মানুষের
মৌলিক অধিকার হলো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান; এই তিনটির মধ্যে মৌলিকতম হলো
অন্ন। উপায় না থাকলে মানুষ খোলা আকাশের নিচে, ফুটপাতে, রেলস্টেশনে,
গাছতলায়ও থাকতে পারে। ন্যূনতম বস্ত্রেও মানুষের চলে যায় বা এক পোশাকে
অনেকদিন চালিয়ে নেওয়ার উদাহরণও কম নয়।
প্রায় বস্ত্রহীন হয়ে খোলা আকাশের
নিচেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু খাওয়া ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। যত
নিঃস্ব হোক আর হাজার কোটিপতি হোক, দিনে অন্তত তিনবেলা তাকে খেতেই হয়।
এখানেই আটকে গেছে বাংলাদেশের মানুষ। দুই বেলা দুই মুঠো খাবার জোগাড় করতেই
এখন বাংলাদেশের মানুষের নাভিশ্বাস। বেঁচে থাকাই বড় দায় হয়ে গেছে।
আওয়ামী
লীগ টানা চার মেয়াদে সরকার পরিচালনা করছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এবার
আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তারা সেই লক্ষ্যে এগোচ্ছিলও
দারুণভাবে। এটা মানতেই হবে, দেড় দশকে বাংলাদেশের যত উন্নয়ন হয়েছে, আগের
পাঁচ দশকেও তা হয়নি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অনেক ইতিহাসের
সাক্ষী করেছে বাংলাদেশকে। কিন্তু ধাক্কাটা লাগে করোনা এসে। করোনায় গোটা
বিশ্বের অর্থনীতিই স্থবির হয়ে গিয়েছিল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতিতে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। সেই চাপ আর কাটিয়ে
ওঠা যায়নি।
সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯-এর
ওপরে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়ে গিয়েছিল ১০ শতাংশ। তার মানে খাবারের দাম
বেড়েছে ১০ শতাংশ হারে। কিন্তু মানুষের আয় সেই অনুপাতে বাড়েনি। ফলে সাধারণ
মানুষ চরম চাপের মুখে পড়েছে। সরকারের বাজেটেও আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। কিন্তু
সরকার দেশি-বিদেশি নানা উৎস থেকে ঋণ নিয়ে তাদের ঘাটতি সামাল দেয়। সাধারণ
মানুষের সেই সুযোগ নেই। তাই তাদের চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
তাহলে সাধারণ
মানুষ টিকে আছে কীভাবে? এই প্রশ্নের আসলে কোনো উত্তর নেই। সব মানুষের বছরের
বা মাসের আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব থাকে। কিছু খরচ আছে নির্ধারিত। বাসা ভাড়া,
সন্তানের পড়াশোনার খরচ, চিকিৎসা ব্যয়, পত্রিকা, ইন্টারনেট, ময়লা ফেলার খরচ,
বাসার সহকারীর বেতন-এগুলো হুট করে কমানোর কোনো উপায় নেই। ফলে ব্যয় বাড়ার
মূল চাপ পড়ে বাজার খরচে। কিন্তু সেই জায়গায় ব্যয় বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলে
বাজারে গিয়ে মানুষের দিশেহারা অবস্থা।
আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী
ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকেই এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ
করেছিল। বাজেটেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু খালি কথায়
চিড়া ভেজে না, ভিজবেও না। কথা হয়েছে অনেক, কাজ হয়নি কিছুই। বাজারে হাহাকার
চলছেই। কারও যেন কোনো মাথাব্যথা নেই।
অন্ন মানুষের মৌলিকতম চাহিদা বটে।
তবে খাবারেরও অনেক ধরন আছে। মানুষের একদম বেঁচে থাকার জন্য যেমন খেতে হয়।
আবার অনেকের কাছে খাবার মানেই বিলাসিতা। কারও এক বিকালের চায়ের আড্ডার খরচ,
অনেক পরিবারের সারা মাসের খরচকে ছাড়িয়ে যায়। বিলাসিতার কথা যদি বাদও দেই,
সাধারণ মানুষকে তো বাঁচার জন্য হলেও খেতে হবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে
পাল্লা দিয়ে মানুষের জীবনযাত্রার মানও বেড়েছিল। বাঁচার জন্য খাওয়ার
পাশাপাশি সুষম খাদ্যের কথাও ভাবছিলেন কেউ কেউ। দাম বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে
কমেছে খাওয়ার মান, হারিয়ে গেছে সুষম খাদ্যের ভাবনা।
নি¤œবিত্তের মানুষ
তবু চেয়ে চিন্তে, সরকারের নানা সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় কিছুটা সুরক্ষা
পায়। কিন্তু সমস্যা হলো মধ্যবিত্ত আর নি¤œ মধ্যবিত্তের। তারা না পারে কইতে
না পারে সইতে। তারা লাইনেও দাঁড়াতে পারে না, আবার বাজারেও যেতে পারে না।
আগেই বলেছি, দাম বাড়ার সাথে সাথে সুষম খাদ্যের ভাবনাটা হারিয়ে গেছে।
সন্তানকে প্রতিদিন একটা ডিম খাওয়ানো বা দুধ খাওয়ানো এখন বিলাসিতা। অনেক
মধ্যবিত্ত পরিবার আছে মাসে বা দুই মাসে মাংসের দেখা পায়।
অন্য কোথাও
যেহেতু হুট করে খরচ কমানোর উপায় নেই, তাই মূল চাপটা পড়েছে বাজারে মানে
খাবারে। সব ধরনের বিলাসিতা বাদ দিয়ে বেঁচে থাকাই দায়। বাংলাদেশে
জিনিসপত্রের দাম একবার বাড়লে আর কমার নাম নেই। অল্প অল্প করে বাড়তে বাড়তে
সব জিনিসের দামই এখন নাগালের বাইরে।
যে পরিবার নাজিরশাইল চাল খেতো, তারা
হয়তো মোটা চালে চলে গেছে। কিন্তু মোটা চালের দামও চিকন চালকে ছাড়িয়ে গেছে।
মানুষ বাজারে গিয়ে চাষের সস্তা মাছ আর ফার্মের মুরগি খোঁজে। কিন্তু মাছ
আর মুরগির দামও বেড়েছে। যারা নিয়মিত বাজার করেন, তাদের অবস্থা খারাপ। কোন
মাছের সাথে কোন তরকারি মেলাবেন; সেই হিসাব মেলাতেই সময় ফুরিয়ে যায়।
সবজি
খেয়ে দিন পার করবেন, সেই উপায়ও নেই। সব সবজির দামই সেঞ্চুরির কাছাকাছি।
বাজারে গিয়ে মানুষের এই অসহায়ত্ব দেখা যায়। কোনো কিছুতে হাত দেওয়ার উপায়
নেই। মানুষ অল্প টাকা বাঁচানোর জন্য দীর্ঘসময় দর কষাকষি করে। শেষে রুই মাছ
কিনতে গিয়ে পাঙাশ কিনে ফেরে। মাছ একটু পচা হলে দাম একটু কম। সবজিও একটু পচা
হলে কিনতে সুবিধা হয়। আগে মানুষ পচা জিনিস দেখতো না কেনার জন্য। আর এখন
দেখে কম দামে কেনার জন্য।
নিয়মিত দাম বাড়ার প্রবণতা তো আছেই। মাঝে মাঝে
দুয়েকটা পণ্যে আগুন লাগিয়ে দেয় বাজার সিন্ডিকেট। কখনো ডিম, কখনো মুরগি,
কখনো পেঁয়াজ, কখনো আলুও আকাশে উড়ে যায়।
বাজারের এই হাহাকার
নীতিনির্ধারকদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় বলে মনে হয় না। তারা খুব নির্বিকার
চিত্তে বলেন, জিনিসপত্রের দাম যেমন বেড়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে।
কিন্তু দাম কতটা বেড়েছে, আর ক্রয়ক্ষমতা কতটা বেড়েছে; সেই হিসাবটা তারা করেন
না। করেন না, কারণ এইসব হিসাবনিকাশে তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের কাছে
বাজারদর মানেই যেন কৌতুক। সেই কৌতুকের মতো। চালের দাম বেড়েছে বলে মানুষ ভাত
খেতে পাচ্ছে না। শুনে রাজা বললেন, তাহলে তাদের পোলাও খেতে বলো।
সমস্যা
হলো, চাল, ডাল, আটা, পেঁয়াজ, মাছ, মাংসের দামে আমাদের নীতিনির্ধারকদের কিছু
যায় আসে না। তারা নিজেরা বাজার করেন না, আর এইসব শ বা হাজারের কথায় তাদের
কিছু যায় আসে না। তাদের হিসাবনিকাশ লাখে বা কোটিতে। আগেই বলেছি, যাদের এক
বিকালের চায়ের আড্ডা বিল ১০ হাজার টাকা, তাদের কাছে বাজারদর কোনো বিষয় নয়।
দেয়ালে
পিঠ ঠেকে গেলেও বাজার দর নিয়ে কোনো কথা নেই, আন্দোলন নেই। কোটার দাবিতে
ঢাকা অচল হয়ে যায় আর বাজারে মানুষের জীবন অচল হয়ে বসে আছে অনেক আগেই।
আন্দোলন নেই, কারণ মধ্যবিত্তের কোনো ভয়েস নেই, কোনো সংগঠন নেই। তারা শুধু
অ্যাডজাস্ট করে এবং টিকে থাকে।
মান কমাতে কমাতে একদম নিচের ধাপে নেমে
যায়। বাসা বদল করে সস্তা বাসায় যায়। একদম না পারলে গ্রামে চলে যায়। মানুষ
আসলে টিকে আছে কোনোরকমে না ভাসিয়ে। এভাবেও বেঁচে থাকা যায় বটে। কিন্তু
একদিন টুপ করে ডুবে যাবে, কেউ টেরও পাবে না।
লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ