শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
১২ শ্রাবণ ১৪৩১
মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা : বাংলাদেশ যা করতে পারে
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ: সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১:০৩ এএম |

 মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা : বাংলাদেশ যা করতে পারে
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে কিছুদিন ধরে সেই দেশের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। বিষয়টি ততক্ষণ পর্যন্তই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে, যতক্ষণ এর আঁচ এসে অপর দেশের ভূখ-ে না পড়বে।
অবশ্য মতান্তরে এটাও বলা সঙ্গত যে যুগের পর যুগ ধরে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্বও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এড়াতে পারে না এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়, বিশেষত জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সামরিক শাসনের লাগাম টেনে ধরার ব্যর্থতা এবং নিরীহ মানুষের মানবাধিকার রক্ষার মতো বিষয়গুলো যত দীর্ঘ সময় ধরে উপেক্ষিত থাকে, এর একপর্যায়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার বিষয়টি মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বাংলাদেশের নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বান্দরবানের নাইক্ষাংছড়ি সীমান্তে সৃষ্ট এই উত্তেজনা অগ্রহণযোগ্য, কেননা একটি সার্বভৌম দেশের সীমানার ভেতর উপর্যুপরি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের রেশ এসে পড়বে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আর তার জন্য সামগ্রিকভাবে আমাদের জাতীয় স্বার্থের নিরিখে বিষয়টি দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
এটি এবারই যে প্রথম ঘটেছে তা নয়, বছরখানেক আগেও এই ধরনের উত্তেজনার রেশ এসে পড়ে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে। সেইসময় একাধিক বাংলাদেশি নিহত হয়েছিলেন সেই দেশের যুদ্ধরত বাহিনীর ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে। তারও অনেক আগে থেকেই এসব উত্তেজনার রেশ ধরে কয়েকদশক ধরে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এক বিশাল সংখ্যা আশ্রয় নিয়েছে আমাদের দেশে। আজ পর্যন্ত তাদের এই ধরনের সমস্যা দ্বারা সৃষ্ট আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং নিরাপত্তাহীনতার বিষয়গুলো সমাধানে কোনো ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক মন্তব্যে বলেছেন, মিয়ানমারে চলমান সংঘাত তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাংলাদেশের সাথে তাদের কোনো বিরোধ নেই। তা নিয়ে একাধিকবার বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এর ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে বা হচ্ছে তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং একসপ্তাহ সময়ের মধ্যে এই উত্তেজনার ফলে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে আসা মর্টার শেলের আঘাতে ৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
এই ধারাবাহিকতায় বিষয়টি কি আসলেই এখনো মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সীমাবদ্ধ রয়েছে কি না তা সরকারের সংশ্লিষ্টদের জন্য ভেবে দেখা জরুরি। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কতটুকু নিষ্ঠুর হলে সেই দেশের মানুষের ওপর চরম দমন-পীড়ন চালিয়ে যেতে পারে এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ২ জন বিদ্রোহীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা।
৩ মাস আগে এই ধরনের একটি ঘটনা সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উন্মোচিত হওয়ার পর থেকে সামরিক জান্তা বিরোধী আন্দোলন আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। অনেকদিন ধরে চলতে থাকা এই জান্তাবিরোধী বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মধ্যকার আন্দোলন এখন এক সমন্বিত রূপ নিয়েছে এবং একের পর এক জান্তাবাহিনীর হাত থেকে নতুন নতুন অঞ্চলগুলোর দখল নিতে শুরু করেছে সশস্ত্র যোদ্ধারা।
পরিস্থিতি বর্তমানে এত ভয়াবহ রূপলাভ করেছে যে সামরিক জান্তা সরকারের সেনা এবং সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর আন্দোলনে উভয়পক্ষই যুদ্ধের সব নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে পৈশাচিকতাকে হাতিয়ার করে নিয়েছে। এর রেশ ধরে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ থেকে নাইক্ষাংছড়ি সীমান্তে উত্তেজনার রেশ ধরে এই পর্যন্ত মিয়ানমারের ৩ শতাধিক বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তাদের নিরস্ত্র করেছে, সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে এবং মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জানা গেছে এখন পর্যন্ত শতাধিক বিজিপি সদস্যকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে তাদের ভাগ্যে কী জুটবে তা বলা যাচ্ছে না।
এর আগে এই ধরনের ঘটনায় ভারতে আশ্রয় নেওয়া কয়েকজন বিজিপি সদস্যকে ফেরত এনে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করা হয়েছে। বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে সেই দেশের সেনাবাহিনীর হয়ে লড়তে অস্বীকার করার ফল ভয়াবহ, আবার এই ধরনের মানুষকে মানবিক বিবেচনায় প্রতিবেশী দেশগুলোয় আশ্রয় দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই। ফলে প্রাণভয়ে যারা দেশ ছাড়ছেন, তাদের এটা অনেকটা মেনেই নিতে হচ্ছে যে, তাদের জীবনে ভয়াবহ অমানিশা অপেক্ষা করছে।
এই উত্তেজনার জেরে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে আবারও রোহিঙ্গাদের ঢল বাংলাদেশে আসার নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যদিও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আর কোনো শরণার্থী বাংলাদেশ আশ্রয় দেবে না। এখন পর্যন্ত জানা গেছে যে ৬৫ জন রোহিঙ্গাকে এই দেশে আসার আগেই পুশব্যাক করা হয়েছে মিয়ানমারে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আমাদের দিক থেকে যতই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক না কেন, কিংবা সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের যতই সতর্ক প্রহরায় রাখা হোক না কেন, এই ধরনের তৎপরতা কোনোভাবেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখতে পারবে না।
আর তাদের এই অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা যতদিন প্রলম্বিত হবে, আমাদের সীমান্তের পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এখন পর্যন্ত আমরা যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি, তা হচ্ছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলো সামরিক সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে সামরিক সরকারও দমনমূলক কর্মকা-কে আরও বাড়িয়েছে। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায় যে এই সংঘাত আরও কিছুদিন ধরে চলমান থাকবে এবং কোনো একপক্ষের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত তা আরও বিস্তৃত হতে থাকবে। এটা যদি আমরা ধরেই নিই, তাহলে আমাদের অভ্যন্তরীণভাবে নতুন কর্মপন্থা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে।
আর এটি হতে পারে আমাদের বিজিবির উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি আর কোনোভাবেই যেন কোনো বিজিপি কিংবা রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ আমাদের ভূখ-ে না ঘটে এবং সীমান্ত এলাকার মানুষ যেন নিরাপত্তার সাথে নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করতে পারে তার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
ইতিমধ্যে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভারত এবং চীনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। তারা আমাদের সরকারকে আশ্বস্ত করে আমাদের সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই ধরনের প্রতিশ্রুতি তারা আগেও দিয়েছিল, কিন্তু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যায়নি এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে তাদের দিক থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়নি।
এমতাবস্থায় আমাদের সরকারের উচিত হবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি আমাদের সামর্থ্যের সদ্ব্যবহার করা। প্রয়োজনে সীমান্তে সেনাসমাবেশ করার মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা যেতে পারে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে উত্তেজনা যদি আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার ক্রমাগত কারণ হয়, তাহলে আমাদের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও স্বল্প পরিসরে এর জবাব দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
এই সবকিছুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দরকার পড়বে প্রতিবেশী দেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে চলা। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এখন কূটনৈতিকভাবে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে, যেন আমাদের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রয়োজনে আমাদের দিক থেকে যেকোনো তৎপরতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করা যায়।
এই সুযোগে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং তাদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি নিয়েও সমানতালে কাজ করা যেতে পারে। মোট কথা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এই সমস্যায় বাংলাদেশের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়












সর্বশেষ সংবাদ
শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলিনি
অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করুন : প্রধানমন্ত্রী
গ্রেপ্তার বাড়ছে কুমিল্লায়
চিরচেনা রূপে অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
আহতদের চিকিৎসা ও রোজগারের ব্যবস্থা করবে সরকার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
শিক্ষার্থীদের আমি রাজাকার বলিনি, বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
কুমিল্লায় আট মামলায় গ্রেপ্তার দেড় শতাধিক
আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
অফিসে হামলার সময় চেয়ে চেয়ে দেখলেন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আন্দালিভ রহমান পার্থ ৫ দিনের রিমান্ডে
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২ | Developed By: i2soft