শিব
নারায়ণ দাশ, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার অন্যতম এবং মূল নকশাকার।
মানুষটি সম্পর্কে আমার ভগ্নিপতি। তার স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরী, আমাদের
ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন মেজো। বড়বোন প্রায় ষাট বছর ধরে বিয়ে করে প্রবাস
জীবনযাপন করছেন। তাই মেজো বোন গোটা সংসার সামলে রেখেছেন বাবা-মায়ের মৃত্যুর
পরে। শিব নারায়ণ দাশের তাতে কখনো আপত্তি ছিল না। বরং তিনিও সহায়তা করেছেন।
দীর্ঘদিন
এই মানুষটি ছিলেন স্বল্পাহারী। একরকম নিরামিষাশী। গুরুপাক পছন্দ করতেন না।
বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনা যেত না। অনুরোধ করলেও আনা কঠিন কাজ হতো।
কালেভদ্রে রক্ষা করতেন। এইরকম একজন মানুষ ছিলেন রাজনীতি সচেতন। পোস্টার,
বক্তৃতা আর আন্দোলনে। সবার আগে।
সেই মানুষটি ছিলেন ব্যক্তিজীবনে উল্টো।
সামাজিক আচারে ছিলেন প্রায় নিভৃতচারী। লেখালেখি করতেন। নির্দিষ্ট কোনো কোনো
কাগজের জন্য লিখতেন তা বলা যাবে না। লিখতেন ডায়রিতে। গণকণ্ঠ কাগজে লিখেছেন
কদাচিৎ।
কুমিল্লায় থাকার সময়ে ম্যাগাজিন বের করেছেন নিজ খরচে। কারও
মুখাপেক্ষী ছিলেন না। কারও কাছ থেকে সহযোগিতা নেওয়া এটা তার স্বভাবে ছিল
না। তাই উপস্থিত-সরকারের মনোযোগ ছিল না তার প্রতি।
জীবনযুদ্ধে আর্থিক
সংকট ছিল। সেই সংকট কাটাতে শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে একটি খাবার দোকান
দিয়ে নিজেই বসতেন। নাম দিয়েছিলেন ‘অন্তর’। ক্যাশিয়ার টেবিলে বসতেন। যেহেতু
ভোগবিলাসী ছিলেন না তাই তাও ধরে রাখতে পারেননি।
আর্থিক সংকট বা কাজ
নিয়েও কোনো দ্বিধা ছিল না তার। দ্বিধা ছিল অন্যের সাহায্য গ্রহণ করতে।
একবার এক সাংবাদিক, পরে একটি এনজিও অধিকর্তা গিয়েছিলেন শিব নারায়ণকে
সহায়তার জন্য। তিনি বলেন, ‘ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বসতে পারবো না।’
শিব
নারায়ণ ছিলেন প্রথম স্বাধীনতা পতাকার নকশাকার কিন্তু তিনি বলতেন, আমি
নিমিত্তকারী মাত্র। দেশের মানুষের প্রয়োজনে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই
এটা নিয়ে প্রচার চাইতেন না। কে স্বীকৃতি দিলো, না দিলো তা নিয়েও মাথা
ঘামাতেন না। অসুস্থ থাকার সময়ও তা নিয়ে তিনি কিছু বলেননি।
উত্তাল সময়ে
তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য। কুমিল্লার সভাপতি। একাত্তরে তাকে ডেকে
আনা হলো ঢাকায়। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। ১১৮ নম্বর কক্ষ। পতাকা মিছিল
হবে। চার ‘খলিফা’ নেতৃত্ব দেবেন। মিছিলে পতাকা থাকবে।
পতাকার ডিজাইন করা
দরকার। শিল্পী কে হবেন? সামনেই ছিলেন শিব নারায়ণ দাশ। বলা হলো তাকে। রাত
জেগে ডিজাইন করা হলো। সহযোগিতা করেন সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ,
মার্শাল মনিসহ আরও অনেকে। 'ওরা এগারোজন' খ্যাত অভিনেতা খসরু গেলেন
নিউমার্কেট। রং-তুলি জোগাড় হলো। ডিজাইন করা হলো শাহজাহান সিরাজের রুমে।
পরবর্তীতে
নিউমার্কেট এলাকা থেকে আনা হলো কাপড়। শিব নারায়ণ করলেন ডিজাইন। লাল-সবুজের
ওপর হলুদ মানচিত্র বসানো পতাকা। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ছুটে যান।
পতাকার নকশার প্রসঙ্গে উঠলে তিনি বলতেন, আমি না থাকলেও তা হতো। বাঙালি জেগে
উঠেছে। পতাকা উত্তোলন হতোই। কখনোই এই বিষয়টি নিয়ে প্রচার-প্রসার চাইতেন
না। আপাত বিনয়ী মানুষটি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে দুর্বিনীত। আপসহীন। তাই মৃত্যুর
আগ পর্যন্ত কষ্ট করে চলেছেন।
ঘরে টানাটানি। মনিপুরী পাড়ায় পাঁচতলা বাড়ির
ওপর তলায় থাকতেন। বাড়ি ভাড়া দিতে নাভিশ্বাস উঠে যেত। একমাত্র ছেলে অর্ণব
আদিত্য। আগে বেসরকারি বিমানের স্টুয়ার্ড ছিলেন। দুর্ঘটনার পর কাজটি আর করতে
পারেননি। বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং করেন।