![রাজনীতির বিষ্ময়-শিব নারায়ণ দাশ]( https://www.comillarkagoj.com:443/2024/04/22/CK_1713725300.jpg)
বাংলাদেশের
জাতীয় পতাকার রূপকার, প্রগতিশীল ও বৈষম্যহীন রাজনীতির ধারক, জাসদনেতা বীর
মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাশ ৭৮ বৎসর বয়সে মারা গেছেন। ১৯ শে এপ্রিল’২৪
তারিখ শুত্রুবার সকাল সোয়া ৯ টায় রাজধানীর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন
অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনি আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকার
একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে
চিকিৎসকদের পরামর্শে দ্রুত বিএসএমএমইউ’র আইসিউতে ভর্তি করা হয়।
শিব
নারায়ণ দাশের পিতা সতীশ চন্দ্র দাশ। তিনি বিক্রয়মপুর থেকে কুমিল্লায় আগত
পেশায় ছিলেন একজন আয়ূর্বেদিয় চিকিৎসক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়
পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করে। শিব নারায়ণ দাশের স্ত্রীর নাম
গীতশ্রী চৌধুরী, রেডিও বাংলাদেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। একমাত্র
পুত্র ফ্রিল্যান্সার অর্ণব আদিত্য দাশ ঢাকার মনিপুরি পাড়ায় বসবাস করেন। শিব
নারায়ণ দাশ বিখ্যাত ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতিতে
আসেন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাবাস
যাপন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ‘শিবুদা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বিশুদ্ধ
বাংলায় কথা বলতেন, হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। চিকা, পোষ্টারিং এ ছিলেন
সিদ্ধহস্ত। দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে যারা রাজনীতি করতেন তাদের মধ্যে অন্যতমই
ছিলেন শিবুদা। প্রাপ্তির উল্লাসে আনন্দিত হওয়ার যে বিষয়টি ছিল তার একমাত্র
পাওয়া তার নাম হচ্ছে স্বাধীনতা। পদ পদবীর জন্য লালায়িত ছিলেন না। তারপরও
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সম্পাদক হিসাবে কর্মীদের মাঝে সফল নেতার মত
গ্রহনযোগ্য ছিলেন, ছিলেন সকল স্তরের মানুষের প্রিয় নেতা। কেন্দ্রীয়
ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশকে স্বাধীন করার মন্ত্রে
দিক্ষীত ছিলেন শিবুদা।
আমার দর্শনীয় দু-একটি ঘটনা বর্ণনা না করলেই নয়।
১৯৬৯ সনে ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ নামে একটি বিষয় বিজ্ঞান, কৃষি, মানবিক
সকল বিভাগের ছাত্রদের জন্য ১০০ মার্কের পরীক্ষা এসএসসিতে আবশ্যিক করে দিল।
আমরা বিজ্ঞান ও কৃষি বিভাগের ছাত্ররা এ বিষয় বাদ দেয়ার কথা চিন্তা করতেই
বাবু শিব নারায়ণ দাশ জিলা স্কুল থেকে আব্দুল্লাহ্ হিল বাকী ও কুমিল্লা হাই
স্কুল থেকে আব্দুল জব্বারকে নিয়ে একটি সংগ্রাম কমিটি করে দিলেন “পাকিস্তান
দেশ কৃষ্টি” বাতিলের আন্দোলনের নিমিত্তে। কুমিল্লা হাই স্কুলের ছাত্ররা
প্রায়ই বেরিয়ে এসে রাস্তায় স্লোগান দিয়ে আন্দোলন করছে কিন্তু জিলা স্কুলের
ছাত্রদের রাস্তায় পাওয়া যাচ্ছে না। একদিন আমরা কুমিল্লা হাই স্কুলের
ছাত্ররা বললাম জিলা স্কুলের ছাত্ররা বাহিরে আসে না। জিলা স্কুলের ছাত্ররা
বাহির হওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু বাহিরে এসে হেড মাষ্টারের চেহারা দেখে
ক্লাসরুমে ঢুকে যায়। আমাদের দাবী জিলা স্কুলের ছাত্রদের বাহির করতে হবে।
আমরা সেই কথা শিবুদাকে জোর দিয়ে বলার পর হঠাৎ দেখি শিবুদা স্কুলের দপ্তরির
রুমে ঢুকে পড়ল। একটু পড়ে দপ্তরীর ঘন্টাটি শিবুদা নিজে বাজিয়ে ছুটির অবস্থা
ঘোষণা করল এবং জিলা স্কুলের ছাত্ররা বেরিয়ে আসল।
২৫শে মার্চ’৭১ এর
বিকালবেলা কুমিল্লা টাউনহল মাঠে ছাত্রলীগের নেতাদের বক্তৃতা চলছে। মাঠ
ভর্তি শ্রোতা, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। সমগ্র দেশে
আন্দোলনের মহাসমারোহ চলছে। শিব নারায়ণ দাশবক্তৃতায় উঠে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর
শোষণ ও বঞ্চনায় ইতিহাসে জনতার ঢলকে আন্দোলিত করে চলছে। এমন সময়
পাকিস্তানের পতাকাটি ছিড়ে হঠাৎ যেই আগুন লাগিয়ে দিল পুলিশের সামনে শিবুদা,
জনতার ঢলকে ছত্রভঙ্গ করে দিল পুলিশ, সভা থেকে লোকজন বাড়ী চলে গেলেন।
রাত্রেই ট্যাংক সাজোয়া, স্টেন গান নিয়ে শুরু হল জনতার উপর পশ্চিমাদের
আক্রমন। সকালে উঠে দেখি শিবুদা কালিয়াজুরী দিয়ে পালপাড়ার ব্রীজ হয়ে
সীমান্তের ওপারে চলে যান।
মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করেছেন শিব নারায়ণ দাশ। দেশ হানাদার মুক্ত করেছেন Ñস্বাধীনতার আনন্দে
টগবগ খাচ্ছেন কিন্তু মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে
আবার শুরু করলেন জাসদের সমাজ বিনির্মাণের আন্দোলন। কিন্তু কোথায় যেন
হিসাবের মিল না হওয়ায় শুরু করলেন নিভৃতচারী জীবন। পিজি হাসপাতালের পাশে
আজিজ সুপারে মার্কেটে রেষ্টুরেন্টের ব্যবসা করেছেন। চেষ্টা করেছেন উপজেলা
নির্বাচন করতে। ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন একটি খবরের কাগজ ছাপানোর। কিন্তু এরই
মাঝে শরীরের যতেœ অসম্ভব অবহেলার কারণে সুস্থ ও কর্মঠ থাকতে না পেরে
মনিপুরি পাড়ায় স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে বসবাস শুরু করলেন শয্যাশায়ী হয়ে। অনেক
বন্ধু ও স্বজনরা সাহায্য সহায়তা করেছেন এ অবস্থায়। কিন্তু নিয়তির নির্মম
পরিহাস শেষ পর্যন্ত বিএসএমএমইউর সহায়তা নিয়েও মৃত্যুকে এড়াতে পারলেন না।
তাঁর আত্মত্যাগ, সততা, দেশপ্রেম, অনাড়ম্বর জীবন ও সমাজকে বৈষম্যমুক্ত করার
প্রবল বাসনা রেখে গেলেন পরবর্তী প্রজন্মকে অনুসরণের জন্য।
শিব নারায়ণ
দাশের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেতা জি, এম কাদের। এছাড়া জাসদ ঘরনার আ স ম আব্দুর
রব, হাসানুল হক ইনু, শিরীন আক্তার সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতারা।
শিব
নারায়ণ দাশ কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের ৭ই জুন পল্টন ময়দানে
অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণের কথা ছিল। এ লক্ষ্যে
ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে “ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী” গঠন
করা হয়। ছাত্রনেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরীর সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যে
১৯৭০ সালের ৬ই জুন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট
জহুরুল হক হল) ১০৮ নম্বর কক্ষে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আব্দুর রব,
শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা
নিয়ে বৈঠক করেন। এ বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার
চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রিয় ছাত্রনেতা শিব নারায়ণ দাশ, প্রকৌশল
বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ
সালাউদ্দিন।
সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে সবার
আলোচনা শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের মানচিত্র খচিত
পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের
এক দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরা সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই
করে আনলেন। এরপর প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের কায়দে আযম হলের (বর্তমানে তীতুমীর
হল) ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে অ্যাটলাস্ নিয়ে ট্রেসিং পেপারে
আঁকা হলো পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) মানচিত্র, শিব নারায়ণ দাশ পরিশেষে
তার নিপুন হাত দিয়ে মানচিত্রটি আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে। যা স্বীকৃত হয়
বাংলাদেশের প্রথম পতাকা হিসাবে।
স্বাধীন বাংলার পতাকার রূপকার অনেকেই
বলতে চেয়েছেন কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটি নিউক্লিয়াসের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ছিল
তাই রূপকারের পরিবর্তে নকশাকার শব্দটিই প্রনিধানযোগ্য। ১৯৭১ সনের ২৩ শে
মার্চ পাকিস্তান দিবসে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের
পতাকার পরিবর্তে শিব নারায়ণ দাশের নকশা করা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা
হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার শিব নারায়ণ দাশের নকশা করা পতাকার মধ্যে
মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যা সংবলিত একটি প্রতিবেদন
দিতে বললেন পটুয়া কামরুল হাসনকে। কামরুল হাসান দ্বারা পরিমার্জিত রূপটিই
বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। কয়েকবছর আগে পতাকার মাঝে মানচিত্র আঁকার
কারণ ব্যাখ্যা করে শিবুদা বলেছিলেন, পশ্চিমবাংলা আলাদা করে নির্দিষ্ট
ভূখন্ড বোঝাতে মানচিত্রটি দেয়া হয়। মানচিত্রটি থাকায় পতাকাটি আঁকা অনেক
কঠিন এবং বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সহজ করে আঁকার জন্য মানচিত্রটি
সরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
মত্যুর পর শনিবার ২০.০৪.২৪ ইং তার মরাদেহ
জাতীয় শ্রদ্ধানিবেদনের জন্য ঢাকা শহীদ মিনারে সকালে রাখা হয় এবং তারপর
বিকেলে কুমিল্লা টাউনহল মাঠে রাখা হয় সর্বস্তরের কুমিল্লার জনগণের শ্রদ্ধা
জানানোর জন্য। মৃত্যুর পর শিবুদার ইচ্ছানুযায়ী তাঁর দেহদান করে গেছেন
বিএসএমএমইউর শিক্ষাকার্য্যে ব্যবহারের জন্য ও কর্ণিয়া দান করে গেছেন
সন্ধানীর নিকট। মরিয়াও জাতীয় জন্য মহৎ এ দান সমাজে অত্যন্ত অপ্রতুল। সারাটা
জীবন মানুষের মঙ্গল চেয়েছেন, সমাজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সর্বোপরি একটি
গণমুখী শিক্ষা, চিকিৎসা, আহার, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিশ্চয়তাসহ সুন্দর,
সুশ্রী, পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ চাইতেন তিনি। মনিপুরি পাড়ার বাসা থেকে মোবাইল
ফোনে চিকিৎসা ও দেশ নিয়ে অনেক আলাপই করেছি Ñসবকিছুতেই একটা অপূর্ণতার ভাব
লক্ষ্য করেছি। অসম্পূর্ণতার অভিমান নিয়েই চলে গেলেন জীবনের ওপারে। পরপারে
শান্তিতে থাকুক, রেখে যাওয়া স্ত্রী-পুত্র শূন্যতার অবকাশে সকলের সহমর্মীতায়
উদ্ভাসিত হোক Ñএটাই সকল শোকার্ত মহলের কামনা।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ