কুমিল্লার শান্তি সুনীতি ফয়জুন্নেসা ও মীরা
নঈম নিজাম
|
প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম ছিলেন চূড়ান্ত পথকে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে। তিনি শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরীকে বেছে নেন বিশেষ মিশন সফল করতে। কোটবাড়ী পাহাড়ি এলাকায় অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁরা শিখে নেন কীভাবে পিস্তল, রিভলবার চালাতে হয়। বাড়ি থেকে কৌশলে বের হতেন সুনীতি চৌধুরী। তাঁর দুই ভাই জানতেন। বোনকে তাঁরা সহায়তা করেন গোপনে। বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রিটিশ সরকারকে ভীত করতে বড় ধরনের কিছু শুরু করবেন। সময় এলো সুনীতি চৌধুরী ও শান্তি ঘোষের মাধ্যমে বড় অপারেশন চালানোর। এ দুই বান্ধবীর বাসা ছিল কুমিল্লা শহরের ফয়জুন্নেসা স্কুলের পাশে দিগম্বরীতলায়। শান্তি ঘোষের বাড়ির নাম ছিল শান্তি কুটির। প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম দুটি অস্ত্র দেন দুজনকে। কীভাবে অস্ত্র চালাতে হয় সে প্রশিক্ষণ আগেই দেওয়া হয়েছিল। ছাত্রী সংঘের এ দুই কিশোরী অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। সিদ্ধান্ত আসে তাঁরাই শেষ করবেন ব্রিটিশরাজের প্রতিনিধি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে। স্কুলপড়ুয়া সুনীতি চৌধুরী ও শান্তি ঘোষের কোনো ভয়ডর নেই। দেশের টানে মাঠে নেমেছেন, ভয় করে কী হবে? ১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলি করে হত্যা করেন সুনীতি ও শান্তি। কেঁপে ওঠে ব্রিটিশরাজের দরবার। অন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হন। নিরাপত্তা নিয়ে তাঁরা চিঠি পাঠান ব্রিটিশরাজের দরবারে। জানান কঠিন বাস্তবতা। ![]() জেল থেকে বের হয়ে সুনীতি-শান্তি আবার পড়াশোনা শুরু করেন। সুনীতি এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হন। শান্তি এইচএসসি পাস করে সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবায় মন দেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন। বিয়ে করেন চট্টগ্রামের চিত্তরঞ্জন দাসকে। সুনীতি বিয়ে করেন শ্রমিক আন্দোলনের নেতা প্রদ্যুত কুমার ঘোষকে। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে সুনীতি মারা যান। শান্তি ঘোষ মারা যান ১৯৮৯ সালের ২৭ মার্চ। কুমিল্লা শহর একসময় প্রগতিশীলদের ঠিকানা ছিল। নওয়াব ফয়জুন্নেসা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন বিপ্লবী সুনীতি ও শান্তি। ভারতবর্ষের প্রথম নারী, যিনি উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, নারী জাগরণের জন্য পেয়েছিলেন নওয়াব খেতাব, সেই ফয়জুন্নেসার মূল্যায়নটা সঠিকভাবে হয়নি। ধন্যবাদ সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ফয়জুন্নেসার স্মৃতিবিজড়িত লাকসামের পশ্চিমগাঁওয়ের নওয়াববাড়িকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঠাঁই দেওয়ায়। ফয়জুন্নেসার বাড়িটি সংরক্ষণের পদক্ষেপ নিয়েছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এখন সারা দুনিয়া থেকে মানুষ আসবে এ বাড়ি দেখতে। ফয়জুন্নেসাকে জানতে। ফয়জুন বাংলাদেশের নারী জাগরণের প্রথম ইতিহাস। বেগম রোকেয়া ও অন্যরা তাঁর অনেক পরের কথা। সে যুগে সব বাধা অতিক্রম করে ফয়জুন্নেসা পেরেছিলেন সফলতার সঙ্গে জমিদারি চালাতে। পুরো ভারতবর্ষে নতুন ইতিহাস গড়তে। আলাদা ব্যক্তিত্বের এই নারী জমিদার সে যুগে সাহিত্যচর্চাও করতেন। তাঁর লেখা ‘রূপজালাল’-এ উঠে এসেছে সে সময়ের একজন নারীর অন্তঃক্ষরণ। ফয়জুন্নেসার ইতিহাস আজকের প্রজন্মকে জানাতে হবে। ফয়জুন্নেসা সবকিছুতে ছিলেন আলাদা। তিনি রবীন্দ্রনাথের বোনদের সংগঠন ‘সখিসংঘ’-এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। মানবতার বিকাশে কুমিল্লায় গড়েছেন হাসপাতাল। মক্কা শরিফে হজ করতে গিয়ে খেয়াল করলেন নারীদের দুর্ভোগ। তিনি হজ শেষে ফিরলেন না। টানা পড়ে থাকলেন মক্কায়। নারীদের বিশ্রাম ও অজুর আলাদা ব্যবস্থা করলেন। ফয়জুন্নেসা শিক্ষার প্রসারে স্কুল করেছেন। কলেজ গড়েছেন। তিনি বুঝতেন নারী-পুরুষকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে যেতে হবে। সে কারণে নারী শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন। ১৮৭২ সালে কুমিল্লা শহরে ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নির্মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসা এখনো স্মৃতি বহন করে চলেছে। সাহসী এই নারী সে যুগে সতীনের সঙ্গে ঘর করবেন না বলে ছেড়েছিলেন স্বামীর সংসার। ভাইদের সংসারে বোনের জমিদারির দায়িত্ব নেওয়া এত সহজ ছিল না। তার পরও ভাইদের চেয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে জমিদারির দায়িত্ব নেন। প্রজাদের মাঝে ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয়। সবাই ডাকতেন ‘বেগম সাহেবা’। জনহিতৈষী কাজ করতেন। পানি সংকট নিরসনে বড় দিঘি খনন করেছেন নিজের জমিদারি এলাকায়। রাস্তাঘাট নির্মাণ করেছেন। তাঁর নির্মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক। ফয়জুন্নেসার ব্যক্তিত্ব দেখতে পেয়েছিলেন তখনকার ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস। একবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন ডগলাস। ব্রিটিশ সরকার থেকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ আসতে বিলম্বের কারণে এই প্রশাসক প্রশাসন চালানো নিয়ে সংকটে ছিলেন। ভাবলেন সংকট কাটাতে স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে ধার নেবেন ১ লাখ টাকা। ১০ জন জমিদারের কাছ থেকে ১০ হাজার করে নিতে পারলে ১ লাখ হবে। অর্থ দেওয়ার অঙ্গীকার করলেন বেশ কয়েকজন। খুশিমনে তিনি গেলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসার কাছে। সব শুনলেন ফয়জুন্নেসা। তারপর বললেন, পুরো টাকাটা তিনি একাই দিতে চান। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিস্মিত হলেন। এতটা তিনি আশা করেননি। তারপর বললেন, একসঙ্গে পাওয়া গেলে খুবই ভালো হয়। শোধ করতে সুবিধা হবে। ফয়জুন্নেসা জানতে চান এ টাকা কোন খাতে ব্যয় হবে। জবাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস বললেন, শিক্ষা, সড়কসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও সংস্কারে। ফয়জুন্নেসা বললেন, টাকাটা ব্যয় হবে দেশের প্রজাদের উন্নয়নে। এ টাকা সঠিকভাবে ব্যয় করুন। পুরো ১ লাখ দেব। মনে রাখবেন টাকা ফেরত দিতে হবে না। ফয়জুন্নেসা যা দান করে তা ফেরত নেয় না। উন্নয়নের দান হিসেবে টাকাটা দিলাম। সে সময় বিশাল অর্থ একসঙ্গে দান হিসেবে পেয়ে হতবাক হয়ে যান জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি বিষয়টি চিঠি লিখে জানালেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মহারানি ভিক্টোরিয়াকে। রাজদরবার বিস্মিত হলো ভারতীয় একজন নারী জমিদারের বিশালত্বে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন ফয়জুন্নেসাকে ‘বেগম’ খেতাব দেবেন। বেগম খেতাবের চিঠি পেয়ে ফয়জুন্নেসা রাজদরবারে চিঠি লিখে প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, প্রজারা তাঁকে এমনিতে বেগম সাহেবা ডাকে। আলাদা খেতাবের প্রয়োজন নেই। বিশাল ইংরেজ সাম্রাজ্যের রানি বিস্মিত হলেন এ প্রত্যাখ্যানের খবরে। রাজসহচরদের কাছে রানি জানতে চান ভারতবর্ষে জমিদারদের জন্য সর্বোচ্চ খেতাব কী? জবাবে জানলেন ‘নওয়াব’। রানি নির্দেশ দিলেন বাংলার এই মহীয়সী নারীকে নওয়াব খেতাব দেওয়ার জন্য। রাজদরবারে তিনি এ খেতাব নিজ হাতে তুলে দেবেন। এবার আসি কুমিল্লার আরেকজন মহীয়সী নারীর কথায়। তাঁর নাম মীরা দেববর্মণ। শচীন দেববর্মণের স্ত্রী এবং রাহুল দেববর্মণের মা হিসেবে খ্যাত। এ দুই পরিচয়ের ভারে আড়াল হয়ে যায় তাঁর স্বতন্ত্র অবস্থান। অথচ মীরা নিজেই ছিলেন বিশাল গীতিকার। তাঁর লেখা অনেক গানই শচীনকর্তার কণ্ঠে এ উপমহাদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মীরা ছিলেন সাদামাটা। স্বামী-সন্তানের মৃত্যু তাঁকে শেষ জীবনে ভেঙে দিয়েছিল। পুত্রবধূ বিখ্যাত শিল্পী আশা ভোঁসলের অবহেলায় তাঁর শেষজীবন কেটেছিল বৃদ্ধাশ্রমে। পরে ত্রিপুরা সরকার তাঁকে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মীরা তাঁর উত্তাল সময়ে লিখেছিলেন, ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া...।’ আহা! অসাধারণ এই সুর এখনো কানে বাজে। তাঁর লেখা আরও কিছু গান-‘বর্ণে গন্ধে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছে দোলা...’ অথবা ‘নিটল পায়ে রিনিক ঝিনিক পায়েলখানি বাজে...’ আমাদের ভিতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। মনের ভিতরে দোলা লাগে ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল...’ শুনে। কুমিল্লার সন্তান শচীনকর্তার সঙ্গে মীরার পরিচয় ১৯৩৭ সালে এলাহাবাদ সংগীত সম্মেলনে। তারপর দুজনের একসঙ্গে পথচলা। বিয়ে করলেন ১৯৩৮ সালে। সন্তান এলো রাহুল দেববর্মণ। স্বামী ও পুত্রের মৃত্যু মীরাকে তছনছ করে দেয়। বৃদ্ধাশ্রম ও হাসপাতালের কষ্টভোগ নিয়েই মারা যান ২০০৭ সালের অক্টোবরে। লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন |