দুই পাশে গাছের সারি। পিচ ঢালা সড়কে চলছে যানবাহন। ছায়া ঘেরা মনোরম পরিবেশ। দারুন প্রশান্তির, আরামদায়ক ও স্বস্তিকর। চিত্রটা এমনই ছিল। এখন প্রয়োজনে সড়ক বড়- প্রশস্ত করা হচ্ছে। সড়ক উন্নয়নে নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে গাছ। গত ৫-৭ বছরে ব্যাপক সড়ক উন্নয়নে এমনটাই ঘটছে। মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক বড় করা -উন্নয়ন হচ্ছে বেশি, এসব সড়কের পাশে গড়ে তোলা গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে অবাধে। জেলা-উপজেলা সড়কেও এর ধাক্কা কিছুটা লেগেছে। তবে এখনও গাছ টিকে আছে গ্রামীণ সড়কে। গাছের প্রধান শত্রু সরকারি সংস্থা।
কুমিল্লা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক। দু'পাশ গাছের সারিতে বেশ নয়নাভিরাম ছিলো। বছরের শুরুতে সড়ক বড় করতে কেটে ফেলা হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার গাছ। গাছগুলো ৫০ বছরের মতো সময় ধরে রোদের ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বিশেষ করে কুমিল্লার বুড়িচং, দেবিদ্বার, মুরাদনগর ও ব্রাহ্মণপাড়া অংশে গাছ আছে প্রায় ৪ হাজার ৮২৪ টি। এরমধ্যে ২হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বাকিগুলোও কাটা হবে। রাস্তা বড় হচ্ছে ভারত- বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে। কুমিল্লার ময়নামতি থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ধরখার পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার। দুই লেন থেকে চার লেন হচ্ছে। আখাউড়া স্থলবন্দর রয়েছে। পণ্য পরিবহন সহজ করতে এ প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
এরমধ্যে যে এলাকা দিয়ে সড়ক যাবে না সে এলাকার গাছগুলো কাটা হয়েছে আগেভাগে। এটাকেই নির্বিচার- অবাধ বলা হচ্ছে। সাধারণত টেন্ডারের আগেই গাছ কাটা শুরু হয়ে যায়। যেখানে পরিবেশবাদীরা দাবী করে আসছেন, গাছগুলো রেখেও বিকল্প উপায়ে সড়কের কাজ করা যেত। আর কোন বিকল্প না থাকায় জনস্বার্থে গাছ কাটতে অনুমতি দিয়েছে বনবিভাগ। সামাজিক বনায়নের এসব গাছের মালিকও সওজ, কারণ সড়ক- জায়গার মালিক তারাই।
সড়ক এলাকা চিহ্নিত করে গাছ কাটার আদেশ হয়। একটা সংখ্যাগত হিসাব রাখা হয় মাত্র। গাছ চিহ্নিত করে বা শ্রেণিভেদ- কাটা লাগবে, লাগবে না এমনটা করা হয় না। নির্বিচারে সব কেটে ফেলা হয়। মানে গাছ বাঁচাতে কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না। সুরক্ষার বালাই নেই। গাছ কাটার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের মতামত নেয়া বাধ্যতামূলক।
গাছ কাটতে অনুমতি লাগে- নিষেধাজ্ঞা আছে। ব্যক্তি মালিকানায় লাগানো বা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বড় বা স্থায়ী গাছ (দীর্ঘায়ু ও কাঠ উৎপাদক) কাটতেও বনবিভাগ- সরকারের অনুমতি নিতে হয়। মানে মানুষ সাধারণ বাগান, বসত, পুকুর- খাল পাড়, ক্ষেতে স্থায়ী যে গাছ লাগাবে, সেগুলোও ইচ্ছে মতো কাটা যাবে না। সামাজিক বনায়ন, রাস্তার পাশের গাছ, সরকারি গাছ সবক্ষেত্রে একই নিয়ম।
সড়ক পাশের গাছগুলোও সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি- চুক্তির মাধ্যমেই লাগানো হয়েছিল। গাছ কাটা হলেও বনায়নের পাবলিক পক্ষ তাদের লাভের অর্থ সহজে পান না।
ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা- উপজেলায় গাছ কাটা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন সময়ে দেশের উচ্চ আদালতের বিভিন্ন নির্দেশনা রয়েছে। সম্প্রতি এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ রক্ষায় গাছ কাটা বন্ধে কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিতে রুল জারি করেছে উচ্চ আদালত। এতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলায় পৃথক ভাবে ডিসি- ইউএনও ছাড়াও আইনজীবী, কলেজের অধ্যক্ষ, সমাজকর্মী, পরিবেশবাদী সকলের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করবে। আর উচ্চ পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ জাতীয় কমিটিও থাকবে যারা দেশব্যাপী গাছ কাটা নিয়ন্ত্রণ করবে। ব্যক্তিমালিকানা ছাড়া অন্য গাছ কাটায় এসব কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদন দিবে। একই সাথে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা অনুযায়ী গাছ লাগানোর চুক্তিভূক্ত পক্ষকে অর্থ প্রদানের বিধান সংযুক্ত করা হবে। রুল নিষ্পত্তির পর নির্দেশনা আসলে নির্বিচারে গাছ কাটা অনেকটাই কমে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কেন আদালতের দারস্থ হতে হলো- কারণ সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ গাছপালা থাকা দরকার তা দিন দিন কমছে। সাম্প্রতিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে মানুষের জীবন যাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। অন্যদিকে সামাজিক বনায়ন চুক্তিতে সারাদেশে লাগানো গাছগুলো কেটে ফেলার কারণে পরিবেশের ওপর বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে, যা বন্ধ না হলে দেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। মানুষের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত- লঙ্ঘিত হবে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সড়ক উন্নয়নে নির্বিচারে গাছ কাটছে। কিন্তু নতুন করে গাছ লাগানো হচ্ছে না। অথচ সওজের গাছ লাগানোর জন্য আলাদা দপ্তর রয়েছে। সড়কের আইল্যান্ডে অবশ্য কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। এসবের বেশিরভাগই ছোট আকারের সৌন্দর্যবর্ধক গাছ। লাগানো দরকার ছিল বৃক্ষজাতীয় দেশি গাছ। যাতে পাখিরা খাবার, মানুষ ছায়া ও প্রচুর অক্সিজেন পায়, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ে। সড়কের পাশে ছোট জলাশয় ও থাকা দরকার। এমনিতেই নগরীতে গাছ লাগানোর জায়গা সংকট রয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তি ও সংগঠন গাছ লাগানোর জায়গা পাচ্ছে না। অপর দিকে সওজের ভাষ্য, তারা গাছ লাগানো ও রক্ষণাবেক্ষণে আগ্রহীদের খুঁজছে।
একটি গাছ কাটলে ১০ টি গাছ লাগানোর নির্দেশনা রয়েছে দেশের উচ্চ আদালতের। গাছ কাটার আগেই গাছ লাগাতে হবে। একটি গাছ বড় হতে বহু বছর সময় লাগে।
২০২৩ সালে মন্ত্রী পরিষদ নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় ২০৩০ সাল পর্যন্ত কেউ অনুমতি ছাড়া কোন গাছ কাটতে পারবে না। তবে এই সিদ্ধান্ত মানছে না কেউ। গাছ কাটা বন্ধ ও গাছ সংরক্ষণে কোন সুনির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালা নেই। ২০১২ সালে একটি আইন করার তৎপরতা শুরু হলেও ২০১৬ সালে সংসদে তা থেমে যায়। সরকারের সদিচ্ছার অভাব ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না থাকায় আইন হচ্ছে না। পরিবেশ আইনে গাছ কাটার ওপর আদালত নিষেধাজ্ঞা দেয়, গাছ কাটার আলাদা কোনো শাস্তি নেই। নির্দিষ্ট আইন না থাকার কারণে সংক্ষুব্ধরা চাইলেও আদালতে মামলা করতে পারছেন না। আর দু'-একটি মামলা হলেও শাস্তি হচ্ছে না।
আর তাই গাছ কাটার অপরাধে আদালতে তেমন কোনো মামলা নেই। উচ্চ আদালতে কয়েকটি রিট মামলা রয়েছে। গাছ কাটার বিষয়ে ঢাকার পরিবেশ আদালতে ২৩ বছরে একটি মামলাও হয়নি। এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালতে বন উজার করা কিংবা অবাধে গাছ কাটার দায়ে কারও দৃশ্যমান সাজার নজির নেই। গাছ কাটার মামলায় নিষেধাজ্ঞা ও তলবের আদেশেই সীমাবদ্ধ আদালত।
নির্বিচার বৃক্ষ নিধন, জলাভূমি ও সবুজ বলয় ধ্বংস এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বিলুপ্তির কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের এমন বিনষ্টিকরণ এবং পাশাপাশি বিপুল প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
দেশের সর্বত্র শুধুমাত্র গাছ কাটা, বনভূমি ধ্বংস ও জলাশয় দখলের পায়তারা দেখলেও, কোথাও কোন পরিবেশ - প্রতিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত আমাদের চোখে পরে না। বৃক্ষ ও সবুজ বলয় শূন্য এই তপ্তনগরে শিশু, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী মানুষ, রোগী, গর্ভবতী মা ও বহু বিশেষ মানুষ ক্রমাগত ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। নগর ও নগরবাসীর সুস্থ জীবন ও নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য গাছ ও সবুজালয়ের কোন বিকল্প নেই।
প্রশ্ন হলো নিত্যকার শহরায়ন ও উন্নয়নের আগ্রাসন থেকে কেমন করে গাছকে বাঁচানো যায়। শহর দিন দিন বৃক্ষ শূণ্য হচ্ছে। সড়ক চওড়া করতে, ভবন, ফ্লাইওভার নির্মাণে শত- হাজার গাছ কাটা হচ্ছে। বাঁধাও চলছে, বিপরীতে প্রতিরোধের ইতিহাসে মূল্যবান জায়গাও করে নিয়েছে প্রকৃতিপ্রেমি, সচেতন নাগরিক ও কয়েকটি সংগঠন। তারা বলছে এক একটি গাছ, একটি প্রাণ। উন্নয়নের জন্যে গাছ কাটা কি অপরিহার্য। গাছ কেটেই কেন স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে।
২০৩০ সালে দাবদাহের অন্যতম শীর্ষ নগরী হবে ঢাকা। নগর বা শহরের যে অংশে গাছ নেই, গাছ থাকা অংশে সেখানকার চেয়ে তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। যে কারণে সারাদেশে তাপপ্রবাহ হলেও সিলেটে আগেভাগে বৃষ্টি হয়, মানুষ স্বস্তি পায়। উল্টো পরিস্থিতি ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ অঞ্চলে। গাছ ও জলাশয় থাকলে যে কোন এলাকার মাইক্রো ক্লাইমেট বা অণু জলবায়ু ভালো থাকে, না থাকলে বিপর্যয় হয়। গাছ ক্ষয় কমায়, ছায়া ও আশ্রয় দেয়।
একটি গাছ যে পরিমাণ অক্সিজেন দেয়, তাতে দু'জন মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারে। তার মানে একটি গাছ দু'জন মানুষকে জীবিত রাখার দায়িত্ব পালন করছে। তাই বলা হচ্ছে, গাছ কাটা মানুষ হত্যার চাইতেও ভয়াবহ।
পুরো দেশেই চলছে অবাধে গাছ কাটা কিংবা বন উজার করা। ২৫ ভাগ বন থাকার কথা থাকলেও দেশে সাকুল্যে বনাঞ্চল আছে মাত্র ৮ ভাগ। গাছ কাটা বন্ধে আইন ও কমিশন গঠন করা জরুরি। সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব নয়। বন ও পরিবেশ আইনও যুগোপযোগী করা দরকার। উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনের নামে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। কাটা গাছের স্থানে দেশিয় বৈচিত্র্যময় প্রজাতির বৃক্ষবলয় গড়ে তুলতে হবে।
পরিচিতিঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।