চার
ধাপের উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট হয়ে গেলো গত ৮ মে। যথারীতি সবার
আলোচনা ভোটার টার্নআউট নিয়ে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হিসাবে ৩০-৪০ শতাংশ
ভোটার ভোট দিয়েছেন। ভোটারদের কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বিএনপির না আসা, ধান
কাটার ব্যস্ততা, ঝড়-বৃষ্টিকে দায়ী করা হচ্ছে। আসলে গত কয়েকবছর ধরেই
নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। যে ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ
কষ্ট করে ভোট দিতে গেছেন, গণতন্ত্রের জন্য তাদের ত্যাগ নিশ্চয়ই ইতিহাসে
স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তবে আমার আজকের লেখার বিষয় ভোটার উপস্থিতি নয়।
আজ আসলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নিয়েই কথা বলতে চাই। কার্যকর স্থানীয়
সরকার ব্যবস্থার কথা আমাদের সংবিধানেই উল্লেখ করা আছে।
সংবিধানের ৫৯ (১)
অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত
প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয়
শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ এই স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা প্রশাসন ও সরকারি
কর্মচারীদের কার্য, জনশৃংখলা রক্ষা ও জনসাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক
উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে বলেও সংবিধানে উল্লেখ
করা আছে। আর এই কাজের জন্য চাইলে তারা প্রয়োজনে কর আরোপ করার ক্ষমতাসহ
বাজেট প্রস্তুতকরণ ও নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারনে। সংবিধানে এমন
স্পষ্ট বিধান থাকলেও বাস্তবে বাংলাদেশে কার্যকর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা
নেই। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধাপের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা রয়েছে। জেলা পরিষদ,
সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ। এমনিতে আমরা স্থানীয় সরকার
বলতে, কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় সেই এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসনকে
বুঝি, যা আসলে কেন্দ্রীয় সরকারেরই একটি সমপ্রসারিত অংশ। স্থানীয় সরকার
ব্যবস্থা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ওপর থেকে ক্ষমতা, দায়িত্ব ও
কর্তব্যকে একটি সুনির্দিষ্ট চ্যানেলের মাধ্যমে নি¤œতর পর্যায়ে ক্রমে
হস্তান্তর করা হয়। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি স্তর একে-অপরের সাথে
কোনও না কোনোভাবে জড়িত থাকে এবং এদের সকলের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকে।
বাংলাদেশে
স্থানীয় সরকারের প্রতিটি ধাপে নির্বাচনের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে বাংলাদেশে
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অবস্থা হলো কাজীর গরুর মতো। কেতাবে আছে, গোয়ালে
নেই।
স্থানীয় সরকারের নানা ধাপে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বাস্তবে কোনও
ক্ষমতাই নেই। স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ উপজেলা। কিন্তু
নির্বাচিত চেয়ারম্যান নন, উপজেলা পরিষদ চালান আসলে উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তা। চেয়ারম্যানেরই সেখানে কোনও শক্তিশালী অবস্থান নেই; ভাইস
চেয়ারম্যান বা অন্য সদস্যদের তো কোনও পাত্তাই নেই। তবে বাংলাদেশে আসলে
উপজেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। এমনিতে জনগণের ভোটে
নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মূল দায়িত্ব আইন প্রণয়ন করা। সরাসরি ভোটে
নির্বাচিত ৩০০ সদস্য এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৫০ আসন নিয়ে গঠিত হয় জাতীয়
সংসদ। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদই সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। সংসদ সদস্যরা আসলে কেন্দ্রীয়
সরকারের অংশ। কিন্তু আইন প্রণয়ন বা দেশ পরিচালনার চেয়ে সংসদ সদস্যদের বেশি
মনোযোগ থাকে স্থানীয় সরকারের দিকে। সংসদ সদস্যদের মর্যাদার আসন অনেক
উঁচুতে। কিন্তু সেই উঁচু আসন ছেড়ে তারা স্থানীয় সরকারের পর্যায়ে নিজেদের
নামিয়ে আনতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। স্থানীয় জনগণের সুযোগ-সুবিধা দেখা,
অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তাঘাট, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির দেখভালের
দায়িত্ব আসলে স্থানীয় সরকারের। সরকারের বিভিন্ন ভাতা সঠিক ব্যক্তির কাছে
পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও আসলে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির। কিন্তু কেন্দ্রীয়
সরকারের প্রতিনিধি, মানে সংসদ সদস্যরা কোনও নিয়ন্ত্রণই হাতছাড়া করতে চান
না। জনগণের জন্য তারা কতটা কাজ করলেন, সেটা দেখাতে ব্যস্ত থাকেন তারা। তাই
স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির ক্ষমতা আসলে কুক্ষিগত থাকে স্থানীয় সংসদ সদস্যের
হাতে। নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করতে তারা চান তাদের নিজেদের লোকই যেন স্থানীয়
সরকারে নির্বাচিত হন। শুধু দলের লোক হলে হবে না, নিজের বলয়ের লোক হতে হবে।
অনেকে বলয়েও বিশ্বাস করেন না। নিজের পরিবারের সদস্য মানে স্ত্রী, সন্তান,
ভাই ভাগিনা, ভাতিজা, শ্যালককে নির্বাচিত করতে মরিয়া থাকেন তারা। বিএনপি অংশ
নেয়নি বলে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে এবার উপজেলা নির্বাচন সবার জন্য
উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল। এবার উপজেলা নির্বাচনে তাই দলীয় প্রতীক ছিল না, তাই
দলীয় মনোনয়নও ছিল না। এই সুযোগে মন্ত্রী-এমপিরা নিজেদের আত্মীয়-স্বজন এবং
পছন্দের লোকদের জিতিয়ে আনতে মাঠে নেমে পড়েন।
আওয়ামী লীগ চেষ্টা করেও
মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। নির্বাচন
কমিশনের সামনেও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নির্বাচনকে মন্ত্রী-এমপিদের
প্রভাবমুক্ত রাখা। ওপরে ওপরে যাই হোক, বাস্তবে মন্ত্রী-এমপিরাই ছিলেন
উপজেলা নির্বাচনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক। স্থানীয় সাংসদের এই সর্বগ্রাসী
প্রভাব আওয়ামী লীগেই নানান সমস্যা তৈরি করেছে। তৃণমূলের সাথে এমপিদের
দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এমপির স্বজন আর বলয়ের লোকেরাই যদি সব পদ-পদবী দখল করে
নেয়, তবে ঐ এলাকার বাকি লোকেরা রাজনীতি করবে কেন।
শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে
এমপিদেরই। অধিকাংশ উপজেলায় এমপি সমর্থিত প্রার্থীরাই জয় পেয়েছেন। এভাবে
আসলে স্থানীয় সরকার নয়, উপজেলায় এমপি সরকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেউ কেউ
বলতে পারেন, কোনো ক্ষমতাই যদি না থাকবে, তাহলে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীরা
অংশ নেন কেন। আসলে উপজেলা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানের কোনও ক্ষমতা না
থাকলেও, তাদের একটা সাইনবোর্ড তো আছে।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, এই
সাইনবোর্ডে তিনি ক্ষমতার ভাগ পান। স্থানীয় বালুমহাল, জলমহাল, টেন্ডার,
চাঁদাবাজির ভাগ পান। এমপি আর উপজেলা চেয়ারম্যান যদি একই পরিবারের বা একই
বলয়ের হন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কেন্দ্রীয় সরকার আর স্থানীয় সরকার
মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ