= = = = = = = = = == = = = = = = = = = = = == = = = = = = = == = = = = = = = = = = == = = = =
= = = = = = = = = == = = = = = = = = = = = == = = = = = = = == = = = = = = = = = = == = = = =
শহীদুল জহিরকে অনুকরণ
কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ।।
জিয়াউদ্দিন দেওয়ান এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। জিয়াউদ্দিনের মাধ্যমে আমি প্রথম শহীদুল জহিরের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হই। আনোয়ার আহমেদ এর ‘রুপম’ পত্রিকার দুটি সংখ্যা জিয়াউদ্দিন আমাকে দেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। একটিতে পাই, আগারগাঁ কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই। আরেকটিতে ‘‘কাঠুরে এবং দাঁড়কাক’’। দুটি গল্পই পরবর্তীতে ‘‘ ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প ’’ গ্রন্থে স্থান পায়। প্রকাশ করেন শিল্পতরু। শহীদুল জহিরের গল্প গ্রন্থই দু’টি।অপর গ্রন্থের নাম ‘‘ ডলু নদীর হওয়া ও অন্যান্য গল্প।’’ আমি তখন ভালো গল্প খুঁজছি। ভালো গল্পের সংজ্ঞা আমার জানা নেই। ভালো লাগলেই হলো। ভালো লাগলো দুটি গল্প । ভাবলাম শেয়ার করতে হবে, একধরণের অন্তরগত তাড়না অনুভব করছিলাম। মাঠে নামলাম, সকলের প্রশ্ন এগুলি কী ধরণের গল্প। আজকে শহীদুল জহিরের গল্প সম্পর্কে অনেক কথা বলা যায়, কিন্তু সেদিন বাতাসে ভাসছিল ‘আখ্যান’ধর্মী গল্প। যারা পড়ছে তারাও শুনতে পায় আখ্যানধর্মী গল্প। তাতে মন ভরে না অনেকের। আসল কথা মন মজে না। একই রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম অনেকবার। কেউ বললেন, একমুখী রাস্তা। প্রবেশ করা যায় ফেরা যায় না। ওয়ান ওয়ে রোড।
খালেদ চৌধুরী গল্পকার, লিটল ম্যাগ ঘুংঘুরের সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত। অনেকদিন পরে খালেদ নতুন খবর দিলো, আহাম্মেদ খান হীরকের গল্প, শহীদুল জহিরের গল্পের মতো। তিনি প্রবেশ করতে পারেন আবার বের হতেও পারেন। প্রাইভেট বিশ^ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে আহাম্মদ খান হীরকের গল্প নমুনা হিসেবে পাঠালাম। তিনি ভালো গল্প লেখেন। তিনি ফনা নামালেন।ধন্যবাদ দিলেন। তিনিও বলেছিলেন ওয়ান ওয়ের কথা।সম্ভবতো ওনার জন্য পাঠিয়েছিলাম আহমেদ খান হীরকএর গল্প ‘সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা।’
আমি ইতোমধ্যে নিজের গল্পের বাক্য গঠনে শহীদুল জহিরের রীতিতে আক্রান্ত হলাম। ব্যাপকভাবে “তখন” শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে সময়কে ঘার ধরে নিয়ন্ত্রন করার কৌশল। আর, গল্পের শেষের দিকে সংখ্যাবাচক ক্রম পরিস্থিতি তৈয়ার করা। না, এ সামান্য অভ্যাস দিয়ে শহীদুলের গদ্য অনুকরণ করা যায় না। ‘তখন’ অথবা ‘তারপর’ গল্পে ব্যবহার করার প্রাচিন ইতিহাসটি হলো, এই খানে এই কথা থাকুক পরিয়া, আসুন অমুকের কথা শোনি মনো দিয়া। মাঝখানে গল্পকারের মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকে শ্রোতা। মনে মনে বলতে থাকে, তারপর তারপর। ‘তারপর’ হলো গল্পের অন্তশ্রাভি লাভা, দ্রুত ধরতে চাওয়া; গল্পে, তারপর কী। আধুনিক গল্পে এর উপস্থিতি সম্পূর্ণ হারামই বলা যায়। আমি ব্যক্তিগত তাড়না থেকে সৈয়দ অলিউল্লাহর গল্পের শরীরে চোখ বুলালাম কিঞ্চিৎ। ‘পরাজয়’ গল্পে ‘তারপর’ পেলাম কুড়ি (২০) বার। হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত ‘প্রতীক’ প্রকাশনির কথা বলছি, তারা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র গল্প সমগ্র প্রকাশ করেছেন। সমগ্রের প্রথম গল্প নয়নচারা’র শরীরে- হয়তো বা, তখন, তারপর রয়েছে ২১ বার। নয়নচারা অনেকেরেই প্রিয় গল্প।গল্প পড়ার তালে নিমজ্জিত থাকলে এসব চোখে পড়ার কথা নয়। উদ্দেশ্য থাকতে হবে।হাতে গুনে দেখতে হবে, তিনি সময়কে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তাহলে চোখে পড়বে। আবার এই রকম শব্দ মোহাবিষ্ট মানুষকে লোগোফাইল বলে।
পরে আবিস্কৃত হলো শহীদুল জহিরের গল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লার গল্প রীতির প্রভাব রয়েছে। কী আজব খবর, প্রভাব যেন অপরাধ। শিল্পতো এরিস্টটলের যুগ থেকে অনুকরণের রশিতে বাঁধা। কিন্তু সাবধান হতে বলা হয়েছে। হুবহু অনুকরণ ঠিক না। কোন না কোন স্থানে স্বকিয়তা থাকতে হবে। অনুকরণ যেন নিজের মতো হয়, আপনার চিন্তার ছাপ থাকতে হবে। গল্পের চরিত্র -স্থান, সময়, প্রেক্ষিত, গল্পকারের আপন ভুবনে জারিত হয়ে নিজস্ব একটা রুপ নেয়। আহাম্মদ হীরক খানের গল্প শহীদুল জহিরের মতো হয়েও এই গল্প শহীদুল জহিরের না।
পরের কথা যাদুবাস্তবতা।যাদু বাস্তবতা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।একটি সংবাদ দেই। হামীম কামরুল হক প্রশ্ন করছিলেন, ‘সাহিত্য পাড়ায় আপনার পছন্দনীয় বিষয়?
শহীদুল জহির বলছেন, ‘যাওয়াই হয় না। যেতে চাই না। গেলে অনেকে ডিভেট করতে আসে যাতে আমি যেতে চাই না। এটা হয়তো না যাওয়ার একটি কারণ। আমি যেটা বুঝি তা হলো, অতো বুঝেটুঝে লেখালেখি হয় না।’
লাফ দিয়ে ওঠার কথা, যে কোন তরুণ লেখক মাত্রই লাফ দিয়ে ওঠবেন। কিন্তু শহীদুল জহির কি খুব কম জেনে কম বুঝে লিখতে শুরু করে ছিলেন ? তিনি কতোটা সচেতন ছিলেন আমরা তাঁর জবানিতে শোনি।
কবি ও কথা সাহিত্যিক চঞ্চল আশরাফ প্রশ্ন করছিলেন।
চঞ্চল আশরাফ: আপনি আপনার লেখায়, গল্প বা উপন্যাসে কোন ব্যাপরকে বেশি গুরুত্ব মনে করেনÑ আঙ্গিক না বিষয়, নাকি আপনি এ দুটোর সমন্বয় সাধনের পক্ষপাতি?
শহীদুল জহির : আমার মনে হয় যে এটা সমন্বয়ের ব্যাপার নয়,আসলে আমি এটা মাথায় নিয়ে কিছু করি না। কিন্তু আমি এক সময় আঙ্গিকের ব্যাপারে সচেতন ছিলাম;আমি কাঠামোর ব্যাপারে সচেতন ছিলাম,অন্তত সাম্প্রতিক কালে আমার মনে হয়েছে যে আমার গল্পে গল্প থাকতে হবে, কথা বস্তু বা বিষয় বস্তু এটা খুবই ইম্পরটেন্ট। কাজেই আামর গল্পে গল্প থাকে, এটা কেবলই কাঠামো নির্ভর বা খালি ভাষার বিষয় নয়। এখানে গল্প থাকে এবং এ ব্যাপারে খুবই পার্টিকুলার যে গল্প থাকতে হবে। কিন্তু এখন আমার মনে হয় যে দুটোই খুব ইম্পরটেন্ট, গল্প থাকা যেমন জরুরি,আমি মনে করি, তেমনি কাঠামোর বিষয় যে জরুরি নয় এটা আমি মনে করি না। যদি আমার সৃজনশীলতার প্রসঙ্গে আসি তাহেলে সৃজনশীলতা কোথায় কাজ করে। এটা কি খালি গল্প তৈরিতে কাজ করে, না কাঠামো তৈরিতেও সৃজনশীলতা কাজ করে। আমার তো মনে হয় সৃজনশীলতার প্রসঙ্গটি রচনাশৈলীর সঙ্গেও জড়িত। এবং আমি দুটোর মধ্যেই কাজ করি। কোনটর সঙ্গে কোনটা কাজ করে আমি সিওর না। আমার মনে হয়, খুব সচেতনভাবে সেটা করি না। গল্প তো আছেই, আর কাঠামো আমার গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে।’
জাদুবাস্তবতা প্রসঙ্গে তিনি কথা সাহিত্যিক আহামেদ মোস্তফা কামালকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জাদু বাস্তবতার ব্যাপারটা তো আমি মার্কেসের কাছ থেকে পেয়েছি। এবং এটা আমি গ্রহণ করেছি দুটো কারণে। প্রথমত চিন্তার বা কল্পনার গ্রহণ যোগ্যতার যে পরিধি সেটা অনেক বিস্তৃত হতে পারে বলে আমি মনে করি। দ্বিতীয়ত, আমি আসলে বর্ণনায় টাইমফ্রেমটাকে ভাঙতে চাচ্ছিলাম।’
তরুণ গল্পকার ও গবেষক মোজাফ্ফর হোসেন তার লেখকের হ্যাণ্ডবুকে লিখেন, “শহীদুল জহির কাঠামো বা ন্যারেটিভ সচেতন লেখক ছিলেন। তাঁর ছোটগল্পের কাহিনিতে অন্তর্বয়ান ও বহির্বয়ান একেই সঙ্গে ঘটে। শহীদুল জহির অধিকাংশ সময় সমষ্টির বয়ানে গল্প লেখেন। অর্থাৎ মহল্লা বা ডাউনটাউনের লোকজন সেই গল্পের কথক। তিনি তাঁদের মুখে গল্পটা তুলে দিয়ে নিজে কিছুটা দূরে সরে জান।অনেকটা পাঠকের অবস্থানে অবস্থান করেন। ফলে তিনি গল্পে কথা বলার ধরন মিশিয়ে যে-কথন তৈরি করেন সেখানে আক্ষ্যান বা অবয়ব বলে কিছু থাকে না। এজন্য তাঁকে উত্তরকাঠামোবাদি (ঢ়ড়ংঃ-ংঃৎঁপঃঁৎধষরংঃ) হিসাবে ভাবতে পারি।”
প্রশ্ন হলো তাহলে আখ্যান কোথায় গেলো?
ভারত বর্ষের আজকের ব্যারিলিই পাঞ্চাল রাজ্য। পাঞ্চাল কন্যা দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের গল্পটি কত জনে বলবে? দ্যৌপদী নিজে বলতে পারে। অর্জুন বলতে পারে। ভীম বলতে পারে। সর্বোপরী ভগবান কৃষ্ণ বলতে পারেন। এক গল্প যখন এতোজনের মুখে শোনা যায় তার জন্য অখ্যান মানুষের স্বভাবের মধ্যে রয়েছে বলে ধরতে হবে।শহীদুল জহির এটা আবিস্কার করেননি ব্যববহার করেছেন মাত্র। আর একটু বলে আমরা শহীদুল জহিরের গল্পের শরীরে অখ্যান দেখবো।
কলিম খান এবং রবিচক্রবর্তী বলেন, “ বহুরকম জন্তু জানোয়ার রয়েছে কনভয়টিতে,যাবে পাশের এক মেলায় প্রদর্শনী করতে। কনভয়টি বেরোনোর সময় গেটের সামনে শুরু হলো পরীক্ষা নিরীক্ষা। মালিক একটু দূরে চেয়ার নিয়ে বসেছেন। গেটের কাছে দাঁড়িছে এক কর্মচারী। গাড়ি বেরুচ্ছে এক এক করে। কর্মচারীটি জোরে জোরে চেঁচিয়ে বলছে ১. একটি হাতি গেলো। একটি উট গেলো।... এই রকম চলছে। এই যে চেঁচানো- ‘একটি হাতি গেলো’Ñ একে বলে ‘খ্যা’। ‘খ’ মানে শব্দগুন সম্পন্ন আকাশ। সেই আকাশে যাচ্ছে একটি অর্থপূর্ণ জটিল আওয়াজ Ñ ‘একটি হাতি গেল’। এই যে ‘অর্থপূর্ণ জটিল আওয়াজ’ একে বলে খ্যা।এই খ্যা তাড়িত হয়ে যে পর্যন্ত যাচ্ছে এবং যতজন মানুষ তা শুনছেন, ততদূর পর্যন্ত কথাটি খ্যাত হচ্ছে।এই খ্যাত গতিশীল থাকলে আমরা তাকে খ্যাতি বলি। যে শব্দের সাহায্যে এই খ্যা করা হচ্ছে সেটি আখ্যা।এই আখ্যা অন হতে থাকে যে-কথামালায়, তাকে বলে আখ্যান।’
সেই অর্থে আমাদের সকলের গল্পই আখ্যান।
কেউ গুছিয়ে বলে কেউ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বলে। আমরা অনেকদিন গুছিয়ে গল্প বলার মধ্যে ছিলাম। রবীঠাকুর থেকে হাসান আজিজুল হক পর্যন্ত।মাঝখান দিয়ে আব্দুল মান্নান সৈয়দ এবং কাজল শাহনেওয়াজ সামান্য ব্যতিক্রম ছিলেন। তারও মাঝখান দিয়ে শহীদুল জহির ধাক্কা দিয়ে ‘গুছিয়ে লেখার দেয়াল ’ ভাঙলেন। তার পরপরই শাহাদুজ্জামান।
আমরা আবার মোজাফ্ফর হোসেনকে স্মরণ করিব। তিনি বলেন,‘‘প্রচলিত কাঠামো ভাঙার ক্ষেত্রে শহীদুল জহির তাঁর গল্পে চিত্রকলার কিউবিক এবং কিছু কিছুু ক্ষেত্রে অ্যাবস্ট্রাকশন ফর্ম ব্যবহার করেছেন। ফলে গল্পটা যৌক্তিকতা (জঊঅঝঙঘ) ভেঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। পাঠককে নিজেরে মতো করে সেই বিচ্ছিন্ন কোলাজকে মিলিয়ে নিতে হয়। ফলে যেমন দুর্বোধ্যতার সৃষ্টি হয় তেমনি পাঠকভেদে তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন পাঠ। শহীদুল জহির এই ফর্মের কথা উল্লেখ করে বলেছেন,‘ মার্কসের লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে যে, এখানে চিত্র কল্পের ফর্ম আছে। পিকাসোর গুয়েরনিকা যে ফর্মে আঁকা, এটা হচ্ছে কিউবিক ফর্ম। একটা জিনিস ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সেই ছবিতে ঘোড়ার মাথা একদিকে পা একদিকে; বিষয়টা হচ্ছে, ঘোড়াটা বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।Ñ আমারও মনে হয়েছে লেখাগুলি যখন যেভাবে খুশি লেখা। [সাক্ষাৎকার আর কে রনি/ শহীদুল জহিরের শেষ সংলাপ ও অন্যান্য বিবেচনা]
কি আছে শহীদুল জহিরের আখ্যানে?
বিশেষ করে একদল মানুষ থাকে। মানুষগুলো ঘোর লাগা। মানুষগুলো যে কোন অপরিনামদর্শীতায় নিমজ্জিত বা ক্রমে নিমজ্জিত হয়। অসংখ্য মানুষের ভীড়ে একজন বা দুজন ভিন্ন মানুষ থাকে। তাদের কারো নাম আবদুস সাত্তার (আগারগাঁ কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই)। একজন আকালু এবং টেপি থাকতে পারে ( কাঠুরে ও দাঁড়কাক)। একজন জাদুগির মোহাব্বত আলি ( ডুমুর খেকো মানুষ)। একজন মোহাম্মদ সেলিম (এই সময়)।তাঁর গল্পের পরিণাম আগাম বলা যায় না। জাদুর ব্যাপারটি জাদুই(ডুমুর খেকো মানুষ)। কিন্তু মার্কেসের যাদু হলো সত্যের মতো, একটি ঘটনা ঘটতে থাকবে অখচ যা ঘটার কথা নয়। যেমন ‘ আমি একটি ফোন করতে চেয়েছিলাম’ গল্প।
আর থাকে আঞ্চলিক সংলাপ। এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে পুরাণ ঢাকার ভূতের গলি বনগাঁ,দক্ষিণ মৈসুন্দি,ভজহরি সাহা স্ট্রিট, ফুলবাড়িয়া, চানখাঁর পুল ইত্যাদি অবলীলায় ঢুকে পড়ে। আর থাকে যাদু বাস্তবতা।
১.নয়নতারা ফুল না পাওয়ার,পুনরায় সৃষ্টি না হওয়ার যে বেদনা, নোটাকারে জৈনক কৃষিবিদ যে সকল সম্ভবনার কথা লিখেন তা সম্পূর্ণ অভিনব। ভাবনার বস্তু সেখানে হৃদয় স্পর্শ করে যায় অথবা মগজ উত্তপ্ত করে।
২. কাঠুরে এবং দাঁড়কাক গল্পে আকালু এবং টেপি ঘোরের ভেতর বাড়ি ছাড়ে,ঢাকা শহরে নানাবিদ ঝামেলা অতিক্রম করে অবশেষে কাকের অকহতব্য ঘেরজালে আটকে যায়, মুক্তির জন্য সরাসরি যাদু ছাড়া অন্য কোন পথ থাকে না।
৩.ডুমুর খেকো মানুষ গল্পে মোহাব্বত আলি নিজে একজন জাদুগীর। মোহাব্বত আলি জজ্ঞডুমুর বিক্রি করে। তার হাত থেকে কিছু মানুষের নিস্তার নেই। সেই মানুষেরা মোহাব্বত আলিকে এক ঘোরের ভিতর হত্যা করে।
৪. ‘এই সময়’ গল্পে প্রধান চরিত্র মোহাম্মদ সেলিম। জন্মের সময় তার মা মারা যায়। সেলিমের মুখে তখন মৃত মায়ের স্তন। সেলিম দুধ পান করে। ‘ মৃত মায়ের স্তনটি সরিয়ে নেয়ার সময় মোহাম্মদ সেলিম জন্মের পর প্রথমবারের মতো কেঁদে উঠতে চায়, কিন্তু তখন মৃত রমনীর স্ফিত স্তন থেকে পাতলা সাদা রঙের দুধ শিশুটির সারা মুখে ছড়িয়ে যায়, এবং সে তখন জননীর দুধের ঘ্রাণের ভেতর বেঘোর নিদ্রায় পুনরায় মগ্ন হয়। গল্পের শেষ প্রান্তে আমরা দেখি মোহাম্মদ সেলিমকে হত্যা করা হয়েছে। এর মাঝে গল্পের নানারূপ লোকোলৌকিক ব্যাঞ্জনা, যা মাথায় একবার ঢুকে পড়লে আর বাহির হতে চায় না।
শহীদুল জহিরের প্রায় সবগল্পই এমন ঘোর তৈরি করে।
===============কবিতা===================
প্রেম নাকি অপ্রেম?আহামেদ সাব্বির ।।
পোড়াতে পোড়াতে আগুন এখন,
স্ত্রী হয়ে গেছে।
চোখের জল ডুবিয়ে দেয়,
মনন্তরের লবণ পান্তায়।
প্রেম নামের চেঙ্গিস,
লুট করে নেয় বুকের রক্ত।
মগজের ভিতর বেহিসেবী,
তলোয়ার চালিয়ে ছিড়েখুঁড়ে ফেলে
জন্ম ও জন্ম ভূতপূর্ব সব নিউরন।
মাঝেমধ্যে রক্ত মাংসের সীমানা পেরিয়ে,
উঁকি দেয় রুহের ভিতর।
শঙ্কিত হতে চাই।
ভয় পেতে চাই।
ছেড়ে যেতে চাই।
কিন্তু, যাওয়া হয়না।
বারবার বারো ফুটের,
দু পায়ে দাঁড়ানো ছাগলকে
আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরি।
প্রেতের জগৎে গিয়ে,
আগুনের সাথে লিপ্ত হতে চাই।
ঠোঁটে চুমুক দিয়ে,
বারবার ভস্ম হই।
ধূসর ধূলোয় মিলিয়ে যাই।
তবুও, সর্বভূক মায়ার ছোবলে
বুক পেতে দেই।
সবশেষে সবকিছু সয়ে,
ফিরে আসি পরিচিত গোখরার ডেরায়।
সন্ধ্যা মিলায় আঁধারের চোখে,
গলায় প্যাঁচানো কৃষ্ণবর্ণ অজগরে।
যাচ্ছি বাড়িআতাউর রহমান ।।
বাড়ি মানেই তো মা, মা মানেই তো বাড়ি
আমি যাচ্ছি বাড়ি,
এ ছবি মায়ের মতো প্রিয়,চির-অমলিন।
একটা মাতাল নদী হেঁটে গেছে বাঁকা পথে,
পাখিদের পাঠশালা পেরিয়ে যমজ দিঘি,
সবুজ ঘুমানো মাঠ পেরুলেই বাড়ি,আমি যাচ্ছি বাড়ি।
আচ্ছা, বাড়ি কি সব মায়ের ডাকনাম ?
জানি না কেনো যে বারবার গ্রামের কথাই মনে পড়ে
একদিন এক দীর্ঘ চিৎকারের বেদনার মতো
দুঃসময় এসে তুলে নিয়ে যাওয়া মায়ের মুখখানি মনে পড়লেই;তবু
ইটে মোড়ানো এই শহর, এই কোলাহল
আলো-অন্ধকার আর ক্লান্ত পায়ের ক্লান্তিহীন চলা
এসবের পোর্ট্রেট আঁকতে আঁকতে ফুরিয়ে যাচ্ছে জীবন
ভালোবাসাহীন, শুশ্রূষাহীন।
খোলসজুবাইদা নূর খান ।।
প্রতিনিয়ত ভিতরে আমার কান্নার এ কী রোল শুনি;
গোধূলি বেলায় তাইতো সদাই বিষন্নতার ক্ষণ গুনি।
পারিনা বদলাতে নিজেরে, ছাড়াতে নোংরা শক্ত খোলস
বৃথাই কেটে গেলো তাইতো বুঝি অমূল্য সময় অলস।
পরশ্রীকাতরতা আর হিংসায় জ্বলি সর্বত প্রতিনিয়ত
পরের ক্ষতির নেশায় ক্ষয় করেই চলেছি শক্তি অবিরত।
কেন এলাম এ ধরাতে? কেন এতো শত পাপাচার?
ভণ্ডামি আর মিথ্যাচারে হারাই যে অদম্য স্পৃহা বাঁচার।
দিন যত যায়-আসে, খোলে নিত্য নতুন অনুভবের দ্বার
ভেঙে চূড়ে গড়তে গিয়ে নষ্ট যে হই বারংবার।
মোনাফেকি আর কপট লোভে হারাই নিজেরে আমি
মনের খবর আমি ছাড়াও জানেন আমার অন্তর্যামী।
আমি নিজেরেই নিজে ভালো জানি
পাপের দায় একাই আমার, অকপটে তা মানি।
ক্ষমা কী পাবো তার তরে? যিনি দয়াময়, জীবন দাতা
মরণের পর কেমনে এ মুখ দেখাবো তোমায়,পরিত্রাতা?