বিমানে উঠেই অপেক্ষায় ছিলাম কখন নামবো সৌদি আরবের মাটিতে। কারণ এ মাটিত তো আর যেই সেই মাটি নয়, যে মাটিতে আল্লাহর ঘর পবিত্র কাবা শরীফ, যেখানে জন্ম নিয়ে ছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সা:)। কোটি কোটি মুসলমান যে ঘরকে সামনে রেখে নামাজ আদায় করেন, সেই আল্লাহর ঘর কাবা শরীফ দেখার পরম সৌভাগ্যের অধিকারী হতে যাচ্ছি। জীবনের সেরা সময়ের জন্য তৈরি হচ্ছি। সারা বিশ্বের প্রতিপালকের মেহমান হয়ে মক্কা, মিনা, আরাফাত, মুযদালিফায় হাজির হয়ে বলব, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান-নিমাতা লাকা ওয়াল্ মুলক লা শারীকা লাক' অর্থাৎ 'আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরীক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার।'
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বেলা বারটায় বাংলাদেশের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আমাদের বিমান উড়াল দিল জেদ্দার পথে। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয় জেদ্দায় অবতরণের আগে তিন ঘন্টার জন্য বিরতি থাকবে ভারতের বুম্বাই এয়ারপোটে। বুম্বাই থেকে যেহেতু আমরা মক্কায় যাব তাই বুম্বাইয়ে বিমানে উঠার আগে ইহরামের কাপড় পরে নিলাম। যাঁরা সরাসরি ঢাকা থেকে মক্কা যান, তাহলে ঢাকা থেকে বিমানে উঠার আগে ইহরাম বাঁধাই উত্তম। কারণ জেদ্দা পৌঁছানোর আগেই ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান অতিক্রম হতে হয়। বিমানে যদিও ইহরাম বাঁধা যায়, তবে বিমানে পোশাক পরিবর্তন করাটাও দৃষ্টিকটু। বিনা ইহরামে মীকাত পার হলে এ জন্য দম বা কাফফারা দিতে হবে। তদুপরি গুনাহ হবে। হজ¦ যাত্রীদের ইহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম নিষিদ্ধ। হজ্জ বা উমরাহ পালনকারী ব্যক্তির জন্য বিনা ইহরামে যে স্থান অতিক্রম করা জায়েয নয়, তা-ই হলো মীকাত। বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘরের সম্মানে প্রত্যেককে নিজ নিজ মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়।
যেহেতু বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সময়ের ৩ ঘণ্টার ব্যবধান। এ জন্য বিমানবন্দর থেকে নামার পর পর ঘড়ির সময় ঠিক করে নিলাম। আমরা সৌদি আরবের সময়ে রাত দুইটায় জেদ্দার বাদশাহ আব্দুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। ইমিগ্রেন পুলিশ হজ্জ ভিসা দেখে ছবি ও আঙুলের ছাপ নিল। পাসপোর্টের নির্দিষ্ট পাতায় সিল দিয়ে দিল। ইতিমধ্যে বিমানের বেল্টে মালামাল চলে এসেছে। মালামাল খুঁজে নিলাম। নিরাপত্তা তল্লাশির জন্য মালামাল স্ক্যান করা হল। এয়ারপোর্ট এলাকায় একদল সৌদি স্বেচ্ছাসেবক তারা পাসপোর্টও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা দেখে হজ্জযাত্রীদেরকে ফ্রি মোবাইল সিম দিয়ে সহায়তা করছেন, ফিঙ্গারে ছাপ নিয়ে মোবাইল সীম নিয়ে নিলাম। তারপর আমাদের মোয়াল্লেম আলহাজ¦ ময়নাল হোসেনের নেতৃত্বে সৌদি আরবে পূর্বে নির্ধারিত বাসে মক্কায় উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই কিছু খেজুর গাছের সৌন্দর্য চোখে পড়ার মত। জেদ্দা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে গেটের কাছে লেখা আছে ‘নো এনট্রেন্স ফর নন মুসলিম।’ মক্কায় অমুসলিমরা প্রবেশ করতে পারে না। সব সময় পুলিশ প্রহরা থাকে। হজ্জযাত্রীর গাড়ি হওয়ায় আমাদের গাড়ি চেক পোস্টে আটকায়নি। মক্কার গেট সামনে মোয়াল্লেম বলার পর কিছুক্ষণ পরই গেইট দেখে বুঝতে পারলাম মক্কার কাছাকাছি চলে এসেছি। মনে মনে দু'আ করলাম হে আল্লাহ! আপনার সন্তুষ্টির জন্য উপস্থিত হয়েছি। শয়তান থেকে রক্ষা করুন, হজকে সহজ করুন, কবুল করুন।
ঘণ্টা দুয়েক বাস যাত্রার পর আমরা পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নামার পর পরই ফজরের আযান শুনা যায় দ্রুত আমাদের আবদুল হামিদ শেখ হোটেলে লাগেজ ও ব্যাগ রেখে রাস্তায় এসে জামাতে ফজরের নামাজ পড়ে নেই ।
আমাদের আবাসিক হোটেল ছিল পবিত্র কাবা শরীফের নিকটবর্তী, হোটেল পৌছে সকালের নাস্তা খেয়ে মোয়াল্লেমর সাথে চলে যাই উমরা হজ করতে। আমাদের সফরসঙ্গী ছিলেন আমার স্ত্রী রাবিয়া খাতুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ তিতি, মো. আলী আশরাফ মেম্বারসহ বারজন।
মসজিদে হারামে প্রবেশ করে জমজমের পানি পান করে ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক....পড়তে পড়তে অগ্রসর হই মুসলিম উম্মার হৃদয়ের স্পন্দন পবিত্র কাবা দিকে, কাবা শরীফ দেখেই চোখে ও হৃদয়ে প্রশান্তি চলে আসে। আমাদের এগার ঘন্টার যাত্রা পথের সকল কষ্ট নিমিশে চলে গেল আল্লাহর ঘর দেখে। কাবা ঘরকে কোরআন হাদিসে নিয়ম অনুযায়ি যা জেনেছি সে অনুযায়ী সাত বার তাওয়াফ করে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নেই। কয়েকবার দুরুদ পড়ে নিজের জীবনের, পরিবার, আতœীয়স্বজনও পরিচিতজন সবার গুনাহমাফের আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই এবং দোয়া করি প্রাণ খোলে। এরপর চলে যাই সাফা পাহাড়ও মারওয়া পাহাড় সাত বার আসা যাওয়া বা সায়ী করতে। এই পাহাড়দ্বয় আসা যাওয় বা সায়ী করা হজ্জ বা উমরার সাথে সম্পর্কিত।
তারপর দুইদিন নামাজ, ঘুম ও খাওয়া দাওয়ায় চলে তৃতীয় দিন দ্বিতীয় বার উমরা করার জন্য চলে যাই মসজিদে আয়েশা। এই মসজিটি মসজিদ হারাম এলাকার বাহিরে যা পবিত্র কাবা শরীফ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যেখান থেকে মক্কাবাসীগণ উমরার জন্য ইহরাম বেধে থাকেন। বিদেশীরা যাঁরা একাধিকবার উমরা করতে চায় তাঁরাও মসজিদে আয়েশায় দুইরাকাত নামাজ পড়ে পুনরায় উমরার হজের নিয়ত করেন।
চতুর্থ দিন বাংলাদেশও পাকিস্তানরে তিন মোয়াল্লেম মিলে বাস রিজার্ভ করে রওনা হই ইসলামের হৃদয় জুড়ানো দর্শনিয় স্থানগুলো দেখতে। প্রথমে যাই যেখানে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত তাৎপর্যপূর্ণ স্থান আরাফাতের ময়দান। মক্কা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পূর্বে জাবালে রহমতের পাদদেশে ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত আরাফাতের ময়দান অবস্থিত।
ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত আরাফাত ময়দান জুড়ে রয়েছে চোখে পড়ার মতো অনেক নিম গাছ। জানা যায় এ নিম গাছগুলো বাংলাদেশ থেকে নিয়ে রোপই করা হয়েছে। এ ঐতিহাসিক ময়দানেই বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মিলন ও ঐক্যের স্মৃতিস্তম্ভ অবস্থিত। হাজিগণ এ ময়দানে উপস্থিত হয়ে গুনাহ মাফের জন্য মোনাজাত করেন। হজরত আদম (আ:) ও হাওয়া (আ:) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেন। অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে তাঁরা একে অপরকে খুঁজতে থাকেন। অবশেষে আল্লাহর রহমতে তাঁরা আরাফাতের এ স্মৃতি বিজড়িত ময়দানেই পরস্পর মিলিত হন।
আল্লাহর কাছে তাদের কৃতকর্মের ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তা আল্লাহর কাছে অত্যধিক পছন্দীয় ছিল বিধায় আল্লাহ বিশ্ব মুসলিমের জন্য আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়াকে হজের মূল রুকন হিসেবে কবুল করেন। তারই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দুনিয়ার সকল আদম সন্তান সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি বছর হজের উদ্দেশে পবিত্র নগরী মক্কায় ছুটে আসেন।
আরাফাতের ময়দানে বিশ্ব মুসলিমের হেদায়েতের মূলমন্ত্র হজের খুতবা পড়া হয়। সে খুতবার দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বের প্রতিটি অঙ্গনে অঙ্গনে। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ পাপমুক্ত জীবন লাভের জন্য হৃদয় ও মন দিয়ে আল্লাহ পছন্দের বান্দা হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
আরাফাত ময়দানে পাশে বাস থেকে নেমে মোয়াল্লেমে আমাদেরকে নিয়ে যায় জাবালে রহমত: যাকে দয়ার পাহাড় বলে, মসজিদে নামিরা: আরাফাতের দিন যেখান থেকে হজের ভাষণ দেওয়া হয়। মুজদালিফা: যেখানে বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) প্রথম একত্রে রাত যাপন করেন। মিনা: আল্লাহর আদেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বীয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর আমাদের গাড়ি চলে হেরাগুহায় যেখানে সর্বপ্রথম কোরআন নাযিল হয়।ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিবিজড়িত জায়গায় ঘুরে দেখে সুরা ও দুরুদ পড়ে সৃষ্টিকর্তার নিকট গুনামাফের জন্য প্রার্থনা করি।
জামারাত: মিনাতেই তিনটি জোমরা (স্তম্ভ) অবস্থিত, এগুলোকে একত্রে ‘জামারাত’ বলে। এগুলো ছোট শয়তান (জোমরায়ে উলা), মেজ শয়তান (জোমরায়ে উস্তা), বড় শয়তান (জোমরায়ে আকাবা) নামে পরিচিত। হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানির পথে এই স্থানে শয়তান বাধা সৃষ্টি করলে তিনি পাথর ছুড়ে তাকে বিতাড়িত করেন।
৫ম দিনে বিকাল বেলা যাই জান্নাতুল মুআল্লায় যা পবিত্র কাবা শরীফ থেকে প্রায় ১ কি.মি. উত্তরে কোরায়েশ বংশের প্রাচীন কবরস্থান হিসাবে পরিচিত। যে কবরস্থানে হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রাঃ) ও রাসুল করিম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লামের দুই পুত্র হযরত কাসিম (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহর (রাঃ) কবর শরীফ রয়েছে। এছাড়াও এই কবরস্থানে ৩৯ জন পুরুষ ও ৬ জন মহিলা সাহাবায়ে কেরাম, অনেক তাবেয়ী,উলামায়ে কেরাম এবং বুজুর্গানে দ্বীন শাহিত আছেন।
মক্কায় থাকাকালীন সময়ে ইবাদতে পরে মাঝে মাঝে কিছু সময় পেতাম এ সময়টা ঘুরে ঘুরে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিবিজড়িত স্থানও মক্কার সৌন্দর্য উপভোগ করতাম। একদিন রাসুল করিম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লামের বাড়িও জি¦ন মসজিদ দেখতে বের হলাম যাত্রা পথে একজন মক্কার স্কাউট পোশাক পরিহিত ছেলে দেখে স্কাউটসের কথা মনে পড়ে যায়। বিশেষ করে তখন বাংলাদেশ স্কাউটস রোভার অঞ্চলের আয়োজনে সুবর্ণজয়ন্তী রোভার মুট ছিল গাজীপুর রোভার পল্লীতে, সেখানে আমার প্রিয় কুমিল্লা মুক্ত রোভার স্কাউট দল অংশগ্রহণ করে। স্কাউটারদের মধ্যে থেকে রোভার শাহরিয়ার রহমান ইমন আমার নিকট ফোন করে দোয়া চাইত, দূর থেকে তাদের জন্য দোয়া করতাম, যখনই ফোন দিত কিছুক্ষণ তাদেরকে মিস করতাম। শেষ দিন মসজিদ হারামে পুরো বিকালটা মক্কা স্কাউটদের সাথে প্রাণবন্ত সময় কাটালাম। বিশেষ করে মক্কার স্কাউটার ইসমাইল আবু বকর অতরা, মোহাম্মদ জুবিদি, আবুল হালিম আল ছালাফির সাথে স্কাউট চিহ্ন, সালাম, করমর্দন করে মতবিনিময় হয়। এসময় স্কাউটরা মক্কায় কি কি কাজ করেন এ সম্পর্কে জানলাম। আমিও বাংলাদেশের স্কাউটের সুবর্ণজয়ন্তী রোভার মুটে কথা শেয়ার করি। এসময় মসজিদ হারামে ৫০জন রোভার স্কাউটের সদস্য প্রায় এক হাজার পেটে ইফতার সামগ্রী রোজাদারদের মাঝে বিতরণ করে। মক্কার স্কাউটদের সাথে ইফতার, মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। তাদের সাথে ছবি তুললাম, স্কাউট সালামও কুশল বিনময়ের পর বিদায় নেয়ার সময় স্কাউটার মোহাম্মদ জুবিদি বলে আবার মক্কায় আসবে। তখন আমি বলি ইনশাল্লাহ মহান আল্লাহ সুযোগ দিলে বার বার আসবো।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।