কোরআনে কারিমে
রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দুনিয়াতে প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে :
‘আল্লাহ মুমিনদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে তিনি তাদের মধ্য থেকে একজন রাসুল
প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কোরআন পড়ে শোনাবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন,
কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবেন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৪)
এখানে
সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, তিনি (একজন রাসুল, একজন শিক্ষক) মুমিনদের কিতাবের
শিক্ষা (তালিম) দেবেন। এই কিতাবের তালিম মানে শুধু অনুবাদ শেখা নয়। কিতাবের
তালিম দ্বারা কী উদ্দেশ্য? আরবিভাষী সাহাবিদের শুধুই কি অনুবাদ শেখানো
হতো? তাঁরা তো প্রত্যেকেই আরবি ভাষা ও সাহিত্যের উচ্চ শিখরে আসীন ছিলেন।
আরবের
নারীরা স্বতঃস্ফূর্ত আকস্মিক কবিতা বলতে পারতেন। আর কোরআন বলছে, ‘এই কালাম
সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা : শুআরা, আয়াত : ১৯৫)
সুতরাং
তাদের কোরআনের অনুবাদ জানার জন্য কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু
আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রেরণ করেছেন তাদের কোরআনের শিক্ষা
দিতে।
সুতরাং বোঝা গেল, শুধু অর্থ পড়ে নেওয়া অথবা শুধু আরবি ভাষা জানার
দ্বারা কিতাবুল্লাহর বুঝ এবং কোরআনের ইলম অর্জিত হয় না, বরং কোরআন বোঝার
জন্য বিজ্ঞ শিক্ষকের প্রয়োজন।
শিক্ষক ছাড়া কোনো শাস্ত্র অর্জিত হয় না
আল্লাহ
তাআলা মানুষের স্বভাব এমন বানিয়েছেন যে শুধু বই পড়ার দ্বারা কোনো শাস্ত্রে
তারা পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারে না, বরং শেখার জন্য শিক্ষকের প্রয়োজন হয়।
যদি কেউ মেডিক্যাল সায়েন্সের বই ক্রয় করে, পড়ে বুঝেও নেয় এবং মানুষের
চিকিৎসা শুরু করে দেয়, তাহলে সে কবরস্থান আবাদ করা ছাড়া কোনো সেবার আঞ্জাম
দেবে না। এভাবে শিক্ষকের কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা অর্জন না করে
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই-পুস্তক পড়ে নিলে কেউ তাকে ইঞ্জিনিয়ার বলে মেনে নেবে না।
এককথায় দুনিয়ার যেকোনো শাস্ত্রের পরিপূর্ণতা শিক্ষক ছাড়া অর্জিত হতে পারে না।
নবী ছাড়া শুধু কিতাব কখনো আসেনি
আল্লাহ
তাআলা যে কিতাবই অবতীর্ণ করেছেন, চাই তাওরাত হোক, জাবুর হোক, ইনজিল হোক,
কোরআনে কারিম হোক, প্রতিটি কিতাবের সঙ্গেই নবী পাঠিয়েছেন। এই দৃষ্টান্ত তো
আছে যে নবী এসেছেন, কিতাব আসেনি। কিন্তু এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই যে কিতাব
এসেছে, নবী আসেননি। এটা কেন? এ জন্যই যে আল্লাহ তাআলাই মানুষকে বানিয়েছেন,
তিনিই মানুষের স্বভাব সম্পর্কে বেশি জ্ঞাত যে কিতাবের সঙ্গে শিক্ষকের
অবশ্যই প্রয়োজন আছে।
আলো ছাড়া কিতাবের দ্বারা উপকার হয় না
কোরআনের এক স্থানে সূক্ষ্মভাবে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের কাছে আলো এবং সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে।’ (সুরা : মায়িদা : আয়াত ১৫)
এখানে
নূর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসুল (সা.)-এর শিক্ষার আলো। এতে বোঝা গেল,
কিতাব যতই উত্তম হোক না কেন, তার সঙ্গে রাসুলের শিক্ষার আলো না থাকলে তা
থেকে উপকৃত হওয়া যায় না। তার উদাহরণ হলো- কোনো বই থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য
বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চোখের জ্যোতিও প্রয়োজন। চোখে যদি আলো না থাকে
তাহলে বই থেকে উপকৃত হতে পারে না; যেভাবে চোখের আলো ছাড়া বই থেকে উপকৃত
হওয়া যায় না। তদ্রূপ রাসুলের শিক্ষার আলো ছাড়া কোরআন থেকেও উপকৃত হওয়া যায়
না।
তাই আল্লাহ তাআলা কিতাবের সঙ্গে শিক্ষক পাঠিয়েছেন এবং কিতাবের
তালিমের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘(হে নবী) আপনার ওপর
এই কোরআন অবতীর্ণ করেছি, যেন আপনি মানুষের সামনে সেগুলোর স্পষ্ট ব্যাখ্যা
করে দেন, যা তাদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৪৪)
মুসলিম মনীষীরা কিভাবে কোরআন শিখেছেন
রাসুলুল্লাহ
(সা.) কোরআনের শিক্ষা কিভাবে দিয়েছিলেন? তাবেঈ আবু আব্দির রহমান সুলামি
(রহ.) বলেন, সাহাবায়ে কেরাম আমাদের বলেছেন যে তাঁরা যখন ১০ আয়াত শিখতেন,
তখন তাঁরা ততক্ষণ পর্যন্ত সামনে অগ্রসর হতেন না, যতক্ষণ না এই আয়াতগুলোর
ইলমি ও আমলি বিষয়গুলোর ইলম অর্জন না করতেন। (আল-ইতকান ৪/২০২)
ইসলামী
ইতিহাসের সর্বপ্রথম বিদ্যালয় মসজিদে নববীর আঙ্গিনা, যা ‘সুফফা’ নামে
পরিচিত, সেখানে সাহাবায়ে কেরাম নবীজির খিদমতে উপস্থিত হতেন, আল্লাহ তায়ালার
বাণীসমূহ নবীজির জীবন থেকে শিখতেন, বুঝতেন এবং নবীজির চাল-চলন থেকে তা
অবলোকন করতেন। এগুলো থেকেই কোরআনের তাফসির বুঝতেন। এটা ছিল সাহাবায়ে
কেরামের ইলম অর্জনের পদ্ধতি অর্থাৎ কোরআনের ইলম এবং তার ওপর আমল উভয়টি একই
সঙ্গে অর্জন করতেন।
শুধু অনুবাদ দেখে তাফসিরকারী দ্বিগুণ অজ্ঞতায় লিপ্ত
সাহাবিরা
রাসুল (সা.)-এর সংস্রবে থেকে ইলম অর্জন করেছিলেন। অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম
তাবেঈনকে তা শিক্ষা দিয়েছেন। এরপর তাঁরা পরবর্তীদের শিক্ষা দিয়েছেন। এর
ধারাবাহিকতায় অদ্যাবধি অনুরূপভাবে রাসুলের শিক্ষা আলহামদুলিল্লাহ আমাদের
পর্যন্ত চালু আছে। আজ যদি কেউ বলে, আমাদের শিক্ষকের প্রয়োজন নেই, আমি
কোরআনের অনুবাদ দেখে ব্যাখ্যা যা ইচ্ছা তাই বুঝব। তাহলে ভেবে দেখুন যে
কোরআনের ব্যাখ্যা বোঝানোর জন্য আল্লাহ তাআলা নবীকে পাঠিয়েছেন। মহানবী (সা.)
২৩ বছর পর্যন্ত এর শিক্ষা দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম এর পেছনে নিজেদের জীবন
ব্যয় করেছেন। তাবেঈরা তা সংরক্ষণ করে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন। এ সব
কিছুকে উপেক্ষা করে যদি কেউ বলে, আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই, আমি যা বুঝি
তা-ই শুদ্ধ, তাহলে এর চেয়ে বড় বোকামি আর কী হতে পারে?
কোরআন বুঝতে আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা
আরেকটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোরআনের একাধিক স্থানে শিক্ষাদানের আগে পরিশুদ্ধ
করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রথমে তাদের অন্তর পরিষ্কার করো, তাদের চরিত্র
গঠন করো এবং ইখলাস সৃষ্টি করো, এরপর যখন অর্থ বলবে, তখন কিতাবের শিক্ষা
দেওয়ার সঠিক উপকার অর্জিত হবে। এ জন্যই এরশাদ হয়েছে : ‘তা পবিত্ররা ছাড়া
অন্য কেউ স্পর্শ করে না।’ (সুরা : ওয়াকিয়া, আয়াত : ৭৯)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক উপায়ে কোরআন বোঝার তাওফিক দান করুন। আমিন।