শনিবার ১৯ জুলাই ২০২৫
৪ শ্রাবণ ১৪৩২
গ্রন্থাগারের কথা
শান্তিরঞ্জন ভৌমিক
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১২:৫১ এএম |

 গ্রন্থাগারের কথা
৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। এ দিবসের তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কিছু কথা। প্রাসঙ্গিক বক্তব্য হচ্ছে ইতিহাস-ঐতিহ্য-আবশ্যকতা-সভ্যতার ক্রমবিকাশে অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা এবং কিছুটা স্মৃতিচারণ।
প্রথমেই কবিগুরুর ‘লাইব্রেরী’ প্রবন্ধ থেকে অসাধারণ উক্তিটি উচ্চারণ করছি-
‘মহাসমুদ্রের কত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মত চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরীর তুলনা হইত।’
আবহমানকাল থেকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে কত উত্থান কত পতন যে ঘটে চলেছে তার খবর কে রাখে; কত ইতিহাস যে বিলীন হয়ে গেছে, তার হিসেব কেউ রাখেনি। আবার ইতিহাসের কত ঘটনা কালো কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে মূক-মৌনভাবে নিজেকে প্রকাশিত করে রেখেছে অমরত্বের আলোক সুষমায়, তারও সীমা নেই। গ্রন্থাগারের গ্রন্থের সারিতে যেন মূক-মৌন ইতিহাসের জীবন স্পন্দন শোনা যায়- শোনা যায় কত অতীত ঐতিহ্যের কল-গুঞ্জন-কত মানুষের ব্যথাহত স্মৃতিচারণ-কত সভ্যতার উত্থান-পতনের ধীরে পদধ্বনির সংকেত।
রবীন্দ্রনাথ এরই কথা বলতে গিয়ে নিজের হৃদয়ের মধ্যে যেন গ্রন্থাগারের হৃদয়ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন।
তিনি লিখেছেন-
‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। উহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে। হিমালয়ের মাথার উপর কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরীর মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।’
মানবহৃদয়ের বন্যাকে যেন নিরুদ্ধ অবস্থায় বেঁধে রেখেছে গ্রন্থাগার- তাই গ্রন্থাগারের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে যেন সঞ্চিত হয়ে রয়েছে মানবসভ্যতার যুগ-যুগান্তের দ্যোতনাময় ইতিহাসের হৃদয়স্পন্দন।
গ্রন্থাগার অর্থাৎ ‘গ্রন্থের আগার’। যেখানে অসংখ্য গ্রন্থের সমন্বয়ে একটি আগার নির্মাণ করা হয়েছে। সংগৃহীত গ্রন্থ বা পুস্তক সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা হলে তাকে গ্রন্থাগার বলা হয়।
পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে অতি প্রাচীনকালেও গ্রন্থাগারের প্রচলন ছিল। সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থাগারের পরিচয় আবিষ্কার করতে গিয়ে গবেষকরা খ্রি: পূ: একবিংশ শতকে ব্যাবিলনে কতকগুলো লিপি সম্বলিত মাটির ফলক পেয়েছেন। এই মাটির ফলকটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থাগারের নিদর্শন বলে তাঁরা প্রমাণ করেছেন। এছাড়া ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে পাওয়া ব্যাবিলন, আসিরিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া, নালন্দা, তক্ষশিলা ও বিক্রমশিলা প্রভৃতি স্থানের পৃথিবী বিখ্যাত গ্রন্থাগারের সন্ধান পেয়েছেন ইতিহাসের কৌতূহলী গবেষকগণ।
মাটির ফলকে গ্রথিত দশ হাজার গ্রন্থের সংগ্রহ আবিস্কৃত হয়েছে আমীরী স¤্রাট হাম্বুরাবির রাজত্বকালের প্রাচীন গ্রন্থাগারের নিদর্শন হিসেবে। ভারতের গ্রন্থপ্রেমিক দানবীর হর্ষবর্ধন তাঁর প্রিয় কনৌজ শহরটিকে সাজিয়েছিলেন মিউনিয়াম ও গ্রন্থাগারের দ্বারা।
শিক্ষাবিস্তারে গ্রন্থাগারগুলোর ভূমিকা যে কত অসাধারণ, তা ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়; তেমনি আবার একালের পন্ডিত-গবেষক এবং সাধারণ পাঠকের নিকটও গ্রন্থাগারগুলোর অমূল্য অবদান অনস্বীকার্য।
মজার বিষয় হলো- পৃথিবী ভ্রমণ না করেও গ্রন্থাগারের গ্রন্থ পাঠ করে পৃথিবীর নানা দেশ ও নানা জাতির সম্বন্ধে বিভিন্ন ও বিচিত্র বিষয় জানা যেতে পারে- একটি ভূম-লের মধ্যে যেমন সমগ্র পৃথিবীর ভৌগোলিক অবস্থান সহজে উপলব্ধি করা যায়, তেমনি একটি গ্রন্থাগারে বসে পাওয়া যায় পৃথিবীর কত বিভিন্ন দেশের মানুষের সংস্কৃতি, সভ্যতা ও জীবনের পরিচয়।
শিক্ষাবিস্তারের জন্য নির্দেশিত গ্রন্থাগারগুলোকে সাধারণভাবে কয়েকটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়-
১. জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার
২. বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার
৩. স্কুল-কলেজ গ্রন্থাগার
৪. সাধারণ গ্রন্থাগার
৫. বিশেষ গ্রন্থাগার
এগুলোর প্রত্যেকটি শ্রেণির প্রধান উপযোগিতা শিক্ষাবিস্তারের ও জ্ঞানের প্রসারের ব্যাপকতায়। জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারগুলো সাধারণত সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত হয়। দেশের যেকোনো নাগরিকের এই গ্রন্থাগারের বই ব্যবহারের অধিকার থাকে এবং এগুলোর ক্ষেত্রে কতগুলো বিশেষ নিয়ম অনুসরণ করা হয়। সাধারণত আইন করা হয় যে দেশের প্রায় সমস্ত মুদ্রিত ও প্রকাশিত পুস্তক প্রকাশ হওয়ার পরেই এই শ্রেণির গ্রন্থাগারে বিনামূল্যে জমা দিতে হবে। এতে জনসাধারণ সকল সময়েই এই সকল গ্রন্থ পাঠের সুযোগ পেতে পারেন। যেকোনো সভ্য দেশের জাতীয় মর্যাদার পরিচয় এই শ্রেণির গ্রন্থাগারগুলো- এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রিটিশ মিউজিয়াম (যুক্তরাজ্য), বিব্লিওতেক ন্যাজনাল (ফ্রান্স), লাইব্রেরী অফ কংগ্রেস (আমেরিকা), লেলিন লাইব্রেরী (রাশিয়া), জাতীয় গ্রন্থাগার (কলকাতা) প্রভৃতি।
বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে এখন কুমিল্লার গ্রন্থাগারগুলোর প্রতি আলোকপাত করতে চাই। কুমিল্লা শহরে সরকার কর্তৃক পরিচালিত ‘জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার’ রয়েছে। শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় অনেক সময় পাঠক সমাবেশ তেমনভাবে ঘটে কীনা, তা আমার জানা নেই। এছাড়া শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির শহর কুমিল্লায় এশিয়াখ্যাত রামমালা গ্রন্থাগার রয়েছে, বীরচন্দ্রনগর মিলনায়তনে গণপাঠাগার আছে। একসময় অভয় আশ্রমের গ্রন্থাগার, রামকৃষ্ণ আশ্রমের গ্রন্থাগার, বসন্তস্মৃতি পাঠাগার, মৃণালিনী দেবী পাঠাগার ছিল। এগুলোর কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভিক্টোরিয়া কলেজ লাইব্রেরীও সমৃদ্ধ ছিল। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরীগুলো অনেকটাই একাডেমিক। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কতটুকু জ্ঞানর্জনে গ্রন্থপ্রেমিক তা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।
আজকাল একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি- যারা ধনবান, বিত্তবান, অর্থনৈতিকভাবে সামর্থবান তারা তাদের বসার ঘরে সুদৃশ্য আলমিরা সাজিয়ে তাতে অনেক বই রাখছেন। বইগুলোর মধ্যে ধর্মীয় গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক-সস্তা থেকে দামী উপন্যাস, অতি অল্প ক্লাসিক ইত্যাদি ধরনের বই দেখা যায়। পরিতাপের বিষয় হলো- বইগুলো ক্রয় করা হয়েছে, পড়া হয়নি, পড়তে দেয়াও হয় না, তা স্পর্শ করার সুযোগও নেই। এগুলোর কাজ হলো পরিবারটাকে একটু মর্যাদা দেয়া। বলা চলে- একজন নারী যতই সুন্দরী হোক তিনি যদি মাতৃত্বের সাধ না পান কেবল অস্পর্শ থেকে সতীত্ব রক্ষা করে চলেন- তাতে গৌরব বা মার্যাদা বা সার্থকতা কোনটাই ভাগ্যে জুটে না। তারপরও বলবো- যারা না পড়ে কেবলমাত্র নিজেকে কৃত্রিম আলোকিত ভাববার জন্য বসার ঘরে একটি বই-এর সংগ্রহশালা তৈরি করেছেন-একদিন এই বইগুলো অবশ্যই সমস্বরে কথা বলে উঠবে- পরিবারটিকে সঠিক পথ দেখাবে।
একটি পরিবারে একটি বই-এর সংগ্রহশালা, গ্রন্থাগার বলছি না, থাকলে এ পরিবারটি আলোকিত হবেই। এই পরিবারটি আমার মতে একটি ধনী পরিবার।
পরিশেষে বলতে চাই- সমাজ জীবনের অন্যতম বিশেষ অঙ্গ গ্রন্থাগারগুলো জাতীয় উন্নতির পথকে সুগম করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। দেশের বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন বিদ্যাচর্চার প্রতিষ্ঠান, তেমনি গ্রন্থাগারগুলো দেশের জ্ঞানের প্রসারের প্রতিষ্ঠান। গ্রন্থাগার হলো জাতীয় প্রগতির প্রকৃষ্ট পরিচায়ক।












সর্বশেষ সংবাদ
এক বছরে সাড়ে ৩ শ ধর্ষণের অভিযোগ কুমিল্লায়
সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পেলে ধারনা করা যাবে নির্বাচন কবে হবে: সিইসি
আজ কুমিল্লায় আসছেন সিইসি
চান্দিনায় মধ্য রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
এক বছরে ৯৬ বেওয়ারিশ লাশ দাফন কুমিল্লায়
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
জিয়া সাইবার ফোর্স- কুমিল্লা উত্তর জেলা কমিটি অনুমোদন
কুমিল্লা ইকরা মডার্ণ স্কুলের বার্ষিক ফল প্রকাশ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা
কুমিল্লায় বিজিবি অভিযানে ৬০ কেজি গাঁজা জব্দ
চান্দিনায় মধ্য রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
‘সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণ নয়’
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: newscomillarkagoj@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২