মধ্যে দিয়ে তিনি
ছড়িয়ে দিয়েছেন অস্থিরতা, কিন্তু ঐ অস্থিরতা প্রজ্ঞার মতন মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে
, সেজন্য হঠাৎ আমাদের উদ্বেল করে না, আস্তে-আস্তে ঐ অস্থিরতা আমাদের মধ্যে
সংক্রমিত হয়ে যায়, আমরা কালের মধ্যে নিজেদের উপস্থাপিত করি। আর কাল, তার
দিক থেকে আবহমান , অখণ্ড; বর্তমানে ঐ আবহমানেরই বিস্তৃতি, সেজন্য আবহমানের
পটভূমিতে বর্তমান উপস্থাপিত করে তার দ্বন্দ্বের জটিলতা তিনি তুলে ধরার
চেষ্টা করেছেন। সেজন্য তাঁর কবিতা গাণিতিক সংগঠন নয়, অনুভব ; অনুভূতির
মাধ্যমে বিভিন্ন আবিষ্কার, আর আবিষ্কার কোনো সিদ্ধান্ত/মতাদর্শ সমর্থনের
জন্য নয়, বিশ্বাসকে বিভিন্ন কৌণিক অবস্থান থেকে যাচাই করা, নিংড়ে দেখা, তার
ক্ষেত্রে বিশ্বাস মানুষের শুভবোধে আস্থা, ঐ অবস্থা তৈরি হয়েছে। পারিবারিক
আলোকিত আবহাওয়া থেকে, ঐ আবহাওয়া পরিশীলিত হয়েছে দেশ-বিদেশের সাহিত্য পাঠে,
সমসাময়িক বাস্তব ঘটনার তুমুল তাণ্ডবে, ষাট দশকের মানববাদী ধারা ও
মার্কসবাদের প্রভাবে, তিনি এভাবেই তার মানস গড়ে তুলেছেন।
তিনি
যে-মূল্যবোধ অর্জন করেছেন তার কেন্দ্র, ভিত্তি, ভূমি হচ্ছে বিশ্বাস।
বিভিন্ন মতাদর্শের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার তার কাছে বড়ো নয়, বরং বড়ো বিশ্বাস ও
অবিশ্বাসের মধ্যেকার বিষয়, কারণ বিশ্বাসই তাঁর কবিতার কেন্দ্রে মানুষকে
স্থাপন করেছে। ঐ মানুষ নিসর্গে, ঘটনায়, আশা নিরাশায় বেপথুমান, সেজন্য জীবন
কোনো দূরবর্তী ইতিহাসের অধ্যায় কেবল নয়, ঐতিহ্য জীবন থেকে লুপ্ত হয়ে
কোনো-গ্রামে সংরক্ষিত নয়, জীবন সংরক্ত, ঐতিহ্য জীবন্ত, মনিরুজ্জামানের কাছে
জীবন ও ঐতিহ্য পরস্পর প্রবিষ্ট, মূল্যবোধ তৈরির উপায়। জীবন কেবল নষ্ট
কিংবা মানুষ ? তিনি জবাব খুঁজেছেন। অনবরত, আবিষ্কার করেছেন নিত্য শুভবোধ,
এভাবেই বিভিন্ন দিকে, হতাশা ও ধ্বংসশীলতার পাশাপাশি তিনি প্রয়াস করেছেন
নিসর্গ, সমাজ , ইতিহাসের মধ্যে কোনো ঐতিহ্য আবিষ্কারের যেখানে প্রতীক,
রূপকথা, জ্ঞানের মানবিক ভাষা টিকে আছে। সবকিছু ভেঙে যাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে
জীবন, মানুষ, বিশ্বাস ; মূল্যবোধ সংক্ষিপ্তে পর্যবসিত ; সেক্ষেত্রে
মনিরুজ্জামান শর্তহীন কল্পনার চর্চা করেন নি, কারণ প্রাত্যহিক জীবনে
মূল্যবোধের শিথিলতা মূল্যবোধহীনতার বিরুদ্ধে কোনো যুক্তিজাল নয়, তিনি
মূল্যবোধ খুঁজে বেরিয়েছেন ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে, কল্পনার নানা পরিসরে,
ঘটনার বিচিত্র বলয়ে।
তাঁর কবিতায় উপাদানের গভীর ও বিস্তৃত চাপ,
অভিজ্ঞতার চাপ উপস্থিত, এই অভিজ্ঞতার অন্তর্গত তাঁর জীবন এবং মহাজীবন। তিনি
চেষ্টা করেছেন তাঁর ব্যক্তিত্বের বাইরের বিভিন্ন হৃদয়ের বোধ, সমাজ
বাস্তবতা ও সংঘাতের জের ধরার, সেজন্য বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে (ফিরে
এসো হুমায়ুন আজাদ, ময়ুখ চৌধুরীকে, কবি ওহীদুল আলম : স্মরনগাঁথা সংবর্ধনায়
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ) যে-কাব্যিক বিশ্ব গড়েছেন তা
আমাদের চেনা পৃথিবীর মতন। তিনি পৃথিবীকে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করেন নি
নিজের মাধ্যমে, বরং দর্শন কল্পনা, ব্যক্তি, ঘটনার যন্ত্রজালের মাধ্যমে, ঐ
সব যন্ত্রজাল দিয়ে তিনি ব্যক্তিকে ছিড়ে খুঁড়ে দেখেছেন। তাঁর কৃতিত্ব : তিনি
কবিতায় সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছেন, তিনি সার্থকভাবে তৈরি করেছেন। কাব্যিক
প্রতীক মনোজ, ধর্মজ, রাজনৈতিক ভাবকল্পের প্রক্রিয়া আধুনিক মানসের ওপর। তিনি
বাইরে থেকে বুদ্ধিবাদী ভাবকল্প আরোপ করেন নি আলাউদ্দীন আলা আজাদ কিংবা
শামসুর রাহমানের মতন কল্পনাকুশল জীবনের উপাদানের ওপর। তাঁর কৃতিত্ব একটি
ঐতিহাসিক মনোজ প্রক্রিয়া কল্পনা করা ব্যক্তিক মনোজ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে।
সেজন্য তাঁর পরিবৃদ্ধি তাঁর একান্ত পরিবৃদ্ধি কেবল নয়, সময়ের ঘটনার
মতাদর্শেরও; তার ব্যক্তিত্বে ধরা পড়েছে নানা সময়ের মতাদর্শের সতর্ক বিতর্ক
চেতনা।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন : কবিতার চেয়ে তার উপকরণ বড়ো নয়।
বিজ্ঞানের কিংবা ইতিহাসের কিংবা সমাজের জ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাসের
সমাজের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে, চারদিককার প্রতিবেশ চেতনায় অভিজ্ঞতা স্থাপন
করে কবিতা নির্মাণের কথা তিনি আমাদের বলেছেন। আমরা তুমুল, জটিল এক পৃথিবীর
বাসিন্দা, সেখানে কবিতা নির্মাণের বেলায় বিশেষ অনুভূতি ও আবেগের জন্ম
বিভিন্ন ও বিচিত্র ঘটনা সংস্থান থেকে উৎপন্ন, সেজন্য কবি যুগের উপযুক্ত
বিচিত্র মানসসত্তার অধিকারী, কবি অগ্নিসংস্কারের মতন আধুনিকতাকে নিজের
সত্তায় ও সম্ভাবনায় বিশুদ্ধ করে তোলেন, বিভিন্ন কালসন্ধির নতুন-নতুন
নির্ণীত সত্যের স্পর্শে নিজেকে আলোকিত করেন। মনিরুজ্জামানের অভিজ্ঞতা তাঁকে
শিখিয়েছে : মানুষ কমবেশি স্থিত ও নিঃসময় ; ঐ উপলব্ধি তিনি অনবরত নির্মল
করেছেন জীবনের শেষ অবধি। দুঃসময়ে কিংবা আলোড়নে তাঁর কবিতা আমাদের শান্তি
দেয়, আচ্ছন্নতার মধ্যে স্থিরতর করে তোলে, তাঁর সঙ্গে আমরাও বলি : দিগন্তের
উদভাসন ঘটে দিবাকর এলে সুপ্রভাতে/জগৎ দীপিত হয় তবু এই দ্বিতীয় সুর্যের
হাতে।
৩
মনিরুজ্জামান তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রথমেই শব্দের প্রেমে
পড়েছেন। তাঁর কাছে শব্দ সুন্দর, উজ্জ্বল ও লাবণ্যময়, তিনি শব্দের আলো ছড়াতে
চেয়েছেন দূরে, আর। শব্দের বিভায় কাছে আনতে চেয়েছেন সোপন ; সেজন্য শব্দের
বিবর্ধমান বিবরণ, ধ্বনি আর আবেগ তাঁকে উৎপন্ন করেছে শস্যের মতন। তিনি
বারবার নিজেকে ফলিয়েছেন, শব্দের মধ্যে দিয়ে তিনি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন
নিজেকে ও অন্যকে, এবং এই অন্যটি তিনি নিজেই : অন্যের আয়নায় তিনি নিজেকে
দেখেছেন, নিজেরই কথা বলা শুনেছেন, দেখেছেন শব্দে তৈরি হচ্ছে জগৎ সূর্যোদয়
থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। কিংবা নিশীথের ভীষণ থেকে বদান্য দিন পর্যন্ত,
শব্দে জেগে ওঠে উষ্ণতা, শব্দে চঞ্চল হয় সর্বজীব, শব্দে লিপ্ত হয় মানুষেরা।
সেজন্য মনিরুজ্জামানের প্রাথমিক নায়কেরা নিঃসঙ্গ, ভাবনায় তারা সচেষ্ট,
অনুসন্ধানে সুখি, তাদের খোঁজের লক্ষ্য : নিজেদের মানস, শব্দ দিয়ে সেই মানসে
যাওয়া যায়, সেই লক্ষ্যের টানে তারা আবেগে উত্তাল, বারবার ভেঙে যায়
সাংসারিক বাস্তব, শব্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারা যায়, সেজন্য তথ্য অকিঞ্চিত্বর,
তারা মেলাতে চায় বিভিন্ন প্রতিষঙ্গ, সেজন্য শব্দ দিয়ে তারা ঘুরে-ঘুরে তাকায়
নিজেদেরই দিকে। এভাবে মনিরুজ্জামান সাহিত্যে এক ধরনের চরিত্র তৈরি করেছেন,
চেয়েছেন : শব্দ দিয়ে নড়ানো যায় কি দেহের কিংবা সমাজের ভিত? শেষ পর্যন্ত,
মনিরুজ্জামানর অন্তিম চরিত্ররা হয়ে ওঠে বাকপ্রেমিক, শব্দেরই কারিগর; কারণ।
একটাই : মনিরুজ্জামান নায়কদের মধ্যে দিয়ে তার গন্তব্যে পৌঁছেছেন। শব্দ
প্রেম আসলে ভাষারই প্রেম, আর ভাষা চর্চা তাঁকে ভাষার মূলে নিয়ে যায়। তিনি
শুরু করেছেন নিঃসঙ্গ আবেগ নিয়ে, সেজন্য প্রাথমিকভাবে তাঁর শব্দ উত্তাল
কিংবা অস্থির, উজ্জ্বল ও বিচ্ছুরিত, কিন্তু অন্তিমে, গন্তব্যে পৌঁছে তিনি
ঘন আর সংহত, তিনি নিজের মধ্যে সংহার করেছেন তার আবেগের উত্তালতা, সংবরণ
করেছেন উচ্ছ্বাসের অমিতাচার, বদলে লাভ করেছেন ভাষার সংহতি আর বেগ,
দূরস্পর্শী ইঙ্গিত আর রীতির ঘনত্ব, সেজন্য শেষ পর্যায়ে তাঁর নায়কেরা কিংবা
তিনি শব্দকে ভাষার মধ্যে শৃঙ্খলায় প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর, ঐতিহ্যের খোঁজে
বর্ধিত বেগ, এভাবেই মনিরুজ্জামান শব্দের গন্তব্যে পৌঁছে ভাষার উৎসে নিজেকে
নিয়ে গেছেন।
মনিরুজ্জামান নিশ্চিতভাবেই ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদে
বিশ্বাসী। তাঁর অভিজ্ঞতা সংগ্রহের ধরণ একান্তভাবে ব্যক্তিক, জগৎ-সংসার
সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ও তাঁর কবি কল্পনার মধ্যে একটা ফারাক আছে, কোনো সাঁকো
নেই দুইয়ের মধ্যে, সেজন্য মনিরুজ্জামানের পারাপার নেই বিষয় বিশ্বের সঙ্গে
ব্যক্তিক বিষয়ীর, তাই তাঁর বিচ্ছিন্নতাবোধে তাঁর অভিজ্ঞতার শুদ্ধি ঘটায় না,
তিনি নিজেকে কখনো ছাড়তে পারেন না। তাঁর নিজের প্রতি ভালবাসা তীব্র,
জ্বলন্ত, প্রখর, সেজন্য তাঁর রচনায় বিস্ময়কর নাটকীয়তা ও নৈপুণ্য জ্বলজ্বল
করে, কিন্তু তাঁর আত্মপ্রেম, লোভ, আসক্তি তার শিল্প জিজ্ঞাসার চৈতন্যের
শুদ্ধতা তৈরি করে না, তিনি থেকে যান অতুলনীয় কুশলী হিসাবে, তার শিল্পের
নন্দনতত্ত্ব চমকের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়, সমগ্র জীবনের বদলে মুহূর্তের সন্ধানে
তিনি পশ্চিমী সাহিত্যের বিভিন্ন ঝেকে তাল মেলাতে থাকেন, এভাবেই তাঁর কাজে
এসে যায় ব্যক্তিগত ঝোঁকের প্রবলতা, সেজন্য তাঁর মনোভঙ্গি থেকে থেকে আমাদের
চমকিত করে, আমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাই, তাঁর ভাষা আমাদের দখল করে, কিন্তু
তার অভিজ্ঞতার বয়স বাড়ে না কারণ হয়তো তাঁর ব্যক্তিক বিচ্ছিন্নতাবোধ, তার
অভিজ্ঞতার ব্যক্তিক প্রাধান্য, তাঁর নন্দনতত্ত্বের আত্মসর্বস্বতা। অথচ
মনিরুজ্জামানের ভাষা, শব্দ ক্ষেত্রে নির্লোভ হতে পেরেছেন শেষ পর্যন্ত,
ভাষা জিজ্ঞাসায় উপলব্ধি করেছেন ভাষায় চিত্তশুদ্ধতা দরকার, তাই আবেগ উচ্ছাস
ছেড়ে-ছেড়ে শব্দকে ঘন, গভীর, শানিত করে তুলেছেন; কিন্তু অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে
তিনি নির্লোভ হতে পারেন নি, সেজন্য বিষয়বিশ্বের কাছে ব্যক্তিবিষয়ীর
আত্মবিসর্জন তার ক্ষেত্রে ঘটে না, তার অভিজ্ঞতার আধ্যাত্মপ্রকাশ শেষ
পর্যন্ত থেকে যায় একান্ত ব্যক্তিক, তার জ্ঞান ও কল্পনার মধ্যে, তাঁর আবেগ ও
শিল্প জিজ্ঞাসার মধ্যে থেকে যায় বরাবর এক পাঁচিল : উল্লমফনের চেষ্টা
মনিরুজ্জামানের নেই। আশ্চর্য প্রাণশক্তি ও অসাধারণ রূপদক্ষতা তাঁর
প্রতিভাকে চিহ্নিত করে, তিনি খুঁজে ফিরেছেন মৌল ভিন্নতা : জড় ও চৈতন্যের,
নরনারী সম্বন্ধের ; ঐ মৌল ভিন্নতাকে তিনি কল্পনার আবেগে, তীব্র বোধশক্তিতে,
প্রখর উপলব্ধিতে তাঁর সাহিত্যকর্মে মেলে ধরেছেন, মনিরুজ্জামানের জীবনে
এভাবেই সাহিত্য আশ্রয় পেয়েছে।