শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
১২ শ্রাবণ ১৪৩১
নার্গিস-প্রমীলা এবং নজরুল
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০২৪, ১২:৪৫ এএম |

নার্গিস-প্রমীলা এবং নজরুল

এখন প্রশ্ন।
কাজী নজরুল ইসলামের কয়টি বিয়ে। কাঁদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। তাঁর শ্বশুর বাড়ি কোথায়। অবান্তর প্রশ্ন। কিন্তু আলোচনার দাবি রাখে।
আমরা সবাই জানি কাজী নজরুল ইসলাম দুটি বিয়ে করেছিলেন। যাঁদের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের নতুন নামকরণ করেছিলেন কবি নিজে। প্রথম জনের নাম ছিল সৈয়দা খাতুন, কবি নাম দিলেন নার্গিস। পূর্বনাম আমরা ভুলে গেছি। কালেভদ্রে উচ্চারণও করি না। অপরদিকে দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিল কাগজপত্রে আশালতা সেনগুপ্ত, ডাকনাম দোলন বা দুলি। কবি নতুন নামকরণ করলেন প্রমীলা। বিয়ের পর প্রমীলা নজরুল। পূর্বনাম আমাদের জানা থাকলেও কেউ এ নামে তাঁকে চিনতে চাই না।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম শ্বশুর বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে। বিয়ের তারিখ আলি আকবর খানের ভাষ্য অনুযায়ী ‘বিয়ের দিন আগামী ৩ আষাঢ় (১৩২৮) শুক্রবার নিশীথ রাতে। নিশীথ রাতের বাদল ধারার মতই আপনাদের সকলের মঙ্গল আশীষ যেন এদের (নজরুল-নার্গিস) শিরে ঝরে পড়ে এদিন।’
বিয়ের আয়োজন যথামর্যাদায় প্রস্তুত। অতিথি আগমনও ঘটেছে। বিশিষ্টজনেরা আমন্ত্রিত বা নিমন্ত্রিত। বাঙ্গুরার জমিদার রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার, বাঙ্গুরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক অবনী মোহন মজুমদার, কুমিল্লা থেকে আগত ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের গোটা পরিবার (১০/১১ জন) সহ গ্রামবাসী ও আলি আকবর খানের আত্মীয়স্বজন। যথারীতি কাজীসাহেব বিয়ে পড়াতে প্রস্তুত। কাবিননামা লিখিত হয়েছে, পাঠ করাও হয়েছে।
কিন্তু....
কিন্তু কাবিননামা পাঠের পর নজরুল ইসলাম ২/১টি বিষয়ের প্রতি একমত পোষণ না করে মামাশ্বশুর আলিআকবর খানের প্রতি প্রশ্ন রাখেন। খান সাহেব আসরে ফয়সালা না করে পরে ঠিক করে নিবেন বলে জানান।
তারপর....
বিরজাসুন্দরী দেবীর ভাষ্য মতে-
‘মুসলমানের বিয়ে এই প্রথম দেখলেম। ওদের বিয়ে একদিনে হয়না, সেদিন হলো আমাদের পাকা কথার বা লগ্ন পত্রের মত।...বিয়েতো ত্রিশঙ্কুর মতন ঝুলতে লাগলো মধ্য পথেই,....’।
একশত বছর আগের কথা। আমরা কেউ জন্মগ্রহণ করিনি। তখন যাঁরা বিয়ের আসরে উপস্থিত ছিলেন তন্মধ্যে বিরজাসুন্দরী দেবীর ভাষ্য তাঁর লেখার মাধ্যমে অবগত হয়েছি। বিয়ে আসরে কমরেড মুজফ্ফর আহমদও উপস্থিত ছিলেন না। সুতরাং তিনি যখন স্মৃতিকথায় লিখেন-
‘নজরুল বিয়ের প্রহসনের পর শ্বশুর বাড়িতে এক রাত্রিও থাকেননি এবং ...নজরুল ও সৈয়দা খাতুনের আকদ পরিপূর্ণতা লাভ করেনি কারণ বিয়ের রাত্রে বাসর যাপনের ভাগ্য নজরুলের ঘটেনি।’
তিনি লিখেছেন-‘৩রা আষাঢ় দিবাগত রাত্রে নজরুল বিরজাসুন্দরী দেবীর নিকট বিদায় নিতে এলো, বলল, “মা, আমি এখনই চলে যাচ্ছি।”
এ প্রেক্ষিতে পূর্বের কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। নজরুল কি নার্গিসকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন ? অবশ্যই তিনি নার্গিসকে বিয়ে করতে সম্পূর্ণ ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন বলেই আলি আকবর খানের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন এবং এ ব্যাপারে পত্রের মাধ্যমে কলকাতার বন্ধু-বান্ধবদেরকে তাঁর বিয়ের কথা জানিয়ে ছিলেন। এমনকি তিনি বিরজাসুন্দরী দেবীকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন।
“মা তুমি না এলে আমার পক্ষেত কেউ থাকছে না। তোমাকে আসতেই হবে।”
নজরুল ইসলাম সত্যিকার অর্থে নার্গিসকে ভালোবেসে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলেন তার প্রমাণ হলো- তিনি পবিত্র গাঙ্গোপাধ্যায়কে চিঠিতে লিখেছেন-
‘এক অচেনা পল্লী-বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে কখনও হইনি।’
শেষ পর্যন্ত নানা কারণে বিয়েটি আর টিকেনি। এ নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। তবে একথা ঠিক যে, নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের জীবিতাবস্থায় কোনোদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। এখানেই এ প্রসঙ্গটি ইতি টানতে পারতাম, কিন্তু আরও কিছু কথা যে থেকে গেছে।
নজরুল বা নার্গিস কি পরস্পর পরস্পরকে কোনোদিন ভুলতে পেরেছিলেন ? নিশ্চয় নয়। নার্গিস পরবর্তীতে লেখালেখি করে তাঁর জীবনের দু:খময় অজানা বেদনা ও কষ্টের কথা বলে গেছেন। আর নজরুল একটি চিঠির মাধ্যমে ও একটি গানে হৃদয় নিঙড়ানো হাহাকার ধ্বনি উচ্চারণ করে গেছেন।
চিঠির প্রারম্ভে সম্বোধন ‘কল্যাণীয়াসু’। শুরু- ‘তোমার পত্র পেয়েছি- সেদিন নববর্ষার নগঘন-সিক্ত প্রভাতে।’
লিখেছেন-
‘আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি- তা দিয়ে তোমার কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না...’।
তাই গানের মাধ্যমে নজরুল লিখেছেন-
‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে।
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।’
নার্গিস নজরুলকে ইহজীবনে পাননি, কিন্তু ভুলেননি। নজরুলও নার্গিসকে পাননি, তিনি কি নার্গিসকে ভুলতে পেরেছিলেন ? মোটেই নয়। নজরুলের কবিতায় ও গানে নানা অনুষঙ্গে নার্গিস তাঁর সৃষ্টিশীলতায় সবসময় জাগ্রত ছিল। নজরুলের সৃষ্টিশীল রচনায় পূর্ণতার ক্ষেত্রে পরোক্ষে নার্গিসের অবদান অসীম।
নজরুল প্রমীলাকেও ভালোবেসেছিলেন। এ ভালোবাসার দুটি স্তর। বিয়ের আগে যে ভালোবাসা যা কবিতা-গানে ব্যক্ত হয়েছে, বিয়ের পর তার সমাধি বা মৃত্যু ঘটেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে- বিয়ের পর প্রমীলাকে নিয়ে কোনো কবিতা বা গান রচনা করেছেন তা দৃশ্যমান মনে হয়নি। তাহলে কি প্রেমের সমাধি রচিত হয় বিবাহ-বন্ধনে ? অনেকটা হয়ত তা-ই। বিয়ের পর দায়িত্ব পালন, কর্তব্যবোধে সংসার পরিগ্রহ করতে গিয়ে সাংসারিক বাস্তবতা হৃদয়রাজ্যের অনুভূমি ভোঁতা হয়ে পড়ে। আমরা দেখি- নজরুল বিয়ের পর প্রমীলাকে নিয়ে দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করেছেন, অন্য দশটি পরিবারের মতোই। প্রমীলা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, স্বামী হিসেবে নজরুলের কর্তব্যবোধের যে নিষ্ঠা দেখেছি, তা পারিবারিক সংসারজীবনের নিখুঁত রসায়ন।
এখন প্রশ্ন- নজরুলের দ্বিতীয় শ্বশুর বাড়ি কোথায় ? প্রমীলা কুমিল্লার মেয়ে, না মানিকগঞ্জের তেওতা গ্রামের ? জন্মসূত্রে অবশ্যই তেওতা গ্রামের মেয়ে। কুমিল্লায় কাকা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় মা গিরিবালাসহ আশ্রিতা ছিলেন। এখানেই নজরুলের সঙ্গে পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা ও প্রেম-ভালোবাসার উন্মেষ। এ হিসেবেই কুমিল্লাবাসী হিসেবে আমরা অনেকটাই আবেগমিশ্রিত উচ্ছ্বাসপ্রবণধারী। কারণ, নজরুল পাঁচবার কুমিল্লা এসে কুমিল্লাবাসীকে যেমন অনেককিছু দিয়ে গেছেন, কুমিল্লাবাসীও নজরুলকে নির্মাণ করেছেন আপন ঔদার্যে। যে অসাম্প্রদায়িক নজরুলকে আজ আমরা দেখতে পাই, কুমিল্লাবাসীর কাছ থেকেই দীক্ষা নিয়ে তাঁর মননভূমি নির্মাণ করেছেন।
নজরুল যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন, যে পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েছেন, বাল্য ও কৈশর কাল অতিবাহিত করেছেন দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে নানা পেশায় আত্মসমর্পিত করতে হয়েছিল, তখন কি দারিদ্রের কারণেই এক দারোগা কাজী রফিজুল্লার পরিবারের সঙ্গে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের কাজীরসিমলায় আসতে হয়েছিল, সপ্তম শ্রেণিতে পড়তে গিয়ে তিনি বাড়িতে লজিং থাকতে হয়েছিল, পরীক্ষার পর আসানসোল চলে গিয়ে মুসলিম ছাত্রবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করার সময় দশম শ্রেণির প্রাক্নির্বাচনী পরীক্ষার আগেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ১ম মহাযুদ্ধে সৈনিকের চাকরি নিয়ে যুদ্ধে চলে যান। যুদ্ধ থেমে যাবার পর ১৯২০খ্রি: ফিরে এসে কলকাতায় কমরেড মুজফ্ফর আহমদের আশ্রয়ে থাকতে শুরু করেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পর একজন অসাম্প্রদায়িক উদার হৃদয়ের বন্ধু শৈলজানন্দের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। পরে ঘটনাচক্রে আলি আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লায় আসেন। কুমিল্লা শহরে কান্দিরপাড় ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় তাঁরা দু’জন ২/৩ দিন থাকেন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী মমতাময়ী সর্বজনীন মাতৃপ্রতিম বিরজাসুন্দরী দেবীকে নজরুল মাতৃ আসনে চিরকালের জন্য অধিষ্ঠান করেন। পাঁচবারে কুমিল্লা এসে কুমিল্লার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের অসাম্প্রদায়িক বন্ধনে নিজের মনের মালিন্য মুছে নজরুল হয়ে ওঠেন অসাম্প্রদায়িক যুগপুরুষ।
কাজেই কুমিল্লাবাসী নজরুলকে নতুনভাবে নির্মাণ করে তুলেন। নজরুল নতুনজীবনের সন্ধান পেয়ে হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক প্রাণ পুরুষ। কাজেই কুমিল্লা অবশ্যই নজরুলকে আপন ভেবে গ্রহণ করেছে দ্বিধাহীনভাবে। কুমিল্লাবাসীর কাছে নজরুল কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত নয়। তিনি আমাদের কাছে কখনও বিদ্রোহী কবি, কখনও সাম্যের কবি-আত্মীয়সূত্রে জামাতা। কারণ, প্রমীলাকে এক্ষেত্রে তাঁর জন্মস্থান দিয়ে বিচার করার প্রয়োজন বোধ করে না কুমিল্লাবাসী।














সর্বশেষ সংবাদ
শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি
অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করুন : প্রধানমন্ত্রী
গ্রেপ্তার বাড়ছে কুমিল্লায়
চিরচেনা রূপে অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
আহতদের চিকিৎসা ও রোজগারের ব্যবস্থা করবে সরকার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
শিক্ষার্থীদের আমি রাজাকার বলিনি, বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
কুমিল্লায় আট মামলায় গ্রেপ্তার দেড় শতাধিক
আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
অফিসে হামলার সময় চেয়ে চেয়ে দেখলেন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আন্দালিভ রহমান পার্থ ৫ দিনের রিমান্ডে
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২ | Developed By: i2soft